মেসি-রোনালদোদের স্বপ্ন যখন হাতছোঁয়া দূরত্বে

সবার দেখার জন্য উন্মোচিত বিশ্বকাপ ট্রফিছবি: সৌজন্য

সোনারঙা ট্রফিটা দেখে যখন বের হলেন, তাঁর চোখেমুখে কী উচ্ছ্বাস! যেন বিশ্বজয় করে এসেছেন। সঙ্গে আসা বন্ধুরা আগেই ট্রফি দেখে এসে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের দিকে তাকিয়ে মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত উঁচু করে তাঁর উল্লাস, ‘উহুউউউ! বামোস!’ বাংলাদেশি কারও মুখে স্প্যানিশে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান শুনে চমক জেগেছিল বটে, তবে গায়ের আর্জেন্টিনা জার্সিটা চমক বেশিক্ষণ রাখেনি।

কথায় কথায় জানা গেল নাম-পরিচয়। কোকা-কোলার আয়োজনে ফিফা বিশ্বকাপের আসল ট্রফি ঘুরে যাচ্ছে বাংলাদেশ, সেটিকে এত কাছ থেকে দেখার শিহরণ তখনো সাব্বির হাসনাতের চোখেমুখে। ‘বলে বোঝাতে পারব না! সার্থক! উচ্ছ্বসিত’—অনুভূতির প্রকাশে শব্দের খোঁজে নেমে এতটুকুই বলতে পারলেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ কলেজের ছাত্র হাসনাত।

কথা বলতে বলতে তাঁর বন্ধুদের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সেখানে ব্রাজিলের জার্সি গায়ে দাঁড়িয়ে মুন্সী আব্দুর রউফ কলেজেরই ছাত্র রওনক ইবনে রাজ্জাক। মূলত ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায় বিভক্ত এই বদ্বীপের দুই প্রতিনিধি যেন!

আরও পড়ুন
আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের জার্সি গায়ে দুই বন্ধু
ছবি: প্রথম আলো

সকাল থেকেই রাজধানীর র‍্যাডিসন ব্লু হোটেলে এমন নানা রঙের জার্সির ছড়াছড়ি। বিশ্বকাপ ট্রফি এর আগেও দুবার এসেছে বাংলাদেশে, এবার এল ৯ বছর পর। তবে তৃতীয়বারে এসে প্রথমবার আসল ট্রফির দেখা পেল বাংলাদেশ। ট্রফির সঙ্গে শুভেচ্ছাদূত হয়ে ফ্রান্সের ১৯৯৮ বিশ্বকাপজয়ী দলের জিদান-অঁরিদের সতীর্থ ক্রিস্টিয়ান কারেম্বুও এসেছেন। কারেম্বুকে দেখার সুযোগ সেভাবে মেলেনি, তবে ট্রফিটাকে কাছ থেকে দেখার এমন সুযোগ কে হেলায় ছাড়তে চায়!

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

কেউ ব্রাজিলের জার্সি গায়ে, কেউ আর্জেন্টিনার। জার্মানি-স্পেন-পর্তুগালের জার্সিও দু-একটি পাওয়া গেল। কেউবা এসেছেন প্রিয় ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, আর্সেনাল, লিভারপুল, পিএসজির জার্সিতে। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ফুটবল দল তো নিজেদের জার্সি পরে দল বেঁধে বাসে করেই এসেছে! তাদের কোচ সাবেক ফুটবলার মাহবুব আলী মানিক শুধু বললেন, ‘আমাদের কখনো ট্রফিটা জেতা তো কল্পনারও অতীত। ছাত্রদের তাই নিয়ে এলাম। ট্রফিটা দেখেছে, ছবি তুলেছে, এটাই আনন্দ।’

আরও পড়ুন

সেই দল থেকে চোখ ফেরাতেই চোখে পড়ল, একজন সেল্টিকের জার্সি গায়ে এসেছেন! সেল্টিক! এত ক্লাব থাকতে বাংলাদেশের সেল্টিকের জার্সি গায়ে কেউ—কৌতূহলের জবাবে জার্সিধারী ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাত্র ইফতেখার নোবেল সরল হাসিতে অবশ্য বললেন, ‘কোনো কারণ নেই, এমনিই! জার্সিটার রং ভালো লাগে।’

ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ফুটবল দল এসেছে নিজেদের জার্সি পরে
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কারণে পর্তুগাল সমর্থক ইফতেখার অবশ্য ট্রফিটা দেখার পর থেকেই সেটি রোনালদোর হাতে দেখার কল্পনায় বিভোর। ‘কী হবে তো বলা যায় না, তবে আশা তো করতেই পারি’, রোনালদোর শেষ বিশ্বকাপটা শিরোপাতেই শেষ হলে ইফতেখারের মতো খুশি মানুষের সংখ্যা নেহাত কম হবে না।

আরও পড়ুন

মেসিই–বা পিছিয়ে থাকেন কেন! মুন্সী আব্দুর রউফ কলেজের ছাত্র সাব্বির তো আর্জেন্টিনা সমর্থক, তিনি আর্জেন্টিনারই শিরোপাজয়ের স্বপ্নে বিভোর। পাশে থাকা তাঁর ব্রাজিল সমর্থক বন্ধু রওনকও বলছিলেন, ‘ব্রাজিলভক্ত হলেও মেসিকে শ্রদ্ধা করি। মেসি কাপটা নিলেও অনেক ভালো লাগবে। তবে ব্রাজিল ইজ ব্রাজিল।’

আরও পড়ুন

শিরোপাটাকে এত কাছ থেকে দেখার শিহরণ শেষে নিজের প্রিয় তারকা, প্রিয় দলের হাতে দেখার স্বপ্ন সবারই মুখে মুখে। কতটা, তা বোঝা গেল কদিন আগেই বাংলাদেশ ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জিতে শীর্ষ স্তরে উঠে আসা ফর্টিস ফুটবল ক্লাবের সভাপতি শাহিন হাসানের কথায়। ‘ট্রফিটার কাছে গিয়ে বলছিলাম, ট্রফি, তুমি আর্জেন্টিনার হয়ে যাও’—হাসিমুখে বলছিলেন শাহিন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

যাকে ছুঁয়ে দেখতে ফুটবলারদের এত বছরের সাধনা, যাকে পাওয়ার সৌভাগ্য এখনো মেসি-রোনালদো-নেইমারেরও হয়নি, তাকে বাংলাদেশের মতো বিশ্বকাপের আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক একটা দেশে দেখতে পাওয়া এক সৌভাগ্য বটে। আইইউবির ফুটবল দলের জার্সি গায়ে আসা ওমায়েছ সরকারের কথায়ও সৌভাগ্যের অনুরণন, ‘মেসি-রোনালদোর স্বপ্নকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলাম।’

আরও পড়ুন
বাংলাদেশের জার্সিও থাকল
ছবি: প্রথম আলো

ট্রফিটার দেখা পাওয়া এত সহজও ছিল না। টিকিটের কিউআর কোড স্ক্যান করে দাঁড়িয়ে বিশ্বকাপের ট্রফি দেখার, সেটির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার রোমাঞ্চ নিয়ে লম্বা সারিতে অপেক্ষা। কোক স্টুডিও বাংলাদেশের গানে গানে মমতাজ, অনিমেষ রায়, পান্থ কানাইরা অবশ্য অপেক্ষার সময়টুকুতে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিলেন বেশ।

আরও পড়ুন

অপেক্ষা শেষে দাঁড়িয়ে ট্রফিটার কাছাকাছি পৌঁছেও দেখা গেল, সে এক অবগুণ্ঠনে ঢাকা। অবশ্য ঠিকই তো আছে, এত সাধনার বস্তু কি সবার সামনে থাকে নাকি! যাকে ছুঁয়ে দেখা ফুটবলারের আজীবনের সাধনা, সাধারণ্যের চোখের আড়ালেই তো থাকবে সেটি। কাঠের বোর্ডের আড়াল পেরোতেই দেখা গেল, কাচঘেরা ঘরে সেটি দাঁড়িয়ে। ছুঁয়ে দেখার সুযোগ নেই, চোখে দেখাই শান্তি। ট্রফির কাছে গিয়ে ছবি তোলার জায়গা, তবে এত কম সময়ে এত মানুষকে সুযোগ দিতে মিনিটখানেকও ট্রফির পাশে থাকার সুযোগ তেমন কারও হলো না।

আরও পড়ুন

কয়েক সেকেন্ডের জন্যই হোক, তবু দেখা তো গেল! সে লক্ষ্যে ৯টা থেকেই মানুষের ভিড়। ১০টার মধ্যে লম্বা সারি হোটেল ছাড়িয়ে রাস্তামুখী। নিজে ট্রফিটাকে এভাবে দেখার সুযোগ পাচ্ছে না বলে ততক্ষণে বৃষ্টির বুঝি বড্ড ঈর্ষা হলো। কিংবা অভিমান। ঝমঝমিয়ে পড়ল আকাশ ভেঙে। দর্শক উন্মাদনায় জল—আক্ষরিক ও ভাব দুই অর্থেই। তবু ভারী বৃষ্টি মাথায় নিয়েও দর্শক কম হলো না!

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

বিশ্বকাপের সময় যত ঘনিয়ে আসবে, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল নিয়ে উন্মাদনা তো ততই বাড়বে। তবে সবকিছুর মধ্যে বাংলাদেশ আর এ দেশের ফুটবলও থাকল। ট্রফি দেখে ফেরার পথেই দেয়ালজুড়ে একটা ছবির কোলাজ, যাতে বাংলাদেশের ফুটবলের স্বর্ণসময় জীবন্ত হয়ে ওঠে। সেটির সামনে পাওয়া গেল বাংলাদেশের জার্সি গায়ে জড়িয়ে ট্রফি দেখতে আসা তানজিম আহমেদকে।

আরও পড়ুন
বাংলাদেশ জাতীয় দলের ডিফেন্ডার বিশ্বনাথ ঘোষের স্ত্রী চৈতির সঙ্গে কারেম্বু (বাঁয়ে), ডানে বিশ্বকাপ ট্রফির সঙ্গে দাঁড়িয়ে জাতীয় দলের মিডফিল্ডার সোহেল রানার স্ত্রী অনামিকা
ছবি: সৌজন্য

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইইউবিএটির ছাত্রের প্রিয় দল ইতালি এবার বিশ্বকাপে নেই, তবে ইতালির জার্সির বদলে বাংলাদেশ ফুটবল দলের জার্সি পরার একমাত্র কারণ সেটিই নয়, ‘চাইলে ইতালির জার্সি পরে আসতে পারতাম। কিন্তু সবাই তো চায় নিজের দেশকেও বিশ্বকাপে দেখতে, সে ইচ্ছা থেকেই বিশ্বকাপ ট্রফির কাছে বাংলাদেশের জার্সি নিয়ে আসা।’

আরও পড়ুন

ট্রফি দেখতে আসা দর্শকের সারিতে খুঁজে পাওয়া গেল বাংলাদেশ জাতীয় দলের তিন ফুটবলারের স্ত্রীদেরও। গোলকিপার আশরাফুল রানার স্ত্রী ফাহমিদা বারী, ডিফেন্ডার বিশ্বনাথ ঘোষের স্ত্রী চৈতি ঘোষ আর মিডফিল্ডার সোহেল রানার স্ত্রী সৈয়দা অনামিকা সিরাজী। ফুটবলাররা জাতীয় দলের দায়িত্বে, মালয়েশিয়ায় এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে ব্যস্ত, এমন সময়ে ট্রফিটা বাংলাদেশে আসায় একটু আক্ষেপ চৈতির, ‘ওরাও থাকলে একসঙ্গে ছবি তোলা যেত!’ আর ফাহমিদা হাসিমুখে বলছিলেন, ‘আমাদের চোখ দিয়েই না হয় ওরা ট্রফিটা দেখল!’

আরও পড়ুন

দেখা না হয় হলো, কিন্তু বাংলাদেশের ট্রফিটা কখনো ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন নিয়ে এ মুহূর্তে আলোচনা করা বাড়াবাড়ি। তবু কখনো কি এমন হয় যে রাতে ঘুমের ঘোরেও বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন ছুঁয়ে গেল বিশ্বনাথ-রানাদের? হয়তো হয়, তবে বিশ্বনাথের স্ত্রী চৈতির জবাবে আবেগের চেয়ে যুক্তিই প্রাধান্য পেল, ‘আগে আমরা যে পর্যায়ে আছি, সেখানে ভালো করতে হবে।’ ফাহমিদা সায় দেন, ‘আগে সাফে ভালো করতে হবে, তারপর এশিয়ায়। তারপরই না বিশ্বকাপের স্বপ্ন। স্বপ্নের তো আর শেষ নেই।’

তা নিয়ে দ্বিমত করবে কে!

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন