ইভিএম কেনার তোড়জোড়ে সন্দেহ–অনাস্থা বাড়বে

ইভিএম
ফাইল ছবি

বিতর্কের মুখেও যখন দুই লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম কেনার প্রকল্পের অনুমোদন দিতে তড়িঘড়ি করা হচ্ছে, তখন সরকারের এমন তৎপরতার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। নির্বাচনে মূল অংশীজন যারা, সেই রাজনৈতিক দলগুলোই এখনো ইভিএম ব্যবহার নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। বরং বেশির ভাগ দলই এর বিরোধিতা করছে। বিরোধিতাকারী দলগুলোর সন্দেহ এবং আস্থার সংকট দূর করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। পরিস্থিতিটাকে উপেক্ষা করে ইভিএম কেনার তোড়জোড় সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

আরও পড়ুন

একদিকে ঐকমত্য নেই রাজনৈতিক অঙ্গনে, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতি নিয়ে নানা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদেরা। এমনকি সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকেও অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে অপচয় কমানোসহ নানা রকম সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে।  কিন্তু ইভিএম প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। ফলে বাস্তবতা কতটা বিবেচনা করা হচ্ছে, সেই প্রশ্নও উঠছে।

‘ইভিএম কিনতে হঠাৎ তড়িঘড়ি’ শিরোনামে প্রথম আলোতে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ১৭ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য তোলা হতে পারে। কিন্তু নিয়ম ভেঙে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই বড় অঙ্কের অর্থের প্রকল্প একনেকে নেওয়া হচ্ছে অনুমোদনের জন্য। এ ছাড়া প্রকল্পের মধ্যবর্তী মূল্যায়নও এখনো হয়নি। তড়িঘড়ি করতে গিয়ে নিয়মনীতিও মানা হচ্ছে না।  ফলে অনুমোদনের প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে কতটা?

যদিও জাতীয় সংসদের আগামী নির্বাচনে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে চাইছে নির্বাচন কমিশন। এখন দেড় লাখ ইভিএম আছে। ১৫০ আসনে ভোট নিতে আরও ২ লাখ ইভিএমের চাহিদার কথা নির্বাচন কমিশন বলছে। নির্বাচন কমিশন থেকেই বিভিন্ন সময় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

বেশির ভাগ দলই ইভিএমের বিরোধী

নির্বাচন কমিশন গত বছরের জুলাই মাসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সেই সংলাপে অংশ নেয়নি। তবে বিএনপি ইভিএমের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। সংলাপে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ দলই ইভিএমের বিরোধিতা করেছে। এমনকি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা জাতীয় পার্টিও ইভিএমের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং তার শরিক চারটি দল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছে। আওয়ামী লীগ চাইছে বলেই নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, এই অভিযোগ রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে।

কারণ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বিভিন্ন সময় বলেছেন, বেশির ভাগ দল ইভিএমের বিপক্ষে। এরপরও যখন ইভিএমের মাধ্যমে ভোটকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, তখন এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। গত সপ্তাহেও নির্বাচন কমিশন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বৈঠক করেছে। সেই বৈঠকেও পক্ষে–বিপক্ষে মত এসেছে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। বিশেষজ্ঞরাও একমত হতে পারছেন না। ইভিএম ভোটে কারচুপির সুযোগ নেই—এই বক্তব্য নিয়ে নির্বাচন কমিশনের জনমত সৃষ্টির চেষ্টায় সন্দেহ বা আস্থার সংকট দূর করা যায়নি। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

আরও পড়ুন

সীমিত ব্যবহারেই নানা প্রশ্ন

বিভিন্ন সময় সংসদের উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বিভিন্ন নির্বাচনে সীমিত পর্যায়ে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সীমিত পর্যায়ে ইভিএম ব্যবহারেও নানা প্রশ্ন এবং অভিযোগ উঠেছে।

কিছুদিন আগেই গত ২৭ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএমে ভোট হয়েছে। সেই নির্বাচনে ভোটারদের আঙুলের ছাপ না মেলাসহ নানা সমস্যার কারণে ভোট গ্রহণে বিলম্ব হতে দেখা গেছে। ফলে অনেক ভোটকেন্দ্রে নির্ধারিত সময়ের পর রাতে পর্যন্ত ভোট নিতে হয়েছে। অনেকে নানা জটিলতায় ভোট দিতে পারেননি। সেই ভোট নিয়ে নানা অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছে।

সীমিত পর্যায়ে ইভিএম ভোটে যেসব উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোও নির্বাচন কমিশন আমলে নিতে রাজি নয়। আওয়ামী লীগও বলে আসছে, ইভিএমের মাধ্যমে ভোটে কারচুপির কোনো সুযোগ নেই। ব্যালট পেপার বা ব্যালট বাক্স থাকলে ছিনতাই করার সুযোগসহ ভোটকন্দ্রে নানা অনিয়ম হতে পারে। ইভিএমে সেটা সম্ভব নয়। এসব আওয়ামী লীগের মূল যুক্তি।

বিএনপি এবং বিরোধী দলগুলো মনে করছে, ইভিএমে শুধু সুইচ টিপলেই ভোট দেওয়া যাবে। প্রার্থী বা ভোটার কোনো প্রমাণপত্র পাবেন না।  ফলে মামলা করার কোনো সুযোগ নেই। সে কারণে তারা এই পদ্ধতিকে নির্ভরযোগ্য মনে করছে না। এ ছাড়া ইভিএম নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ আছে বলেও বিএনপি মনে করে।

আস্থার সংকট

প্রধান দুই দলই তাদের অবস্থানের পক্ষে–বিপক্ষে যুক্তি দিচ্ছে। কিন্তু বিতর্কের অবসান হচ্ছে না।  কারণ, এখানে নির্বাচনব্যবস্থা নিয়েই দলগুলোর মধ্যে বিরোধ বাড়ছে। বিএনপি নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার দাবিতে এখনো অটল রয়েছে। তারা সমমনা বিভিন্ন দল এবং জোটকে নিয়ে আন্দোলনও অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের দাবিতে কোনো ছাড় না দেওয়ার শক্ত অবস্থান তুলে ধরছে। ফলে নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে কোনো সমঝোতা না হলে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, সেটা এখনই বলা মুশকিল। এমন পটভূমিতে ইভিএম নিয়ে সরকারের উদ্যোগ অবিশ্বাস আরও বাড়াতে পারে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেছেন, নির্বাচনব্যবস্থা সম্পর্কে ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত তারা নির্বাচন নিয়ে কোনো উদ্যোগকেই গুরুত্ব দিতে রাজি নন। এ ছাড়া ইভিএমে ভোট তাঁরা কোনোভাবে মেনে নেবেন না।

নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে যেহেতু বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করছে, ফলে নির্বাচনের এই বছরে সেই আন্দোলন থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে সরকার ইভিএম ইস্যুকে বারবার সামনে আনছে কি না—এই সন্দেহও রয়েছে বিএনপি নেতাদের।
তবে আওয়ামী লীগের নেতারা তা মানতে রাজি নন। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেছেন, এ বছরের ডিসেম্বরে কিংবা আগামী বছরের জানুয়ারির শুরুতে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।

রাজনৈতিক বিতর্কের অবসান যে এখনই হচ্ছে না, সেটা পরিষ্কার। কিন্তু অর্থনীতি নিয়ে নানা আশঙ্কার কথা যখন উঠছে, অর্থ অপচয় বা সরকারি ব্যয় কমানোর কথা বলা হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে ২ লাখ ইভিএম কিনতে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া গত নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে ৭০০ কোটি টাকা। সেখানে এবার ইভিএম কেনার ক্ষেত্রেই বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করলে আগামী নির্বাচনের ব্যয় প্রায় ১৪ গুণ বেড়ে যাবে বলে নির্বাচনী পর্যবেক্ষকেরা বলছেন। এই পরিস্থিতিও ইভিএম কেনার ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হচ্ছে না। যদিও ইভিএম কেনার অর্থায়ন নিয়ে সরকার চিন্তিত নয়, এমন ইঙ্গিতই দেওয়া হচ্ছে।

আসলে কোন বিবেচনায় এবং কেন ইভিএম কেনার প্রকল্প নিয়ে এত তোড়জোড়—এর পরিষ্কার জবাব তুলে ধরা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন