
ছেলের চোখে জ্বালা–যন্ত্রণা, বিষ–বেদনা ছিল না। তাই একটু আশা ছিল, ছেলে অল্প হলেও হয়তো দেখতে পাবে। কিন্তু...এটুকু বলেই মুঠোফোনে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে কান্না সামলে মারুফ ইসলাম বলেন, ‘আমার ছেলে ডান চোখে নাকি কিছুই দেখে না। পাঁচ থেকে ছয়জন ডাক্তার ছেলের চোখের আলট্রাসনোগ্রামসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করলেন। চোখের সামনে ডাক্তার আঙুল দেখালেন, কয়টা আঙুল কিন্তু ছেলে তা বলতে পারল না। ছবিও দেখতে পেল না। বাসায় এনে আমি নিজেও বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করলাম। বাঁ চোখ বেঁধে মোবাইল হাতে দিলাম, ছেলে তো কিছুই দেখে না।’
মারুফ ইসলাম পাঁচ বছর বয়সী আজমীরের বাবা। গত ১৫ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলস্টেশনের হোম সিগন্যালের কাছে বাইরে থেকে আসা পাথর ট্রেনের জানালার কাচে লাগে। কাচ ভেঙে সেই পাথর আজমীরের চোখে আঘাত করেছিল। দুর্ঘটনার পর কয়েক হাসপাতাল ঘুরে রাজধানীর ফার্মগেটের ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে আনার পর আজমীরের চোখের (কর্নিয়া) অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। চিকিৎসকেরা তখনই জানিয়েছিলেন, ছেলের দৃষ্টিশক্তি আস্তে আস্তে কমতে থাকবে।
গতকাল শনিবার ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে ফলোআপের জন্য এসেছিলেন মারুফ ইসলাম। তারপরই চিকিৎসকেরা যে ঘোষণা দিলেন, তা শোনার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। মুঠোফোনে তিনি বারবার বলতে থাকেন ‘আমার ছেলের সারাটা জীবন সামনে পড়ে রয়েছে। রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ, তাই সব সময় ট্রেনে যাতায়াত করি। টিকিট করে ট্রেনে চড়ে তো আর আমি বা আমার ছেলে কোনো অপরাধ করিনি। অথচ আমার ছেলের চোখটাই নষ্ট হয়ে গেল।’
নীলফামারীর ডোমার উপজেলার মাছের হ্যাচারি ব্যবসায়ী মারুফ ইসলামের ছোট ছেলে আজমীর। মারুফ একাই ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। তিনি বলেন,‘ছেলের মা বাড়িতে আছে। বারবার জানতে চায়, ছেলের অবস্থা কেমন? আমি তাঁকে খবরটা জানাতে পারছি না। অথচ খবরটা তো ওকে দিতে হবে।’
মারুফ ইসলাম বলেন, ‘ঘটনার দিন স্টেশনে পৌঁছাতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি ছিল। স্টেশনের কাছেই আমার বাড়ি। ঘটনার পর ছেলেকে নিয়ে কত সংবাদ প্রচার হলো, অথচ ট্রেনের কেউ আমার বাড়িতে গিয়ে একবার খোঁজও নিল না, আমার ছেলের চোখটা কেমন আছে। মামলার প্রয়োজনে শুধু দুই দিন ফোন করছে।’
ঘটনার পর আজমীরের কর্নিয়া অপারেশনসহ এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে এক লাখ টাকার বেশি। আজ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বাবা ছেলেকে দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করাতে চাইলে করাতে পারেন, তবে এতে চোখ ভালো হয়ে যাবে সে ধরনের নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। তবে এ বাবা তাঁর সাধ্য অনুযায়ী দেশে ও দেশের বাইরে নিয়ে ছেলের চোখ পরীক্ষা করানোর চেষ্টা করবেন মনের সান্ত্বনার জন্য।
ট্রেনের যাত্রী বা ট্রেনের কর্মী বাইরে থেকে ছোড়া পাথরের আঘাতে কেউ চোখ হারাচ্ছেন, কেউ অল্পের জন্য রক্ষা পাচ্ছেন। আর ঘটনাগুলোতে ভীতি তৈরি করছে অন্য যাত্রী ও ট্রেনের কর্মীদের মনে। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে রেলপথ মন্ত্রণালয় এক সংবাদ সম্মেলনে চলন্ত ট্রেনে বেশি পাথর মারা হয়—এমন ১৫টি স্থান চিহ্নিত করার কথা জানিয়েছে। ট্রেনের জানালায় নেট লাগানোর চিন্তাভাবনাও করছে মন্ত্রণালয়। গত ১৩ সেপ্টেম্বর কেউ পাথর ছুড়ছে, এমন ছবি তুলে দিলে অথবা প্রত্যক্ষদর্শীদের জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করেছে রেলওয়ে পুলিশ। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রেলওয়েতে গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ১১০টি। এতে ট্রেনের জানালার কাচ ভেঙেছে ১০৩টি এবং আহত হয়েছেন ২৯ জন।
১৮৯০ সালের রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় শাস্তির বিধান আছে। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের জন্য ১০ হাজার টাকা জরিমানার পাশাপাশি ১০ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। আর কোনো রেলযাত্রী মারা গেলে ৩০২ ধারায় ফাঁসিরও বিধান আছে। পাথর নিক্ষেপকারী অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে, সে ক্ষেত্রে তার অভিভাবকের শাস্তির বিধান আছে।
আজমীরের বাবা মারুফ ইসলাম ঘটনার আকস্মিকতায় মামলা করার কথা ভাবতে পারেননি। ছেলের সুস্থতার বিষয়টি বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছিল সে সময়। আজমীরের ঘটনার পর ১৬ আগস্ট সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনের সহকারী স্টেশনমাস্টার ময়নুল হোসেন বাদী হয়ে সৈয়দপুর রেলওয়ে থানায় (মামলা নম্বর ১) ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের ৪২৭ ও ১৮৯০ সালের রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় পাথর নিক্ষেপ করে যাত্রীকে গুরুতর জখম এবং ট্রেনের জানালার গ্লাসের ক্ষতির বিষয়টি উল্লেখ করে মামলা করেন। মামলার আসামি অজ্ঞাতনামা। জানালার গ্লাসের ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে আনুমানিক পাঁচ হাজার টাকা।
মামলার অগ্রগতি প্রসঙ্গে মারুফ ইসলাম বলেন, এ মামলায় কিছু হবে না। অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে ধরেছিল, পরে আবার ছেড়েও দিয়েছে পুলিশ।
ছেলের চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার খবর শুনে দিশেহারা বাবা মারুফ ইসলাম বলেন, ‘আমি আমার ছেলের চোখের ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট করব। আমি এমনি ছেড়ে দেব না রেল কর্তৃপক্ষকে। আমার ছেলের ঘটনার পর আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে বলে গণমাধ্যমের খবর থেকে জেনেছি।’
৫ অক্টোবর রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সংবাদ সম্মেলনে সার্বিক পরিস্থিতি জানিয়েছি। বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছি। এখন দেখা যাক, এসবে সুফল মেলে কি না। একটু সময় তো লাগবেই, আর পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটাচ্ছে শিশু না হয় মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরা।’