একেকজন এগিয়ে যাচ্ছেন আর লাফিয়ে পড়ছেন সাগরের হিমশীতল পানিতে

সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন অষ্টাদশ পর্ব

অ্যান্টার্কটিকার হিমশীতল পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছেন এক অভিযাত্রী
ছবি: সংগৃহীত

সকালের নাশতা সেরে কেবিনে প্রবেশ করেই থতমত খেলাম। আমার কেবিন-বন্ধু নাসতা বিকিনি পরে ওয়াশরুম থেকে কেবলই বেরিয়েছে। বিব্রত হয়ে দৃষ্টি সরালেও নাসতা কক্ষের সর্বত্র বিরাজমান। আমার ডানে কেবিনের দেয়ালজুড়ে বৃহৎ আয়না। নাসতা সেখানে বিরাজমান। আমার বাঁ দিকের দেয়ালে ড্রেসিং টেবিল, সে আয়নাতেও নাসতাকে দেখা যাচ্ছে। নাসতা নির্বিকার তাগাদা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, তুমি এখনো তৈরি হওনি মহুয়া। আজ তো পোলার প্লাঞ্জ।

পোলার প্লাঞ্জ মানে বরফগলা হিমশীতল পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার আয়োজন। অ্যান্টার্কটিকার হিমশীতল পানিতে ঝাঁপ দেবেন অভিযাত্রীরা।

নাসতাকে জিজ্ঞেস করলাম, বিকিনিই পরতে হবে?

অবশ্যই, তোমার শরীর যদি হিমপানিতে না-ই মেশে, তবে আর এই ইভেন্টে অংশগ্রহণ করার মাহাত্ম্য কী!

নাসতা একটু দম নিয়ে এবার একবারে ইতিহাস বলতে থাকল, ‘আমি যেহেতু রুশ, এটি আমার জন্য কঠিন কিছু না। ছোটবেলা থেকেই আমাদের হিম পানিতে নামার অভ্যাস, এটি আমাদের একটি রেওয়াজ। এর মাধ্যমে আমরা পরিশুদ্ধ হই। আমাদের বিশ্বাস, এটা করলে সারা বছর আমরা সুস্বাস্থ্য পাব। এটিকে বলা হয়, আইস বাথ বা বরফ গোসল।’

আরও পড়ুন

নাসতা শরীরে একটি সাদা রঙের গাউন চাপিয়ে খালি পায়ে কেবিন থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল। জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজের দ্বিতীয় তলার একপাশ থেকে জাহাজেরই একটি অংশ প্রসারিত হয়ে সিঁড়ির মতো কিছু একটা হয়েছে। সেখানেই জটলা করছেন কয়েক ডজন অর্ধনগ্ন নারী-পুরুষ। জাহাজের ডেক অভিযাত্রীতে ঠাসাঠাসি। তাঁরা দেখছেন। সবার আগে বিকিনি পরে দাঁড়িয়ে গেলেন অভিযাত্রী দলের বয়স্ক নারী লাইসা, তিনি সবকিছুতেই প্রথম। দুজন গাইড একটি দড়ির মতো কিছু একটা নিয়েছে। সেটি বাঁধা হলো লাইসার কোমরে। লাইসা পানিতে ঝাঁপ দিলেন। দ্রুত ভেসে উঠে কয়েক সেকেন্ড সাঁতারও কাটলেন। অন্যরা করতালি আর শিস বাজিয়ে উৎসাহিত করলেন তাঁকে। জাহাজের কাছে একটি জোডিয়াক দড়িতে বাঁধা। সেখানে দাঁড়িয়ে জাহাজের ফটোগ্রাফার। তাঁর হাতে হরেক রকম ক্যামেরা। তিনি আকাশে ছেড়েছেন ড্রোন। মনে হচ্ছে উৎসব চলছে। একেকজন এগিয়ে যাচ্ছেন আর কোমরে দড়ি বেঁধে লাফিয়ে পড়ছেন সাগরে। ৩০–৩৫ জনের মতো অভিযাত্রী অ্যান্টার্কটিকার পানিতে ঝাঁপ দিয়েছেন। আমাদের অভিযাত্রী দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য রুশ মেয়ে অ্যান্টার্কটিকায় সাঁতার কেটে আমাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সারা জীবন বড়াই করে বলতে পারবে অ্যান্টার্কটিকায় সাঁতার কেটেছে।

আরও পড়ুন
জোডিয়াক অপারেশনে অভিযাত্রীরা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

জোডিয়াক প্রবেশ করেছে পাশাপাশি আইসবার্গের মাঝখানে

উৎসব শেষ হতে না হতেই আরেকটি অপারেশনের ঘোষণা এল। সেটি জোডিয়াক অপারেশন। দুপুরের আগেই। জোডিয়াক যাবে সিয়েরভা কোভে। এই খাঁড়ি স্প্যানিশ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও পাইলট সিয়েরভার নামে রাখা হয়েছে। এত দিনে জোডিয়াক ভ্রমণে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তিমি এবং হিমবাহ দেখার জুতসই সুযোগ মেলে জোডিয়াক অপারেশনে। বাহ, সিয়েরভা কোভে সকালেই দেখা হয়ে গেল মিঙ্কি তিমির সঙ্গে! নিজেকে খুব কাছ থেকে দেখানোর জন্য সে যেন খুব উদ্‌গ্রীব। লেজ আর পিঠ দেখিয়ে বিদায় নিল। মিঙ্কি তিমি চেনা খুব সহজ। তাদের চিবুক অনেক দীর্ঘ, একেবারে গলা থেকে বুক পর্যন্ত ত্বক গাঢ় বাদামি, সুন্দর পেট। নীল তিমির মতো দীর্ঘকায় নয় বলে সেগুলোর কপালে বামন উপাধি জুটেছে। ওমা, এ কী! আরও সামান্য এগোতেই কয়েকটি হাম্পব্যাক তিমি। ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন আজ! গাইড জোডিয়াক ছাড়ার সময় বলছিলেন, এখানে তিমি বেশি।

পাশাপাশি দুটি আইসবার্গের মাঝখানে প্রবেশ করেছে আমাদের জোডিয়াক। প্রবেশের পর মনে হলো, আইসবার্গের একাংশ ভেঙে আলাদা হয়েছে, তাতে যে জায়গা তৈরি হয়েছে, আমরা তারই মাঝখানে। আমার কল্পনা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এক দশক আগে। কাতারের দোহায় কয়েক সহস্র পরিবেশবিজ্ঞানী, পরিবেশকর্মী, গবেষক বসে আছেন কপ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। মঞ্চে উপবিষ্ট জাতিসংঘের কর্মকর্তা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন তাঁর বক্তৃতায় অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে যাওয়া নিয়ে। তিনি বলছিলেন নাটকীয় হারে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে অ্যান্টার্কটিকায়। আইসবার্গের আকার ও কাঠামো দেখে আমার কাছেও তা স্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন, অ্যান্টার্কটিকা পেনিনসুলার অধিকাংশ জায়গা প্রায় বরফমুক্ত হয়ে গেছে। তাই তো দেখছি এই কয়টা দিন। বেশ কিছু পাহাড়ে বরফ গলে পাথুরে মাথা স্পষ্ট। অনন্য আইসবার্গের রং, সৌন্দর্য এবং বিশালতা আমাকে যেমন মুগ্ধ করছে, তেমনি ক্ষতও তৈরি করছে।

আরও পড়ুন
মিকেলসেন হারবার
ছবি: সংগৃহীত

বরফ গলছে

বরফের ওপর দিয়ে চলছে আমাদের জোডিয়াক, তাতে ঘর্ঘর শব্দ হচ্ছে। দুপাশে দুটি বরফের তাক। বরফের তাক হলো ভাসমান বরফের ওপরের অংশ। অ্যান্টার্কটিকার বরফের বৃহৎ তাকগুলোর মধ্যে একটির নাম ফিলচনার–রনে; আয়তনে যেটি বাংলাদেশের প্রায় তিন গুণ বড়। উষ্ণায়নের ফলে বরফের তাক গলতে শুরু করে, দুর্বল হয়। আমি যে আইসবার্গ ঘেঁষে যাচ্ছি, সেটি যে উষ্ণায়নের ফলে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, তা স্পষ্ট। আইপিসিসি (ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) বলছে, অ্যান্টার্কটিকায় ১৯৫০–এর দশক থেকে ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার বরফের তাক নষ্ট হয়েছে। সমুদ্রে বরফের নাটকীয় হ্রাস এখানকার প্রজাতিকুলের জন্য হুমকি। পানির ওপরে দৃশ্যমান আইসবার্গ সমগ্র আইসবার্গের একটি ভগ্নাংশমাত্র। মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য যেমন আমরা দেখতে পারি না, এই বরফ তাকের পানিতে নিমজ্জিত অংশও অদেখা।

জাহাজে ফিরে দুপুরের খাবার খেলাম। শরীর ক্লান্ত। আজ তিনটি অপারেশন। দুপুরে খাওয়ার পরপর ছুটলাম তৃতীয় অপারেশনে মিকেলসেন হারবারে। এই পোতাশ্রয় সুইডিশ অভিযাত্রীদের আবিষ্কার। মিকেলসেন শব্দটি পেডার মিশেলসেন নামে একজন তিমি শিকার ব্যবস্থাপকের নাম থেকে নেওয়া। তিমি শিকার করতে এসে এই উপসাগরে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

জোডিয়াক থেকে নামার পর আমি বরফে আচ্ছাদিত একটি বৃহৎ পর্বত ছাড়া কিছুই দেখছি না। পাহাড়ের পাদদেশে পড়ে আছে তিমির একটি কঙ্কাল। বেশ শুকিয়ে গেছে। হাড়ের সঙ্গে কোনো মাংস অবশিষ্ট নেই। তবু একঝাঁক জেনটু পেঙ্গুইন সে হাড় চাটাচাটিতে ব্যস্ত। কঙ্কালের পাশ দিয়ে হেঁটে বরফাবৃত পাহাড়ে উঠছি। শরীর ক্লান্ত তাই পদক্ষেপ ধীর। দেখছি, প্রায় সব উপকূলই প্রাচীন তিমির হাড় দ্বারা আবৃত।

জেনটু পেঙ্গুইনের সংখ্যাধিক্য বলে দিচ্ছে এটি পেঙ্গুইন কলোনি। দুটি ওয়েডেল সিল ঘুমিয়ে আছে। শত পর্যটকের পদযাত্রায়ও তাদের ঘুম ভাঙে না। দ্বীপের চূড়ায় অবতরণ করতেই আরও চারটি ওয়েডেল সিল। দুটি সিল মুখোমুখি বসে। ক্ষণে ক্ষণে দুজন দুজনকে আলিঙ্গন আর চুম্বনে মত্ত। ভিডিও করলাম খানিকক্ষণ। ম্যারাথন চুম্বনালিঙ্গন। অভিযাত্রীরা ক্যামেরা তাক করছেন সে দৃশ্য ধরতে, তাতে তাদের কিছুই যায় আসছে না, ওরা দ্বিধাহীন।

আরও পড়ুন

১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?

২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা

৩. ‘তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো’

৪. আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি

৫. অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে খেতে দিল রুটি আর বেগুন ভাজি

৬. অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম সন্তান প্রসব করেছিলেন যে নারী

৭. সাগরের পানিকে কেন বলা হতো কালাপানি

৮. অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে জাহাজ থেকে অভিযাত্রীদের যেভাবে নামতে হয়

৯. অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছে অভিযাত্রীদের মধ্যে আমিই প্রথম জাহাজ থেকে নামলাম

১০. দ্বীপটিতে পেঙ্গুইন ছাড়া আর কিছু নেই

১১. তিনটি তিমি আমাদের ঘিরে ধরল

১২. অ্যান্টার্কটিকায় যেভাবে উদ্‌যাপিত হলো জন্মদিন

১৩. পৃথিবীর সবচেয়ে দূরের ডাকঘর থেকে দুই ছেলেকে চিঠি পাঠালাম

১৪. মাসে মাত্র ১০০ শব্দের বার্তা পাঠাতে পারতেন তাঁরা, এতেই হতো যোগাযোগ

১৫. নদীপারের মেয়ে আমি কিন্তু বইঠা হাতে নিয়েছি আজই প্রথম

১৬. রূপপুরে কাজ করতে আসবে রাশিয়ার ওলগা, তাঁর সঙ্গে দেখা অ্যান্টার্কটিকায়

১৭. কবরের মতো বরফ খুঁড়ে সেখানেই থাকতে হয় রাতভর