মৃদুল মধুর সন্তরণ
থুসিডিডিসের কলমে পেলোপোনেসীয় যুদ্ধের ইতিহাস
জীবন এত ছোট কেন? এই আক্ষেপ নেই, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। অথচ জীবন উপভোগের উপকরণ কত বিপুল! জানার–বোঝার, দেখার–শোনার, পড়ার–সক্ষমতার অপরিসীম সীমাবদ্ধতা নিয়েই বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে জি এইচ হাবীব -এর নিয়মিত পাক্ষিক— মৃদুল মধুর সন্তরণ
সমালোচনামূলক ইতিহাসের জনক থুসিডিডিস সম্পর্কে যা কিছু জানা যায়, তার সবকিছু তিনি নিজেই বলে গেছেন আমাদের; তবে তা নেহাতই অল্প। খুবই অবাক করা বিষয় হলো, যেসব গ্রিক মনীষী অমরত্ব লাভ করেছেন, তাঁদের মধ্যে থুসিডিডিসের অসংখ্য অনুকরণকারী থাকলেও জীবনীকার নেই একজনও।
এই বিখ্যাত এথেনীয়র জন্ম ৪৭০ থেকে ৪৬০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে, সাহিত্য, শিল্প আর চিন্তার স্বর্ণযুগে—ইস্কিলাস, সফোক্লিস, ইউরিপিডিস, অ্যারিস্টোফেনিস, হেরোডোটাস আর সক্রেটিসের শতাব্দীতে। কিন্তু তারপরেও, যে বইটি থুসিডিডিসকে গ্রিক বিদ্বজ্জনদের প্যান্থিয়নে চিরস্থায়ী আসনে বসিয়েছে, সেই ‘পেলোপোনেসীয় যুদ্ধের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে তাঁর এই মহৎ সমসাময়িকদের কারও উল্লেখ নেই। কারণ, থুসিডিডিস নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্বের বর্ণনা দেওয়ার কাজে, যে নগররাষ্ট্রগুলো আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে অনেকটাই ছোট। লন্ডনের অসংখ্য শহরতলির কোনোটির চেয়ে বড় হবে না, এমন অল্প কিছু নগরের ভাগ্য ও নেতার দিকেই তিনি পুরোপুরি মনোনিবেশ করেছিলেন।
৪৩১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পেলোপোনেসীয় যুদ্ধের দামামা যখন বেজে ওঠে, থুসিডিডিসের বয়স তখন তিরিশের কোঠায়। যুদ্ধে দুই পক্ষের একটিতে ছিল এথেন্স ও তাঁর মিত্রবাহিনী, অন্য পক্ষে স্পার্টার নেতৃত্বাধীন জোট। সাতাশ বছর স্থায়ী এই দীর্ঘ যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে এক প্রবল মহামারিতে এথেন্স বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু রোগটি যে ঠিক কী ছিল, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। যক্ষ্মা ও টাইফয়েডের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয় বেশি। থুসিডিডিস নিজেও তার শিকার হন; যক্ষ্মাই হয়েছিল তাঁর খুব সম্ভবত। তবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং ৪২৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তাঁকে একটি এথেনীয় নৌবহরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে নৌ সমরকৌশলে তিনি ব্যর্থতার পরিচয় দেন। স্পার্টান ব্রাসিডাসের হাতে পরাজয় ঘটে তাঁর নৌবহরের। বিফলতার দায়ে তাঁকে এথেন্সে ফিরিয়ে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় এবং নির্বাসনে পাঠানো হয়। এই নির্বাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে ৪০৪ খ্রিষ্টপূ্র্বাব্দে, এথেন্সের চূড়ান্ত পরাজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ও ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠার পর।
বিশ বছর স্থায়ী নির্বাসনের সময়ে তিনি ইতিহাস রচনার রসদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পেলোপোনেসীয় যুদ্ধে লিপ্ত বিভিন্ন নগররাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। আটটি খণ্ডে বিভক্ত তাঁর বইটি ৪১১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এসে থেমেছে, যুদ্ধটি শেষ হওয়ার সাত–আট বছর আগে। অনুমান করা হয়, সহিংসভাবে তাঁর জীবনে ছেদ পড়েছিল, কারণ একটা অনুচ্ছেদের মাঝখানে এসে, হঠাৎ করে শেষ হয়েছে লেখাটি। থুসিডিডিসের ‘ইতিহাস’কে ঠিক স্রেফ যুদ্ধের কালানুক্রমিক বর্ণনা বলা যায় না: এটা সে সময়ের একটি রাজনৈতিক হ্যান্ডবুকও বটে, যেখানে গণতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের গুণাগুণ নিয়ে সারগর্ভ আলোচনা আছে, আছে যেকোনো যুগেরই বড় বড় সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন নেতার মুখে বসানো বক্তৃতা: যুদ্ধ কখন ন্যায্য বা সংগত? আপসকৃত শান্তি এবং বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ, এই দুইয়ের মধ্যে কোনটি বেহতর?
একবিংশ শতকের মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা, আমাদের সময়কার বড় বড় সমস্যা বা বিতর্কের ক্ষেত্রে এসব আলোচনার অনেকগুলোরই প্রাসঙ্গিকতা বা উপযোগিতা লক্ষ না করে পারবেন না। থুসিডিডিস যেন গল্পকে এখতিয়ার দিয়ে দেন নিজে নিজে বলে চলার এবং ঘটনা লিপিবদ্ধ করেই তিনি সন্তুষ্ট, নিজের কোনো মন্তব্য ছাড়া। তারপর সেই সব ঘটনার নায়ক ও প্রতিনায়কদের আমাদের সামনে নিয়ে আসেন তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে অবস্থার বয়ান দেওয়ার জন্য। ঐতিহাসিক থুসিডিডিস নিজে কোনো মন্তব্য ঢুকিয়ে দেন না, তবে তাঁর মত তিনি সেই সব বক্তৃতার মাধ্যমেই করেন, যেগুলো সব একই ধরনে তিনি সন্নিবেশিত করেছেন। তাঁর কথা হলো, ‘একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে যা বলা দরকার বলে আমি মনে করেছি, সে কথাই আমি বক্তাদের দিয়ে বলিয়েছি।’
স্পার্টা ও এথেন্সের নেতৃত্বে গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলো এক বড় হানাদার পারস্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং দ্বিতীয় আগ্রাসনের (ম্যারাথনের যুদ্ধ, ৪৯০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) এক পর্যায়ে এথেন্স একাই লড়েছিল। সেই উদাহরণে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যরা সংঘবদ্ধ হয়ে শেষ অবধি ৪৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পারসিকদের তাড়িয়ে দেয়। বিপদ কেটে যাওয়ার পর স্পার্টা বিজয়ী জোট থেকে সরে যায় এবং এথেন্স সেটার নেতৃত্বে আসে, আর অবশ্যম্ভাবীভাবেই এথেনীয় সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। এথেনীয় অর্থনৈতিক শক্তির বাড়বাড়ন্তে অপেক্ষাকৃত বড় নগররাষ্ট্রগুলো অস্বস্তিতে পড়ে যায়, কারণ কারও কারও দৃষ্টিতে তা গোটা গ্রিক মূল ভূখণ্ডকে হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছিল। এই হুমকি দূর হয় স্পার্টা ও এথেন্সের মধ্যে ত্রিশ বছরের এক শান্তিচুক্তি সম্পাদনের ফলে। তখন মূল গ্রিক ভূখণ্ড সঙ্গীবিহীন হয়ে পড়ে এবং দ্বীপগুলোতে আর উপকূলীয় নগরগুলোর মধ্যে নিজের শক্তি বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করে।
ডিলীয় লিগের প্রধান হয়ে ওঠে এথেন্স (বেশ কিছু গ্রিক নগররাষ্ট্র—১৫০ থেকে ৩৩০টি—আরেকটি পারসিক আক্রমণের বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে ৪৭৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জোট বাঁধে, সেটাই ডিলীয় লিগ বা জোট (Delian League নামে পরিচিত), শপথ নেয় জোট থেকে বেরিয়ে না যাওয়ার। কোনো কোনো নগররাষ্ট্র জোট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু পরে এথেন্স তাদের বশীভূত করে। অধিকাংশ নগররাষ্ট্র লিগের কোষাগারে ধনসম্পদ জমা করত এবং তার পরিমাণটা ঠিক করত এথেন্স; কোষাগারে এথেন্সের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। শিগগিরই এথেন্স গ্রিসের ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে স্পার্টা ও প্রাচীন গ্রিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য।
পেলোপোনেসীয় নগররাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে করিন্থ, এথেন্সের ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধি ও গুরুত্বলাভের ঘটনায় দিনে দিনে বেশি করে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠতে শুরু করে। একটি পেলোপোনেসীয় জোটের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তারা স্পার্টার ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং অবশেষে জোটটি ৪৩১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এথেন্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
মোটের ওপর এটাই হচ্ছে থুসিডিডিস বর্ণিত ঘটনাবলির পটভূমি। যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য আর্জি জানানো করিন্থীয় প্রতিনিধি বা ডেলিগেটের মুখ দিয়ে থুসিডিডিস স্পার্টা ও এথেন্সের নীতি ও মানসিকতার বৈপরীত্য তুলে ধরেছেন:
‘এথেনীয়রা বিপ্লবী এবং তারা দ্রুত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে; আর আপনাদের যা কিছু আছে, তা রক্ষা করার ব্যাপারে আপনাদের একটা প্রতিভা আছে, তার সঙ্গে আছে উদ্ভাবনের ব্যাপারে নিদারুণ ঘাটতি; আপনারা কোনো কাজ করতে বাধ্য হলে কখনোই খুব বেশি দূর যেতে পারেন না। তারা তাদের সাধ্যাতিরিক্ত দুঃসাহসী এবং তাদের বিবেচনার চেয়ে বেশি বেপরোয়া; বিপদের মুখে তারা হাল ছেড়ে দেয় না; তারা চটপটে ও উদ্যোগী, আপনারা ধীরুজ; তারা কখনোই বাড়ি থাকে না, আপনারা কখনোই বাড়ি ছাড়েন না; তাদের যা আছে, তা বাড়াতে তারা বাড়ি ছাড়ে, আপনারা এই ভেবে ভয় পান যে নতুন উদ্যোগের ফলে আপনাদের যা আছে, তা আপনারা হারাতে পারেন; তারা কোনো কাজে সাফল্য অর্জনের পর একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যায় এবং কোনো বিপর্যয় হলে চট করে পিছু হঠে যায় না; স্বদেশের জন্য তারা কুণ্ঠাহীনভাবে নিজেদের শরীরপাত করে; তাদের বুদ্ধিমত্তা তারা দেশের প্রয়োজনে কাজে লাগানোর জন্য সংরক্ষণ করে। কাজেই জীবনভর তারা সমস্যা আর বিপদ মাথায় নিয়ে পরিশ্রম করে যায়, আনন্দ-উপভোগের অবসর ছাড়াই, সব সময়ই কিছু পাওয়ার লক্ষ্যে। এককথায়, এটা আসলেই বলা যায় যে এই দুনিয়ায় তারা নিজেরা বিশ্রাম নিতে বা কাউকে বিশ্রাম নিতে দেওয়ার জন্য আসেনি।
তো, এই হচ্ছে আপনাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এথেন্স। কিন্তু তারপরেও, আপনারা, লাসিডোমিনীয়রা, এখনো দেরি করছেন। আপনাদের নীতি হচ্ছে অন্যের প্রতি ন্যায্য আচরণ করা এবং অন্যের ক্ষতি না করে, নিজেদের স্বার্থরক্ষা করা, যাতে নিজেদের কোনো লোকসান না হয়। আপনারা এটা উপলব্ধি করেন না যে মানুষ ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে শান্তি অর্জন করে না; বরং তা করতে পারে এটা স্পষ্ট করে সবাইকে জানিয়ে দিয়ে যে তাদের ওপর অন্যায় করে কেউ পার পাবে না। এথেন্সের তুলনায় আপনাদের কাজের পদ্ধতি সেকেলে। শিল্পের ক্ষেত্রে যেমন, রাজনীতির ক্ষেত্রেও পুরোনোর ওপর নতুন রাজত্ব করে। শান্তির সময়ে রক্ষণশীল ও সনাতনী পদ্ধতি সবচেয়ে ভালো কাজে দেয়। কিন্তু নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে বাধ্য হলে নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। আর তাই ব্যাপারটা এমন ঘটেছে যে এথেন্সের বিপুল অভিজ্ঞতা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে তাকে আপনাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছে।’
যুদ্ধের কারণ এত বছর আগে যা ছিল, আশ্চর্যজনকভাবে তা বর্তমান একবিংশ শতকের কারণগুলোর অনুরূপ। এথেন্স যুদ্ধ চায়নি। চায়নি স্পার্টাও। কিন্তু পশ্চিমের উপনিবেশগুলোর আর এথেন্সের বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী করিন্থ দেখছিল সব দিক থেকেই তারা এথেন্সের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। কাজেই তারা উত্তেজনা তৈরির দিকে অগ্রসর হলো এবং উত্তেজনা ভয় ও অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। উল্লেখ্য, এই করিন্থের মাঝখানেই হলো পেলোপোনেস উপদ্বীপ আর গ্রিসের বাকি অংশ।
থুসিডিডিস যুদ্ধটির প্রয়োগ কৌশলগত দিক নিয়েও অত্যন্ত কৌতূহলী ছিলেন। যেমন সনাতনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে স্থলভূমির যুদ্ধের সীমাবদ্ধতা তাঁর নজর এড়ায়নি। গ্রিক যোদ্ধারা ছিল মূলত খেতখামারে চাষবাস করা লোকজন, তারা খুব বেশি দিন নিজেদের জমিজিরাত থেকে দূরে থাকতে ইচ্ছুক ছিল না। অন্যদিকে এথেন্সবাসীদের সুবিধা ছিল এই যে তারা তাদের প্রয়োজনীয় সব খাবারদাবার আমদানি করার ব্যবস্থা করে রেখেছিল আগে থেকেই। আর থুসিডিডিস আমাদের জানাচ্ছেন, ‘ইতিহাস’ গ্রন্থটি রচনার পেছনে তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে যুদ্ধকালীন মানবচৈতন্যে কী ঘটে, তা খতিয়ে দেখা। এবং তাঁর কীর্তির একেবারে পরাকাষ্ঠা ঘটেছে পেরিক্লিজের দেওয়া ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বক্তৃতা’য়। যুদ্ধে নিহত এথেনীয়দের প্রথম গণ–অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় জড়ো হওয়া দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি সেই বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন:
‘আমাদের সংবিধানকে গণতন্ত্র বলা হয়, কারণ তা অল্প কিছু নয় বরং বহু মানুষের হাতে ন্যস্ত। তবে আমাদের আইনকানুন সবার জন্য, তাদের ব্যক্তিগত বিবাদ-বিসংবাদে সমান ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা বিধান করে। আমাদের সব ধরনের অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের জনমত সহজাত গুণ ও দক্ষতাকে স্বাগত ও সম্মান জানায় এবং তা কোনো গোষ্ঠীগত স্বার্থে নয়, বরং শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে।
তবে সম্ভবত এই সর্বকালের সবচেয়ে যোগ্য গণতান্ত্রিক নেতা পেরিক্লিজকেও, আরও অনেকের মতো, দেখতে হয়েছিল জনমত কতটা চপল ও অস্থিরমতি হতে পারে। প্লেগের শিকার হয়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু আর শত্রুর হাতে তাদের দেশকে ছারখার হয়ে যেতে দেখে এথেনীয়রা তাঁর বিরুদ্ধে ক্রোধে ফুঁসে ওঠে। ওদিকে প্লেগ তাঁর দুই পুত্রকে কেড়ে নেয় এবং তিনি নিজে যুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই বছর ছয় মাসের মধ্যে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরেই কেবল বোঝা গিয়েছিল তাঁর নীতি কতটা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ছিল।
পেরিক্লিজ অভিজাত শ্রেণির মানুষ ছিলেন, ছিলেন দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের সুহৃদ এবং তাঁদের স্বার্থের ব্যাপারে তাঁর সুনজর ছিল। কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারীরা ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ: একজন শন্য-সুতার বণিক, আরেকজন ভেড়ার কারবারি। এরপর আসেন ক্লেয়ন, একজন চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী: গোঁয়ারগেবিন্দ মার্কা ও সৎ, তবে লেখাপড়ার দৌড় বিশেষ ছিল না তাঁর, ছিল না বিশেষ কোনো আদর্শও।
যুদ্ধের দশম বছর, অ্যাম্ফিপোলিসের যুদ্ধে ক্লেয়ন ও স্পার্টান বীর সেনাপতি ব্রাসিডাসের মৃত্যুর পর একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কার্যত সেটা এথেন্সের জন্য একটা বিজয়ই ছিল বলতে হবে, কারণ সেই চুক্তির শর্তানুযায়ী দুই পক্ষই তাদের শত্রুতার ফলে যা হারিয়েছিল, তার অনেকটা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। এবং সেই শান্তিচুক্তির পরপরই এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে একটা পঞ্চাশ বছরের মৈত্রী চুক্তি হয়। তবে তাতে শান্তি আসেনি। স্পার্টার মিত্ররা ভাবল তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে এবং এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দুই মিত্র—করিন্থ ও বিয়োশিয়া সেই চুক্তি মেনে নিতে আপত্তি জানাল। নগররাষ্টগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের জোটের সৃষ্টি হয়, গোটা গ্রিসজুড়ে যুদ্ধ ও শান্তির পক্ষের নানান দল ছড়িয়ে পড়ে—এথেন্সে যুদ্ধের পক্ষের নেতা ছিলেন আলসিবাইডিস। তিনি নতুন জোট গড়ে তোলেন এবং তার ফলে ৪১৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে স্পার্টার বিরুদ্ধে আবারও যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। তখন থেকেই এথেনীয় সাম্রাজ্য ও আদর্শের চূড়ান্ত পতনের শুরু।
থুসিডিডিসের ‘পেলোপোনেসীয় যুদ্ধের ইতিহাস’-এর ষষ্ঠ ও সপ্তম খণ্ডে প্রধানত সিসিলিতে এথেনীয় বিপর্যয়মূলক অভিযানের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আর অষ্টম বা শেষ খণ্ডে রয়েছে ৪১১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের যুদ্ধের ইতিহাস। এই খণ্ডকে সবচেয়ে অনাকর্ষণীয় বলে মনে করা হয়। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই খণ্ডটি আমাদের ইতিহাসবিদ পরিমার্জনা করে যেতে পারেননি, এবং একটি অর্ধসমাপ্ত বাক্যে এসে সেটা শেষ হয়েছে।
ঐতিহাসিক গবেষণার রীতিনীতি কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে থুসিডিডিস ২৪০০ বছরের আগে যা লিখে গেছেন, সেখান থেকে দু–চার কথা উদ্ধৃত করে অমর গ্রন্থটি সম্পর্কে আমাদের আলোচনার ইতি টানব:
বেশির ভাগ মানুষই কোনো ধরনের সমালোচনামূলক যাচাই–বাছাই না করেই সব ধরনের ঐতিহ্য গ্রহণ করে নেয়, এমনকি তা তাদের স্বদেশের হলেও। কবিদের অতিরঞ্জিত কল্পনা বা ঘটনাপঞ্জি রচয়িতাদের গল্পকাহিনি যেন ইতিহাসবিদকে ভুল পথে চালিত করতে না পারে; তারা সত্য উচ্চারণ করার চেয়ে কর্ণকুহরকে তুষ্ট করতে চায় বেশি। কালের এত ব্যবধানে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে জাজ্বল্যমান যে প্রমাণ পাওয়া সম্ভব, তারই ভিত্তিতে রচিত উপসংহার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হবে একজন ইতিহাসবিদকে। যুদ্ধ–সম্পর্কিত ঘটনাবলির ব্যাপারে আমি আকস্মিক কোনো পর্যবেক্ষণ বা আমার কোনো মতের ওপর ভিত্তি করে কোনো কথা বলার চেষ্টা করিনি। আমি যা নিজে দেখেছি বা অন্যকে সতর্ক ও বিশেষভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে যা জেনেছি, তা ছাড়া আমি কোনো কিছুর বর্ণনা দিইনি।
আমার ইতিহাস একটি চিরস্থায়ী সম্পদ, ক্ষণস্থায়ী কোনো দর্শনীয় বস্তু নয়।
(সূত্র: জন ক্যানিং রচিত ‘দ্য হিস্ট্রি অব দ্য পেলোপোনেসিয়ান ওয়ার’)