ভালো থেকো, বন্ধু

কিংবদন্তি ফুটবলার মোনেম মুন্নাকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর একসময়ের প্রবল প্রতিপক্ষ, জাতীয় দলের সতীর্থ ও বন্ধু সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির।

বাংলাদেশের সাবেক ফুটবলার মোনেম মুন্নাফাইল ছবি

মানুষ চোখের আড়াল হলে নাকি মনের আড়ালেও চলে যায়। কথাটা ভুল। ভুল না হলে মুন্নার কথা কেন সব সময় মনে পড়বে! বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে আলোচনা-আড্ডায় প্রায়ই চলে আসে মুন্নার কথা। এমনিতেই ওকে আমার মনে পড়ে। অকালে ওর চলে যাওয়া ছিল বড় আঘাত।

মুন্নার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে জাতীয় দলে আসার পর, সেটা আশির দশকের মাঝপথ পেরিয়ে। ১৯৮৭ থেকে আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। আমাদের সম্পর্কটা অন্য রকম ছিল। সব সময় ও দুষ্টুমি করত। একসঙ্গে হলেই ইয়ার্কি, ফাজলামো না করে থাকতে পারত না। সব সময়ই মুন্নাকে দেখেছি, হাসি-আনন্দ আর মজা করতে। মাঝেমধ্যে মজা করে আমাকে ‘পিচ্চি’ বলত। আহা, সেই দিনগুলো কখনো মুছে যাবে না।

কিন্তু মানুষ চলে গেলেও তার কীর্তি থেকে যায়। যেমন থেকে গেছে মুন্নার কীর্তি। ওর বিপুল জনপ্রিয়তা অনেকের কাছেই ছিল ঈর্ষণীয়। মনে পড়ে মাঠের স্মৃতিময় দিনগুলো। ঢাকার ফুটবলে আমরা প্রতিপক্ষই ছিলাম বরাবর। ও আবাহনীতে, আমি মোহামেডানে। চট্টগ্রাম মোহামেডানের হয়ে চট্টগ্রাম লিগে সম্ভবত এক-দুই মৌসুম দুজন একই জার্সিতে খেলি।

আরও পড়ুন

একই জার্সিতে খেলার সুযোগ হয়েছে আর শুধু জাতীয় দলে। সেখানেই মাঠের বাইরে কাছ থেকে বেশি দেখেছি মুন্নাকে। তবে ওর সঙ্গে জাতীয় দলে কখনো এক রুমে ছিলাম বলে মনে পড়ে না। আমাদের সময় কোচরা করতেন কী, ধরুন ডিফেন্ডারদের সবাইকে একসঙ্গে রাখতেন, যাতে বোঝাপড়া তৈরি হয়। ফলে এক রুমে থাকা হয়নি আমাদের।

আমাদের মধ্যে অবশ্য জানাশোনার সম্পর্ক গড়ে ওঠে বেশ আগেই। মনে পড়ছে, আশির দশকে অনূর্ধ্ব-১৮ একটা ক্যাম্প করেছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। তাতে মুন্না, এমিলি ছিল। এরপর তো ওরা ঢাকার ফুটবল কাঁপাল।

মুন্নার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে জাতীয় দলে আসার পর, সেটা আশির দশকের মাঝপথ পেরিয়ে। ১৯৮৭ থেকে আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। আমাদের সম্পর্কটা অন্য রকম ছিল। সব সময় ও দুষ্টুমি করত। একসঙ্গে হলেই ইয়ার্কি, ফাজলামো না করে থাকতে পারত না। সব সময়ই মুন্নাকে দেখেছি, হাসি-আনন্দ আর মজা করতে। মাঝেমধ্যে মজা করে আমাকে ‘পিচ্চি’ বলত। আহা, সেই দিনগুলো কখনো মুছে যাবে না।

আরও পড়ুন
মোহামেডানের সেই রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বিরের সেকাল–একাল
ছবি : প্রথম আলো

আশি-নব্বইয়ের দশকের কথা মনে পড়ছে, দুই প্রধান দলের ম্যাচে তখন তারকাদের নিয়ে অনেক চর্চা হতো। আমরা যখনই মুখোমুখি হতাম, সাড়া পড়ে যেত সারা দেশে। সংবাদপত্রে নানা প্রতিবেদন বেরোত। মুন্নার কাজ ছিল আমাকে আটকানো, আমি চাইতাম ওকে কাটিয়ে গোল পেতে। এমনিতে দেখা যায়, ডিফেন্ডারের সঙ্গে ১০ বারের মুখোমুখিতে ফরোয়ার্ডই ৬-৭ বার জিতে যায়। মেসির সঙ্গে বিশ্বসেরা ডিফেন্ডারও যেমন পাত্তাই পায় না। এ ক্ষেত্রে ডিফেন্ডারদের কাজটা কঠিন। তাদের অনেক সতর্ক হয়ে ট্যাকল করতে হয়।

ডিফেন্ডার হিসেবে মুন্নাকে কুর্নিশ করতে হবে। তবে শুধু স্টপার পজিশনের কথা এলে, আমার দেখা সেরা ডিফেন্ডার কায়সার হামিদই। আসলে সেভাবে কে সেরা রায় দেওয়া কঠিন। মুন্না ও কায়সার—দুজনই বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার কথাটা এভাবে বলাই ভালো। ওর মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রার্থনা একটাই—ভালো থেকো, বন্ধু।
সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির

মুন্নাকেও সেটা মাথায় রাখতে হতো। আমি হালকাপাতলা হলেও শারীরিকভাবে শক্তিশালী ছিলাম। আমার বল নিয়ন্ত্রণ ভালো ছিল। বল পায়ে ফুটবলারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমি সেটা পারতাম। আর পারতাম বলেই ডিফেন্ডারকে হারিয়ে ঢুকে পড়তাম বক্সে। ডিফেন্ডারের জন্য কাজটা কঠিন। কারণ, বল তো ফরোয়ার্ডের পায়ে থাকে। আমার যখন ফর্ম তুঙ্গে, অনেকেই আমার সামনে সেভাবে চ্যালেঞ্জে আসত না। এর মানে অবশ্য এই নয়, সব সময় আমিই জিতেছি ডিফেন্ডারের সঙ্গে লড়াইয়ে, বিশেষ করে মুন্নার সঙ্গে। মুন্না যে মানের ডিফেন্ডার, ওকে হারানো সহজ ছিল না অবশ্যই।

আরও পড়ুন

প্রথম দিকে মুন্না লেফটব্যাক, রাইটব্যাকে খেলত। স্টপার, মাঝমাঠেও খেলেছে। তখনকার সময়ে কায়সার হামিদ আর মুন্নার মধ্যে কে বেশি ভালো, এ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠত। আসলে যার যার জায়গায় সে সেরা। মুন্নার কিছু বাড়তি পারদর্শিতা ছিল। কায়সারেরও সেটা ছিল। কায়সার রাইটব্যাক বা লেফটব্যাকে খেলত না। কারণ, এই দুটি পজিশনে প্রচুর রানিং দরকার।

এই গুণটা আবার মুন্না মধ্যে দেখেছি। মুন্না রক্ষণে সব পজিশন তো বটেই, মাঝমাঠেও খেলতে পারত। ইস্ট বেঙ্গলে মাঝমাঠে খেলেও দারুণভাবে আলোচনায় আসে। ভিনদেশে গিয়ে বিরাট দাগ কেটে আসতে পারা সাধারণ মানের কোনো ফুটবলারের পক্ষে সম্ভব নয়। মুন্না অসাধারণ বলেই কলকাতা মাতিয়ে আসতে পেরেছিল।

বিচক্ষণতা আর যেকোনো জায়গায় খেলার ক্ষমতাই মুন্নাকে এত দূর এনেছে। জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচে দেখেছি, মুন্না সব পজিশনেই খেলছে। বেশির ভাগ সময় রাইটব্যাক।

১৯৮৬ সিউল এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের হয়ে খেলেন মোনেম মুন্না
ছবি: মোনেম মুন্নার পারিবারিক অ্যালবামের

তখন জাতীয় দলে রেহানসহ অন্যরা ছিল। কিন্তু মুন্নার মান অনেক উঁচু হওয়ায় কোচ ওকে যখন যেখানে দরকার খেলাত। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডেও খেলানো হয়েছে ওকে। আসলে মুন্নার প্রতিভা বহুমুখী।

সেটা বিবেচনায় নিলে ডিফেন্ডার হিসেবে মুন্নাকে কুর্নিশ করতে হবে। তবে শুধু স্টপার পজিশনের কথা এলে, আমার দেখা সেরা ডিফেন্ডার কায়সার হামিদই। আসলে সেভাবে কে সেরা রায় দেওয়া কঠিন। মুন্না ও কায়সার—দুজনই বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার কথাটা এভাবে বলাই ভালো।

আরও পড়ুন

মুন্না নেই আজ অনেক বছর। ওর মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রার্থনা একটাই—ভালো থেকো, বন্ধু।

ওর আত্মা শান্তি পাক, এই প্রার্থনাই করছি।

লেখক: জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার

(লেখাটি গত বছর এই দিনে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল)।