‘হলান্ড জোনে’ লিভারপুল, আজও কি বেঁচে ফিরতে পারবে

দুর্দান্ত ফর্মে আছেন ম্যানচেস্টার সিটির নরওয়েজীয় স্ট্রাইকার আর্লিং হলান্ড (মাঝে)এএফপি

আর্লিং হলান্ডকে কীভাবে থামাতে হয়, লিভারপুল সেটা জানে।

কিন্তু কখনো কখনো একজন খেলোয়াড় এমন ছন্দে চলে আসেন, সব জেনে, সবকিছু করেও তাঁকে আটকানো যায় না। ম্যানচেস্টার সিটির নরওয়েজিয়ান গোলমেশিনও সম্ভবত এই মুহূর্তে তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ছন্দে আছেন। তাই অলরেডদের বিপক্ষে পুরোনো হিসাব মেটানোর সবচেয়ে ভালো সুযোগ আজ তাঁর সামনে। সুযোগ এসেছে ‘লিভারপুলের বিপক্ষে হলান্ড গোল পান না’—এই অপবাদ ঘোচানোর।

সহজ গোলে লিভারপুলের সঙ্গে পরিচয়

অথচ মাত্র ১৯ বছর বয়সে, লিভারপুলের বিপক্ষে প্রথম গোল করতে তাঁর সময় লেগেছিল চার মিনিটেরও কম। সেটা ২০১৯ সালের ঘটনা। চ্যাম্পিয়নস লিগে অ্যানফিল্ডে খেলতে গিয়েছিল সালজবুর্গ। আগের ম্যাচেই গেঙ্কের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিলেন, কিন্তু লিভারপুলের বিপক্ষে তাঁকে শুরুতে বেঞ্চে রেখেছিলেন সালজবুর্গের কোচ জেসি মার্শ। দল তখন তিন গোলে পিছিয়ে পড়ে ৩-২ করেছে স্কোরলাইন। হলান্ডকে মাঠে নামানো হয় সেই সময়। নামার কয়েক মিনিট পরই তিনি স্কোরলাইন সমান করেন, ৩-৩।

লিভারপুলের বিপক্ষে আর্লিং হলান্ডের (৩০ নং) প্রথম গোল। ২০১৯ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগে সালজবুর্গের হয়ে
এএফপি

সম্ভবত সেটা ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সহজ গোলগুলোর একটি, তাকুমি মিনামিনোর পাসে খালি জালে ঠেলে দেন বল। ওই সমতার আনন্দ অবশ্য টিকে ছিল খুব কম সময়। ৯ মিনিট পরই মোহাম্মদ সালাহর গোলে আবার এগিয়ে যায় লিভারপুল, ম্যাচ জেতে ৪-৩ গোলে।

তবু ইংল্যান্ডের মাটিতে সেই প্রথম গোলই হলান্ডকে আলোচনায় নিয়ে আসে। সম্ভবত সেখান থেকেই শুরু হয় বিশ্বের সেরা সেন্টার ফরোয়ার্ড হওয়ার পথে তাঁর উত্থান।

আরও পড়ুন

লিভারপুল তবু এত কঠিন হলান্ডের জন্য

শুরুটা হয়েছিল দারুণ। কিন্তু তারপর লিভারপুলের বিপক্ষে হলান্ডের গোল যেন মরুভূমির বৃষ্টির মতোই বিরল। ৮ ম্যাচে তাঁর গোল মাত্র ৩টি। অন্তত আটবার মুখোমুখি হওয়া প্রতিপক্ষের মধ্যে লিভারপুলের বিপক্ষেই তাঁর সবচেয়ে কম গোল।

লিভারপুলের বিপক্ষে ৮ ম্যাচে ৩ গোল করেছেন হলান্ড
এএফপি

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে তাঁর গোলের সংখ্যা ৮, আর্সেনালের বিপক্ষে ৫, আর চেলসি ও টটেনহামের বিপক্ষে ৪টি করে। তুলনায় লিভারপুল যেন এক ধাঁধা—সিটির হয়ে তাঁদের বিপক্ষে ৬ ম্যাচে মাত্র ২টি গোল, তার একটি মাত্র প্রিমিয়ার লিগে।

কিন্তু এবার হলান্ড আছেন দারুণ ছন্দে। আজ চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে ম্যাচটা নরওয়ের গোলমেশিনের জন্য শুধুই একটা ম্যাচ নয়, বরং হতে পারে তাঁর ক্যারিয়ারের এক গুরুত্বপূর্ণ সপ্তাহের সূচনাও। আর এই যাত্রার শুরুটা হতে পারে লিভারপুল-অভিশাপ কাটানোর মধ্য দিয়ে।

আরও পড়ুন

সালজবুর্গের হয়ে লিভারপুলের বিপক্ষে ঘরের মাঠে তাঁর ফিরতি ম্যাচটাও খুব একটা সুখকর ছিল না। ২-০ গোলে হেরে মাঠ ছাড়তে হয়। সিটির হয়ে লিভারপুলের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ ছিল ২০২২ সালের কমিউনিটি শিল্ড। সেখানে আবারও তাঁকে ছাপিয়ে যান দারউইন নুনিয়েজ। সিটি হারে ৩-১ ব্যবধানে।

সিটির হয়ে লিভারপুলের বিপক্ষে হলান্ড প্রথম খেলেছেন ২০২২ সালে কমিনিউটি শিল্ডে
রয়টার্স

সেই ম্যাচে হলান্ড বল ছুঁয়েছিলেন মাত্র ১৪ বার। ছয় গজ দূর থেকে খালি জালে শট নিয়েও পোস্টে লাগিয়েছিলেন। ম্যাচের পর গার্দিওলা বলেছিলেন, ‘আজ সে গোল করেনি, কিন্তু করবে। সে জানে কীভাবে গোল করতে হয়। আমাদের অনেক সাহায্য করবে।’

কথাটা ভুল ছিল না। পরের ম্যাচেই ২ গোল করেন ওয়েস্ট হামের বিপক্ষে। শুরু হয় রেকর্ড-ভাঙা এক মৌসুম, প্রিমিয়ার লিগে ৩৬ গোল করে নিজেকে নিয়ে যান নতুন এক উচ্চতায়।

আরও পড়ুন

প্রিমিয়ার লিগে শূন্য জয়

২০২২ সালের অক্টোবরে অ্যানফিল্ডে উত্তপ্ত সেই ম্যাচে লিভারপুলের বিপক্ষে আবারও গোলশূন্য থাকেন হলান্ড। ম্যাচটা সিটি হেরে যায় ১-০ ব্যবধানে। পরেরবার কারাবাও কাপে গোল করেন ঠিকই, কিন্তু চোটে পড়ায় লিগে পরের ম্যাচ মিস করেন। সিটি অবশ্য সেই ম্যাচ ৪-১ গোলে জেতে, আর মৌসুম শেষে জেতে লিগও।

২০২৩ সালের নভেম্বরে সিটির মাঠে ১-১ ড্রয়ে করেন একটি গোল। এরপর অ্যানফিল্ডে আবারও গোলশূন্য দুটি ম্যাচ—একটি ১-১, আরেকটিতে ২-০ তে হার। এমনকি গত মৌসুমে ইতিহাদেও খেলতে পারেননি চোটের কারণে। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলের বিপক্ষে একটিও জয় নেই হলান্ডের।

আরও পড়ুন
প্রিমিয়ার লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ মিলিয়ে সিটির হয়ে এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত ১৪ ম্যাচে ১৮ গোল করেছেন। দেশের জার্সিতে ৩ ম্যাচে আরও ৯টি। মোট ১৭ ম্যাচে ২৭ গোল।

এখন জীবনের সেরা ফর্মে

তবু এবার আত্মবিশ্বাসে টগবগ করছেন হলান্ড। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘আমাদের দল হয়ে খেলতে হবে। আক্রমণ-রক্ষণ সব একসঙ্গে করতে হবে। সহজ ম্যাচ হবে না। আমাদের সেরা খেলাটা খেলতে হবে।’

প্রিমিয়ার লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ মিলিয়ে সিটির হয়ে এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত ১৪ ম্যাচে ১৮ গোল করেছেন। দেশের জার্সিতে ৩ ম্যাচে আরও ৯টি। মোট ১৭ ম্যাচে ২৭ গোল। এই ছন্দ ধরে রাখতে পারলে নিজের গড়া ২০২২-২৩ মৌসুমে ৫৭ গোলের রেকর্ড ভাঙাও সময়ের ব্যাপার। হলান্ডও বেশ আত্মবিশ্বাসী। কদিন আগেই বলেছেন, ‘ক্যারিয়ারে কখনো এত ভালো লাগেনি। মনে হচ্ছে, এখন আমি আমার সেরা সংস্করণ।’

এ মৌসুমে দুর্দান্ত ফর্মে আছেন আর্লিং হলান্ড
এএফপি

কঠোর রুটিনের ফল

চোট এড়াতে হলান্ড নিজের দৈনন্দিন অভ্যাস আর খাদ্যতালিকাতেও বেশ পরিবর্তন এনেছেন সম্প্রতি। লাল আলো থেরাপি, ম্যাসাজ, বরফস্নান, সনা—সবই আছে তালিকায়। খাবারে তাজা মাছ, স্টেক আর কাঁচা দুধ।

ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে গোল করার পর আবারও বলেছেন, এই রুটিনই তাঁকে ধারাবাহিক রাখছে, ‘তীক্ষ্ণ থাকতে হলে মাথা পরিষ্কার রাখতে হয়। সঠিকভাবে বিশ্রাম নিতে হয়, সঠিক খাবার খেতে হয়। মাঠে যখন দরকার, তখন মনোযোগী হতে হয়। আর বাড়িতে যতটা সম্ভব শান্ত থাকতে হয়।’

আরও পড়ুন

সামনে বড় লক্ষ্য

সপ্তাহের শুরুতে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল—কোনো রেকর্ড ভাঙার কথা ভাবেন কি না। হলান্ড হেসে বলেছিলেন, ‘উদ্ধত হতে চাই না, কিন্তু কোন রেকর্ড?’ আসলে প্রশ্নটা ছিল প্রিমিয়ার লিগে অ্যালান শিয়ারারের ২৬০ গোলের রেকর্ড নিয়ে। হলান্ডের উত্তর ছিল, ‘এসব ভাবলে চলবে না। আমার কাজ দলকে জেতানো। ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমান নিয়েই ভাবতে হবে।’

নরওয়ের জার্সিতে আর্লিং হলান্ড
রয়টার্স

তবু একটা লক্ষ্য মাথা থেকে সরাতে পারছেন না—নরওয়েকে বিশ্বকাপে তোলা। রোববার লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে তাঁর মন চলে যাবে বৃহস্পতিবারের ম্যাচে, যেখানে এস্তোনিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাই ম্যাচে খেলবে নরওয়ে। পরের রোববার ইতালির বিপক্ষে শেষ ম্যাচে। ১৯৯৮ সালের পর নরওয়ে আর বিশ্বকাপে খেলেনি। এবার তাঁর ১২ গোলেই দল ছয় ম্যাচে ছয় জয় পেয়েছে। এস্তোনিয়াকে হারালেই কার্যত নিশ্চিত হয়ে যাবে বিশ্বকাপ। হলান্ড আগেই বলে রেখেছেন, ‘নরওয়ে বিশ্বকাপে উঠলে বড় উৎসব হবে। আমি তো জন্মই নিয়েছি আমরা সর্বশেষ বিশ্বকাপ খেলার দুই বছর পর। আমার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য নরওয়েকে বিশ্বকাপে ও ইউরোতে তোলা। আমার কাছে এটা সিটির হয়ে জেতা সব ট্রফির সমান, হয়তো তার চেয়েও বেশি।’

আরও পড়ুন

বিপজ্জনক ‘হলান্ড জোন’

দেশকে বিশ্বকাপে তোলা আর লিভারপুলের বিপক্ষে লিগে প্রথম জয়—সামনে বড় দুই লক্ষ্য। হয়তো এটাই হলান্ডের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সপ্তাহ। তবে তিনি শান্ত, চাপ নিচ্ছেন না। বলেছেন, ‘মানুষ কী আশা করছে, সেটা ভাবি না, মনটা যতটা সম্ভব মুক্ত রাখি। নিজের জোনে থাকি।’

আর সেই ‘হলান্ড জোন’ এই মুহূর্তে প্রতিপক্ষের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গাগুলোর একটি। আজ সেখানে প্রবেশ করতে যাচ্ছে লিভারপুল, একমাত্র দল যারা এখন পর্যন্ত তাঁর গোলবন্যা থেকে বেঁচে ফিরেছে।

আজ কি বেঁচে ফিরতে পারবে?