বাংলাদেশ–চীন–ভিয়েতনামে আইইএলটিএসের প্রশ্নফাঁস, ৮০ হাজার শিক্ষার্থীর ভুল ফল

পড়াশোনাফাইল ছবি

আন্তর্জাতিক ইংরেজি ভাষার পরীক্ষা (আইইএলটিএস) নম্বরে (মার্কিং) ত্রুটির কারণে প্রায় ৮০ হাজার পরীক্ষার্থী ভুলভাবে পাস নম্বর পেয়েছেন। আইএলটিএসে অকৃতকার্য হওয়া সত্ত্বেও হাজারো অভিবাসী যুক্তরাজ্যের ভিসাও হয়তো পেয়েছেন। ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালিত আন্তর্জাতিক ইংরেজি ভাষার এ পরীক্ষায় (আইইএলটিএস) অকৃতকার্য অনেক পরীক্ষার্থীকে পাস করিয়ে দেওয়া এবং ভিসা পাওয়ার তথ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ

প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, চীন, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিক্রি করার অভিযোগের পাওয়া গেছে। ফলে এসব পরীক্ষার্থী আগেই সঠিক উত্তর জানতে পারেন। ইংরেজি ভাষায় দুর্বল ছাত্র, এনএইচএস (স্বাস্থ্য) কর্মী এবং অন্য অভিবাসীদের স্টাডি ভিসা বা কাজের ভিসা দেওয়া হয়েছে, যা পাওয়ার যোগ্যতা তাঁদের ছিল না। সমস্যাটি মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ধরা পড়েছে। গত মাসে আইইএলটিএসের পক্ষ থেকে ভুল ফল পাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের সঠিক ফল জানানো হয়েছে এবং ‘আন্তরিক দুঃখপ্রকাশের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সহায়তা’ প্রদান করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

দ্য টেলিগ্রাফের সহযোগী সম্পাদক গর্ডন রায়নার এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেলিগ্রাফ জানতে পেরেছে যে বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও হাজারো অভিবাসীকে ভিসা দেওয়া হয়েছে মার্কিং নিয়ে ভুল করার কারণে।
ব্রিটিশ কাউন্সিল পরিচালিত ভাষা পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮০ হাজার ব্যক্তিকে ভুল ফল দেওয়া হয়েছে, যার অর্থ তাঁদের অনেককেই অকৃতকার্য হওয়া সত্ত্বেও পাস নম্বর দেওয়া হয়েছে।

চীন, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামে জালিয়াতির এ প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব দেশে অপরাধীরা ফাঁস হওয়া পরীক্ষার কাগজপত্র অভিবাসীদের কাছে বিক্রি করেছে, যাতে পরীক্ষার্থীরা আগে থেকে উত্তর জানতে পারেন। এর অর্থ হলো শিক্ষার্থী, এনএইচএস কর্মী ও ইংরেজিতে দুর্বল জ্ঞানসম্পন্ন অন্য অভিবাসীদের পড়াশোনা বা কাজের জন্য ভিসা দেওয়া হয়েছে, যার জন্য তাঁদের পূর্ণ যোগ্যতা নেই।

ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ ইউনিয়ন জানায়, বিদেশি শিক্ষার্থীরা বেশি টিউশন ফি দেওয়ায় কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের দুর্বল ইংরেজি দক্ষতাকে উপেক্ষা করছে। কিছু প্রভাষক অভিযোগ করেছেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রায় ৭০ শতাংশেরই ইংরেজি জ্ঞানের পর্যাপ্ত দক্ষতা নেই।

বিরোধী কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে যে যাঁরা এই পরীক্ষায় পাস না করেই ব্রিটেনে এসেছেন, তাঁদের যেন দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ৩৬ লাখ মানুষ ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্টিং সিস্টেম (আইইএলটিএস) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এই পরীক্ষার যৌথ মালিকানায় রয়েছে ব্রিটিশ কাউন্সিল, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্ট ও শিক্ষামূলক সংস্থা আইডিপি।

২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ পরীক্ষায় ভুল স্কোর বা ফলাফল পেয়েছেন। আইইএলটিএস এর জন্য ‘একটি কারিগরি ত্রুটিকে’ দায়ী করেছে, যা ‘কিছু আইইএলটিএস একাডেমিক এবং জেনারেল ট্রেনিং পরীক্ষার লিসেনিং এবং রিডিং অংশে সামান্য উপাদানের ওপর প্রভাব ফেলেছিল’। সংস্থাটি জানিয়েছে, পরীক্ষার মাত্র প্রায় ১ শতাংশ এতে প্রভাবিত হয়েছিল। তবে এই সংখ্যাও প্রায় ৭৮ হাজার পরীক্ষার্থীর সমান হবে।

আইএলটিএস পরীক্ষা নেওয়া সংস্থা এক বিবৃতিতে বলেছে, সমস্যাটি মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ধরা পড়েছে। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্তের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে গত মাসে যোগাযোগ করা হয়েছে তাঁদের সঠিক পরীক্ষার ফল দিতে এবং আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থনা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন
আমরা তাঁদের সঠিক ফল প্রদান করেছি। আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেছি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করেছি
ক্ষতিগ্রস্ত পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রসঙ্গে আইইএলটিএসের একজন মুখপাত্র

এটা বোঝা যাচ্ছে যে কিছু লোকের পরীক্ষার নম্বর তাঁদের যা হওয়া উচিত ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল, আবার কিছু লোকের কম ছিল। সমস্যাটি এত দেরিতে শনাক্ত হওয়ায় যাঁদের ভুলভাবে পাস দেখানো হয়েছিল, তাঁদের অনেকেই সেই ফল ব্যবহার করে ভিসা পেতে এবং আইনগতভাবে ব্রিটেনে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন।

গত বছর ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ ইউনিয়ন জানায়, বিদেশি শিক্ষার্থীরা বেশি টিউশন ফি দেওয়ায় কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের দুর্বল ইংরেজি দক্ষতাকে উপেক্ষা করছে। একই সঙ্গে কিছু প্রভাষক অভিযোগ করেছেন যে বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রায় ৭০ শতাংশেরই ইংরেজি জ্ঞানের পর্যাপ্ত দক্ষতা নেই।

আরও পড়ুন

ঝুঁকিতে এনএইচএস রোগীরা

তদন্তকারী কর্মকর্তারাও সতর্ক করেছেন যে এনএইচএস এবং সমাজসেবামূলক কাজে নিয়োজিত বহু মানুষের ইংরেজি জ্ঞান অপর্যাপ্ত, যা রোগীদের ঝুঁকিতে ফেলছে এবং কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণও হচ্ছে।

আরও পড়ুন
গত বছর ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ ইউনিয়ন জানায়, বিদেশি শিক্ষার্থীরা বেশি টিউশন ফি দেওয়ায় কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের দুর্বল ইংরেজি দক্ষতাকে উপেক্ষা করছে।
ফাইল ছবি

একটি ঘটনায় দেখা গেছে, একজন কেয়ার কর্মী কখনো ইংরেজি পরীক্ষা দেননি। ওই তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, ওই কর্মী ৯৯৯ কল হ্যান্ডলারের সঙ্গে কথা বলার সময় ‘ব্রিদিং’ (শ্বাসপ্রশ্বাস) ও ‘ব্লিডিং’ (রক্তক্ষরণ)—এই দুই শব্দের পার্থক্য বুঝতে পারেননি। একইভাবে ‘অ্যালার্ট’ ও ‘অ্যালাইভ’ শব্দের পার্থক্যও তিনি ধরতে পারেননি। এ ধরনের ভুল–বোঝাবুঝি জরুরি পরিস্থিতিতে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

ব্রিটিশ ছায়া মন্ত্রী ক্রিস ফিলপ বলেছেন, ‘ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে প্রায় ১০ লাখ মানুষ ভালোভাবে ইংরেজি বলতে পারেন না, কেউ কেউ একেবারেই পারেন না। আমরা আগেই একধরনের সমন্বয় সংকটে ভুগছি, আর এখন জানা যাচ্ছে যে প্রায় ৭৮ হাজার মানুষ ভাষা পরীক্ষার ভুল ফল পাওয়ার পর ভিসা পেয়েছেন। যাঁরা অনুচিতভাবে ভিসা পেয়েছেন, তাঁদের দেশে ফেরত পাঠাতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘মানুষ এখানে এসে যদি কখনো ইংরেজি না শেখেন, তাহলে তাঁরা সমাজে মিশতে পারেন না এবং রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর না করে স্বতন্ত্রভাবে জীবন গড়ে তুলতেও পারেন না। এটি একটি ভয়াবহ ব্যর্থতা।’

এ ছাড়া আলাদাভাবে জানানো হয়েছে, কিছু মানুষ অপরাধীদের টাকা দিয়ে আগেই পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কিনে আইইএলটিএস পরীক্ষায় জালিয়াতি করেছেন।

বাংলাদেশের পুলিশ এমন দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁরা ঘুষের মাধ্যমে পাওয়া আইইএলটিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের অগ্রিম কপির জন্য মানুষের কাছ থেকে এক হাজার থেকে আড়াই হাজার পাউন্ড পর্যন্ত অর্থ নিচ্ছিলেন। ভিয়েতনামে গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ কাউন্সিল শেষ মুহূর্তে একটি নির্ধারিত পরীক্ষা বাতিল করে একটি ‘ব্যাকআপ’ সংস্করণে পরিবর্তন করেছিল, ফলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের জল্পনার সৃষ্টি হয়। ওই সময়ে ব্রিটিশ কাউন্সিল স্বীকার করেছিল, ফাঁস হওয়া পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রির চেষ্টা বেড়েছে। এ ছাড়া চীনেও জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এদিকে যুক্তরাজ্যের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে। কারণ, ভিসা ব্যবস্থার দুর্নীতি সম্পর্কে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

স্বতন্ত্র পার্লামেন্ট সদস্য রুপার্ট লো গত পাঁচ বছরে ইউকে ভিসা ও ইমিগ্রেশন কর্তৃক কতগুলো জাল আইইএলটিএস সার্টিফিকেট চিহ্নিত করা হয়েছে, সেই বিষয়ে হোম অফিসের (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) কাছে জবাব চেয়েছেন। তবে তাঁকে জানানো হয়েছে, এ তথ্য খুঁজে বের করার খরচ ‘অনেক বেশি’ হবে।

ব্রিটিশ কাউন্সিল মূলত তার বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে স্ব-অর্থায়ন করে থাকে। এসব উদ্যোগের মধ্যে পরীক্ষা নেওয়াও অন্তর্ভুক্ত। তবে এটি পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে করদাতাদের অর্থায়নের অনুদানও পেয়ে থাকে।

কোভিড-১৯–এর সময়ে নেওয়া একটি সরকারি ঋণ বাবদ ব্রিটিশ কাউন্সিলের ১৯৭ মিলিয়ন পাউন্ডের ঋণ রয়েছে, যা পরিশোধ করতে তারা হিমশিম খাচ্ছে। পরীক্ষার ফলাফলের ত্রুটির কারণে যদি কোনো ক্ষতিপূরণের দাবি ওঠে, তবে তা সংস্থাটির আর্থিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে তুলবে।

ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে প্রায় ১০ লাখ মানুষ ভালোভাবে ইংরেজি বলতে পারেন না, কেউ কেউ একেবারেই পারেন না। এখন জানা যাচ্ছে, প্রায় ৭৮ হাজার মানুষ ভাষা পরীক্ষার ভুল ফল পেয়ে ভিসা পেয়েছেন।
ব্রিটিশ ছায়া মন্ত্রী ক্রিস ফিলপ
আরও পড়ুন

এদিকে স্বরাষ্ট্র দপ্তর ইংরেজি পরীক্ষাব্যবস্থার জন্য ৮১৬ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের একটি নতুন পাঁচ বছরের চুক্তি করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলকে এ চুক্তির জন্য দরদাম করার সময় অন্য কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে।

আইইএলটিএসের একজন মুখপাত্র টেলিগ্রাফকে বলেন, আইইএলটিএস সম্প্রতি এমন একটি সমস্যা শনাক্ত করেছে, এ কারণে বিশ্বব্যাপী অল্পসংখ্যক পরীক্ষার্থী ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভুল ফলাফল পেয়েছিলেন। এ সময়ের মধ্যে নেওয়া আইইএলটিএস পরীক্ষাগুলোর ৯৯ শতাংশের বেশি প্রভাব মুক্ত ছিল এবং বর্তমানে চলমান আইইএলটিএস পরীক্ষাগুলোতে আর কোনো সমস্যা নেই।

ক্ষতিগ্রস্ত পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে জানিয়ে ওই মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা তাঁদের সঠিক ফল প্রদান করেছি। আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেছি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করেছি। আমরা সব সংশ্লিষ্ট অংশীদার এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা যে আইইএলটিএস পরীক্ষা পরিচালনা করি, তার সততা রক্ষা করার জন্য আমাদের কঠোর মান নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি রয়েছে এবং ভবিষ্যতে যাতে এ সমস্যার পুনরাবৃত্তি না হয়, এর জন্য আমরা সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।’

আরও পড়ুন