ধীরে চলা

১৭ 

তাঁর নামের বানানে অক্ষরের ওপরে একটা ছোট্ট ভি-এর মতো চিহ্ন দেখতে না পাওয়ায় তিনি বিষাদগ্রস্ত হলেন। এটা না হয় বোঝা গেল; কিন্তু গৌরব তিনি কোত্থেকে পাচ্ছেন?

এটা তাঁর জীবনবৃত্তান্তের একটা অনিবার্য উপাদান। রাশিয়ানরা তাঁদের দেশে ১৯৬৮ সালে আগ্রাসন চালায়, তার এক বছর পর তাঁকে পতঙ্গবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর তিনি নির্মাণশ্রমিকের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন, এটা চলে ১৯৮৯ সালে রাশিয়ান দখলদারির অবসান না হওয়া পর্যন্ত, প্রায় কুড়িটি বছর। জীবন গিয়েছে চলে তাঁর, কুড়ি কুড়ি বছরের পার।
কিন্তু চাকরি কি একা তাঁর গেছে? এমনকি নয় যে আমেরিকায়, ফ্রান্সে, স্পেনে হাজার হাজার মানুষ চাকরি হারায়নি? তারা সবাই কষ্ট করেছে, কিন্তু এই নিয়ে তাদের তো কোনো গৌরববোধ নেই। তাহলে কেন এই চেক বিজ্ঞানী গৌরবান্বিত? কেন অন্যেরা নয়?
কারণ তিনি তাঁর চাকরি অর্থনৈতিক কারণে হারাননি, হারিয়েছিলেন রাজনৈতিক কারণে।
ভালো কথা! কিন্তু কেন অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কারও জীবনে দুর্ভাগ্য নেমে এলে সেটাকে কম গুরুত্বপূর্ণ কিংবা কম মহৎ বলে গণ্য করা হবে?
একজন মানুষের বস তাকে দেখতে পারে না বলে সে চাকরি হারিয়েছে, সেটা হলো লজ্জার, আরেকটা মানুষ রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে চাকরি হারিয়েছে, সেটা কেন ভীষণ কৃতিত্বের ব্যাপার হবে? এটার ব্যাখ্যা কী? কেন এমনটা হবে?
কারণ যখন কেউ অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বরখাস্ত হয়, চাকরি হারানোর ব্যাপারে তখন তার ভূমিকা থাকে নিষ্ক্রিয়, তার কোনো একটা সাহসী অবস্থান নেই যাকে আমরা প্রশংসা করতে পারি।
এটা অবশ্যই একটা চোখে পড়ার মতো বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমরা এটার কথা বলছি না। ১৯৬৮ সালে, যখন রাশিয়ানরা এল, একটা ঘৃণ্য শাসন কায়েম করল, তখন এই চেক বিজ্ঞানী এমন কোনো কাজ করেননি, যা তাঁর সাহসের পরিচয় বহন করেছিল; বরং ঘটেছিল উল্টোটা। তিনি নিজে ব্যস্ত ছিলেন মাছি নিয়ে গবেষণায়। তিনি ছিলেন ইনস্টিটিউটের প্রধান। একদিন এক ডজন কুখ্যাত বিরোধী মতাবলম্বী লোক কোনো সংকেত না দিয়েই তার ঘরে ঢুকে পড়ল। তারা দাবি করল, তাদের একটা রুম চাই, তাতে তারা গোপন বৈঠক করবে মাঝেমধ্যে। তারা নিজেরা এই ঘটনার কতগুলো দর্শকও এরই মধ্যে তৈরি করে ফেলেছে। তারা তাকে একটা নৈতিক দ্বন্দ্বযুদ্ধের মধ্যে ফেলে দিল। এখন যদি তিনি ‘হ্যাঁ’ বলেন, তাহলে তিনি তাঁর চাকরি হারাতে পারেন, তার তিন সন্তানের বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর এই হঠাৎ করে এসে পড়া একদল বিদ্রোহীকে ‘না’ বলার মতো সাহসও তার ছিল না। এরা এরই মধ্যে তাকে কাপুরুষ বলে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। তিনি ‘হ্যাঁ’ বললেন, তাতে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রমাণিত হলো যে তাঁর সাহস নেই, পরিস্থিতি বিরূপ হলে তা সামলানোর কোনো যোগ্যতা তাঁর নেই, সুতরাং তাঁর চাকরি গেল, তাঁর সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হলো। সেটা তাঁর সাহসের জন্য হলো না। হলো তার ভীরুতার জন্য। কাপুরুষতার জন্য।
তা-ই যদি হবে, তাহলে এই লোক কেন নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছে? কেন?
যতই দিন যেতে লাগল, তিনি যে ‘হ্যাঁ’ বলেছিলেন, সেটাকে তিনি কোনো ভীরুতার ফসল বলে গণ্য করা ভুলে যেতে লাগলেন, তাঁর মনে হতে লাগল, ওই ঘৃণ্য শাসনের বিরুদ্ধে এটা ছিল তাঁর সচেতন সাহসিকতাপূর্ণ বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত, তিনি মোটেই চাপে পড়ে ‘হ্যাঁ’ বলেননি, তিনি সচেতনভাবে ‘হ্যাঁ’ বলাটাকেই বেছে নিয়েছিলেন। এটা ছিল তাঁর নিজস্ব বিদ্রোহ। এভাবে তিনি ইতিহাসের মঞ্চে নিজেকে আরোহিত করলেন। এই কারণে তিনি গৌরব বোধ করেন।
এটা কি তবে সত্য নয়, যে অগণন মানুষ অগণিত রাজনৈতিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে, তারা ইতিহাসের মঞ্চে আরোহণ করে গৌরববোধ করতে পারে?

আমাকে আমার থিসিস একটু পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে। এই বিজ্ঞানীর গর্বটা এই কারণে যে ইতিহাসের মঞ্চে যখন আলো পড়েছে, ঠিক সেই সঠিক সময়ে তিনি সঠিক কাজটি করতে পেরেছিলেন। এটা যেকোনো একটা সময়ে করলে হতো না। ইতিহাসের আলোকিত মঞ্চকে বলা হয় ‘ঐতিহাসিক বিশ্বসংবাদ সংগঠনের মুহূর্ত’। ১৯৬৮ সালের প্রাগ ছিল ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক আর ফ্লাডলাইটের আলোয় ভেসে যাওয়া, এটা ছিল সবদিক থেকেই যথাযথ ‘ঐতিহাসিক বিশ্বসংবাদ সংগঠনের মুহূর্ত’, আর আমাদের এই বিজ্ঞানী ইতিহাসের এই চুম্বনের স্পর্শ নিজের ভ্রুতে অনুভব করেন।

কোনো একটা বাণিজ্যিক চুক্তির মুহূর্ত কিংবা শীর্ষ সম্মেলনও ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে আর আলোয় ঝলসিত থাকে, সেখানে যাঁরা উপস্থিত থাকেন, তাঁরা তো গর্ব অনুভব করেন না?

আমি তাড়াতাড়ি করে চূড়ান্ত পার্থক্যটা বলে নিই। এই চেক বিজ্ঞানী বিশ্বের ঐতিহাসিক সংবাদ-মুহূর্তের হঠাৎ করে আসা কোনো স্পর্শে আলোড়িত নন, বরং তাকে মহিমান্বিত করেছে ইতিহাসের গরিমা। গরিমার মহিমা তখনই আসে, যখন মঞ্চে একজন মানুষ যাতনা ভোগ করে, তার পেছনে বন্দুকের গুলির আওয়াজ ফুটতে থাকে, মাথার ওপর দিয়ে উড়তে থাকে মৃত্যুদূত আজরাইল।

তাহলে পুরো ব্যাপারটা এই দাঁড়াল যে এই চেক বিজ্ঞানী গৌরব করছেন কারণ তাঁকে স্পর্শ করেছিল মহান ‘ঐতিহাসিক বিশ্বসংবাদ সংগঠনের মুহূর্তের’ গরিমা। তাই তিনি নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন, মনে করেন যে এই কনফারেন্সে উপস্থিত ফরাসি, ড্যানিশ, নরওয়েজিয়ানের চেয়ে তিনি আলাদা।

[প্রিয় পাঠক, আপনাদের অনুবাদক বলছি। আপনারা যাঁরা মিলান কুন্ডেরার ‘স্লোনেস’ উপন্যাসটির এই অনুবাদ পাঠ করছেন, তাঁদের মনে আছে, এই বইটিই অনুবাদ করার পেছনে আমার প্রেরণা ছিল এটা অনুধাবন করা যে উপন্যাস অনেক প্রকার। সেই কথাটিই আমি আপনাদের আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিই। দেখুন, আমাদের গল্প কোত্থেকে কোথায় গেছে। আমরা শুরু করেছিলাম, স্ত্রী ভেরাকে নিয়ে এই কাহিনির কথক প্যারিসের বাইরে গাড়ি করে যাচ্ছেন। তারপর সেই প্রসঙ্গ আমরা ভুলে যাই। জীবনের গতি আর ধীরতা বিষয়ে কুন্ডেরার লেকচার শুনতে আরম্ভ করি। দুটো উপন্যাস নিয়ে তিনি আলোচনা করেন। সেসব উপন্যাসের কাহিনি পরিবেশিত হয়। তা নিয়ে কুন্ডেরা ব্যাখ্যাও আমরা শুনতে থাকি। এক ঝলকের জন্য সেই আদি নায়ক এবং ভেরা হোটেলের রুমে আসে। তারা টেলিভিশনে আফ্রিকার শিশুদের অনাহারে মৃত্যুর খবর দেখে। এরপর আবার এই বিষয়গুলো নিয়ে নানা আলোচনা আমরা শুনি। বার্কের কথা আমরা একটু শুনেছিলাম। বার্ক গেছেন একটা কীটপতঙ্গবিষয়ক সেমিনারে। সেই সেমিনারে আমরা পেয়ে গেলাম এক চেক বিজ্ঞানীকে। এবার চেকোস্লাভাকিয়ায় সোভিয়েত আগ্রাসন কত খারাপ ছিল, সে বিষয়ে কথা শুনছি। আশা করি, এরপরের অধ্যায়ে হয়তো বার্ককে আমরা পাব]
(চলবে)

আরও পড়ুন: