যুদ্ধ এভাবে চললে ইউক্রেন নিয়ে আগ্রহ হারাতে পারে পশ্চিমারা

ইউক্রেনে রুশ হামলার প্রতিবাদে প্ল্যাকার্ড হাতে পথে নেমেছেন বেলজিয়ামের মানুষ। গত ৬ মার্চ, রাজধানী ব্রাসেলসে
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে রুশ হামলার সাড়ে তিন মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে রুশ বাহিনীর যেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তেমনি পশ্চিমা অর্থ ও অস্ত্রসহায়তা পাওয়ার পরও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইউক্রেন। তবে এ সময় যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ কার্যকর হয়নি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, যুদ্ধ প্রলম্বিত হতে যাচ্ছে। আর এ পরিস্থিতি ভাবিয়ে তুলেছে ইউক্রেন সরকারকে। তাদের আশঙ্কা, প্রলম্বিত যুদ্ধের অবসাদ মস্কোর আগ্রাসন রুখতে ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমাদের আগ্রহ কমিয়ে দিতে পারে। পশ্চিমারাও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ হামলা শুরুর পর ইউক্রেনকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। ইউরোপের দেশগুলো ইউক্রেন থেকে পালিয়ে যাওয়া লাখো উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছে। ইউক্রেনে হামলার কারণে রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কারও বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোর এমন ঐক্যবদ্ধ পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার নজির খুব একটা নেই।

তবে যুদ্ধের প্রাথমিক ধাক্কা কেটে এখন তা ঢিমেতালে চলছে। চলমান পরিস্থিতি একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের দিকে গড়াচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের অনেকে। আর এটাই ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমাদের আগ্রহ কমে আসার কারণ হতে পারে। তেমনটা হলে যুদ্ধ বন্ধে মস্কোর সঙ্গে আলোচনার টেবিল বসে শর্তযুক্ত সমঝোতায় পৌঁছতে বাধ্য হতে পারে ইউক্রেন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাম্প্রতিক বক্তব্যে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘শান্তির জন্য ইউক্রেন তার নিজের শর্ত নিজেই বেছে নেবে।’ জেলেনস্কির এমন মন্তব্যে এটাই স্পষ্ট হয়, সমঝোতায় পৌঁছাতে ইউক্রেনকে প্রয়োজনে শর্ত মেনে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে মিত্ররা। আর সেই পরামর্শ মোটেও পছন্দ হয়নি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের।

ইউরোপের দেশগুলোর উদ্বেগ নতুন মাত্রা পেয়েছে। নতুন করে রুশ আগ্রাসনের ভীতি ও ইউক্রেন থেকে আসা উদ্বাস্তুদের চাপ সামলানোর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেই সঙ্গে যুদ্ধ ও মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে তেল–গ্যাসের উৎস সংকুচিত হয়ে এসেছে। বাড়ছে জ্বালানি–কাঁচামাল–খাদ্যপণ্যের দাম। অর্থনৈতিক সংকটের চোখ রাঙানি ভাবিয়ে তুলেছে এসব দেশকে, ইউরোপের মানুষদের।

ইউক্রেনে যুদ্ধের লাগাম টানতে ইতালির পক্ষ থেকে একটি শান্তি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল। প্রস্তাবটি ইতিমধ্যে খারিজ করে দিয়েছে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ। ইউক্রেনে হামলাকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলে মন্তব্য করে তুমুল সমালোচিত হয়েছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। জবাবে ইউক্রেন বলেছিল, ‘রাশিয়াকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয় বিশ্ব শক্তিগুলোর। যখন যুদ্ধ বন্ধ হবে, তখন আমরা কূটনৈতিক উপায়ে একসঙ্গে একটি পথ তৈরি করতে পারব।’

আরও পড়ুন

অন্যদিকে যুদ্ধ বন্ধে সমঝোতা আলোচনার প্রসঙ্গে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা খোলাখুলি বলেছেন, এমন আলোচনায় বসাটা ফ্রান্সসহ যেসব দেশ এর উদ্যোগ নেবে, তাদের জন্য অপমানের কারণ হতে পারে।

ইউক্রেনকে পাল্টা পদক্ষেপের কৌশলের পরিবর্তে নিজেদের ভূখণ্ডে ছাড় দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। যদিও এখন কিয়েভ চাইছে, ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলের যেসব এলাকা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, তা পুনরুদ্ধার করতে। এমনকি আট বছর ধরে মস্কোর দখলে থাকা ক্রিমিয়া ও রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা দনবাস অঞ্চল পুনর্দখল করতে চায় ইউক্রেন।

ইউরোপের দেশগুলো ইউক্রেন থেকে পালিয়ে যাওয়া লাখো উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কিন্তু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হলে ইউক্রেনের প্রয়োজন হবে বিপুল অর্থ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক পেন্টা সেন্টারের বিশ্লেষক ভলোদিমির ফেসেঙ্কো বলেন, চলমান যুদ্ধের খরচ জোগাতে প্রতি মাসে ইউক্রেনের প্রয়োজন পড়ছে ৫০০ কোটি ডলার। এটা জোগান দেওয়া কিয়েভের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দেশটি পশ্চিমা মিত্রদের ওপর ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বারবার অর্থ–অস্ত্রসহায়তা চাইছে।

যুদ্ধের খরচ জোগাতে প্রতি মাসে ইউক্রেনের প্রয়োজন পড়ছে ৫০০ কোটি ডলার। এটা জোগান দেওয়া কিয়েভের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দেশটি পশ্চিমা মিত্রদের ওপর ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বারবার অর্থ–অস্ত্রসহায়তা চাইছে।
—ভলোদিমির ফেসেঙ্কো, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক পেন্টা সেন্টারের বিশ্লেষক।

বিশ্লেষকদের অনেকের মত, আগ্রাসন রুখতে মস্কোর বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এককভাবে কার্যকর না–ও হতে পারে। সামরিক খাতে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে কিংবা জয় পেতে ইউক্রেনের আরও আধুনিক অস্ত্র সরঞ্জামের প্রয়োজন হবে। ভলোদিমির ফেসেঙ্কো বলেন, এটা স্পষ্ট যে পশ্চিমা দেশগুলোকে প্রতিহত করতে মস্কো দৃঢ়প্রত্যয়ী। এখন ক্রেমলিন এমন কৌশল নেবে, যাতে ইউক্রেনকে নিয়ে পশ্চিমারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের কৌশলে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়।

আরও পড়ুন

যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর কাছে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। এসব দেশের সংবাদমাধ্যম গুরুত্বসহকারে যুদ্ধের খবর প্রচার করেছে, করছে। বিশেষত ইউক্রেনে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে পশ্চিমের দেশগুলোয় ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের কোন সংঘাতে সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে ইউক্রেনে, এমনটাই প্রচার করা হয়েছে সর্বত্র।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের উপায় খুঁজে বের করার বিষয়ে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে একধরনের ক্লান্তি তৈরি হয়েছে। স্পষ্টতই ইইউর মধ্যে এমন কিছু দেশ রয়েছে, যারা নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপে ইচ্ছুক নয়।
—ম্যাত্তো ভিলা, থিঙ্কট্যাংক আইএসপিআইয়ের বিশ্লেষক

চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা প্রদান চলমান থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গত ৩১ মে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধে জো বাইডেন দেশটিতে সর্বাধুনিক রকেট সিস্টেম পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই অস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনকে অনেকটা এগিয়ে দেবে। নিবন্ধে বাইডেন লেখেন, ‘ভূখণ্ডগত ছাড় দেওয়ার বিষয়ে আমি ইউক্রেন সরকারকে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে কোনো চাপ দেব না।’

ইউক্রেনকে সর্বাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জার্মানিও। ইউক্রেনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এম–২৭০ পাঠানোর কথা জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের রাশিয়া ও ইউরেশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ ফেলো নাইজেল–গোউল্ড–দাভিস বলেন, স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিমাদের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ও এমন ঐক্যবদ্ধ সহায়তা প্রদানের মতো ঘটনা খুব কম দেখা গেছে।

আরও পড়ুন

এদিকে ইউরোপের দেশগুলোর উদ্বেগ নতুন মাত্রা পেয়েছে। নতুন করে রুশ আগ্রাসনের ভীতি ও ইউক্রেন থেকে আসা উদ্বাস্তুদের চাপ সামলানোর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেই সঙ্গে যুদ্ধ ও মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে তেল–গ্যাসের উৎস সংকুচিত হয়ে এসেছে। বাড়ছে জ্বালানি–কাঁচামাল–খাদ্যপণ্যের দাম। অর্থনৈতিক সংকটের চোখ রাঙানি ভাবিয়ে তুলেছে এসব দেশকে, ইউরোপের মানুষদের।

চলতি বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে জোটের দেশগুলোকে টানা চার সপ্তাহ আলোচনা করতে হয়েছে। হয়েছে নানা বাগ্‌বিতণ্ডা। এরপরও হাঙ্গেরিকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। দেশটি রাশিয়া থেকে তেল আমদানি অব্যাহত রাখতে পারবে। এতে ইউরোপীয় জোটের সদস্যদের রাজনৈতিক ঐক্যবদ্ধতায় ফাটল রয়ে গেছে বলেও মনে করছেন অনেকেই।

ইউক্রেনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এম-২৭০ পাঠানোর কথা জানিয়েছে যুক্তরাজ্য
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এ বিষয়ে মিলানের থিঙ্কট্যাংক আইএসপিআইয়ের বিশ্লেষক ম্যাত্তো ভিলা বলেন, রাশিয়ার আগ্রাসন প্রত্যক্ষ করার পরও ইউরোপের ঐক্য কমতির দিকে রয়েছে, এটা তা–ই প্রমাণ করে। তিনি আরও বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের উপায় খুঁজে বের করার বিষয়ে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের ক্লান্তি তৈরি হয়েছে। স্পষ্টতই ইইউর মধ্যে এমন কিছু দেশ রয়েছে, যারা নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপে ইচ্ছুক নয়।

আরও পড়ুন

নতুন নিষেধাজ্ঞার অর্থনৈতিক অভিঘাতের বিষয়টি ভাবছে ইউরোপ। কেননা, ইতিমধ্যে ইউরোপবাসীর গাড়ির জ্বালানি খরচ, বাড়ির বিদ্যুৎ বিল, খাবারের ব্যয়—সবই বেড়েছে।

এই পরিস্থিতিতে জনগণ যাতে বিক্ষুব্ধ হয়ে না ওঠে, ইউক্রেনের প্রতি তাদের সহানুভূতিতে যাতে ভাটা না পড়ে, সে জন্য দেশগুলোর সরকার তৎপর হয়ে উঠেছে। ইউরোপীয় কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, রাশিয়ার গ্যাস খাতের ওপর বিস্তৃত নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে তারা তাড়াহুড়া করবে না।

ইতালির ডানপন্থী নেতা মাত্তিও সিলভানি গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেন, মস্কোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় ইতালীয়দের সমর্থন রয়েছে। ইউক্রেনের প্রতি তাদের সহানুভূতি রয়েছে। তিন মাস পর পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না।

যদি আগামী সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনে যুদ্ধ চলমান থাকে, তবে সেটা ইতালীয়দের জন্যও বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

আরও পড়ুন