
টেলিভিশনে বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলা চলছে। দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে ভিড় জমিয়ে খেলা দেখছেন অনেকে। দুজন রিকশাচালককেও দেখা গেল, রিকশা থামিয়ে খেলা দেখছেন। এত সব ডামাডোলেও দোকানের ভেতরে থাকা কয়েকজন সেলাই-কারিগর মগ্ন কাজে। গড়গড় শব্দে অবিরাম চলছে মেশিন। ব্যস্ত কারিগরদের একজন মাঝেমধ্যে টেলিভিশনে চোখ রাখলেও, কাজ ফেলে খেলা দেখতে বসার এতটুকু ফুরসৎ নেই।
এ চিত্র পুরান ঢাকার ওয়ারীর একটি টেইলার্স বা দরজি দোকানের। রাজধানীর সব দরজি দোকানেই এখন অভিন্ন চিত্র। ঈদে নিজেদের পছন্দানুযায়ী নতুন পোশাকের ফরমাশ দেওয়াটা শুধু ঐতিহ্যই নয়, অনেকটা রীতিতে পরিণত হয়েছে।
পবিত্র রমজানের পাঁচ দিন কেটেছে। রাজধানীর দরজি দোকানগুলোতে এখনই ঈদকেন্দ্রিক ব্যস্ততা তুঙ্গে। গভীর রাত পর্যন্ত ঘুরছে দরজিঘরের চাকা। এরই মধ্যে বেশ কিছু অভিজাত প্রতিষ্ঠান ফরমাশ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে শবে বরাতের আগে থেকে বন্ধ করা হয়েছে কারিগরদের ছুটি।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ১০-১২টি দরজি দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, ১৫ রমজানের পর আর ফরমাশ গ্রহণ না করার নোটিশ টানানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, ঈদ সামনে রেখে এসব প্রতিষ্ঠানে পোশাক তৈরির মজুরিও বাড়ানো হয়েছে কিছুটা। কোনো কোনো দরজি দোকানে কাজের চাপ সামলাতে মৌসুমি কারিগর আনা হয়েছে বিভিন্ন জেলা থেকে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, আজ শনিবার ৬ রমজান থেকে দরজি দোকানের ব্যস্ততা পুরোদমে বাড়বে। সরেজমিনে দেখা যায়, দরজিপাড়া হিসেবে খ্যাত রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের রমনা ভবন, মৌচাক মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, রাজধানী সুপার মার্কেট, ফার্মগেট, নীলক্ষেত ও গাউসিয়া মার্কেটের ইসমাইল ম্যানশনসহ ওই এলাকার কারিগরদের এক মুহূর্তের অবসর নেই। পুরান ঢাকার ঠাঁটারীবাজার, বংশালসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় পাঞ্জাবি-পাজামার দোকানগুলোতেও একই চিত্র।
রমনা ভবনে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান স্টার টেইলার্সের নকশাকার (মাস্টার) আবদুল লতিফ বলেন, সম্পূর্ণ তৈরি পোশাক (রেডিমেড) অনেকের শরীরে ভালো ফিট হয় না। তাই নিজেদের পছন্দমতো পোশাক বানাতে তাঁদের আসতে হচ্ছে দরজি দোকানে। তিনি আরও জানান, রমনা ভবন মার্কেট, ইসলামপুর, এলিফ্যান্ট রোডসহ বিভিন্ন বিপণিকেন্দ্র থেকে পছন্দের পোশাকের থানকাপড় কিনে ক্রেতারা আসছেন দোকানে। কাল (আজ) থেকে অর্ডার আরও বাড়বে। কেননা, প্রথম সপ্তাহটা অনেকে ভেবেচিন্তে কাটিয়ে দেন। তাঁর তথ্যনুযায়ী, এবারও তরুণেরা ফলো করছেন শাহরুখ, সাইফ, সালমান, অক্ষয় কুমার ও রণবীর কাপুর স্টাইলের বিভিন্ন শার্ট-প্যান্ট। পাশাপাশি বিশ্বকাপে খেলোয়াড়দের মাঠের বাইরের পোশাক ও কোচদের পোশাকের নকশা চাইছেন গ্রাহকেরা।
এবার মেয়েদের সবচেয়ে বেশি পছন্দ লং কামিজ। আর এ ক্ষেত্রে তরুণীদের বেশি পছন্দ ক্যাটরিনা, কারিনা, সোনাক্ষী সিনহা, শ্রদ্ধা কাপুর,¯ দীপিকা পাড়ুকোন, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, সোনম কাপুর স্টাইলের বিভিন্ন পোশাক। ভজহরি সাহা স্ট্রিটের তাসলিমা টেইলার্সের শাহিন জানান, অনেকে এসব নায়ক-নায়িকার ছবির ক্যাটালগ নিয়ে দরজি দোকানে পছন্দমতো পোশাক তৈরির ফরমাশ দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকার লাইফস্টাইল ফিচার পাতা নিয়ে আসেন দোকানে। সেখানকার মডেলদের গায়ে জড়ানো জামার নকশার অর্ডার দেন তাঁরা।
নীলক্ষেতের বাকুশা মার্কেটের চয়নিকা টেইলার্সের মালিক খোরশেদ আলম জানালেন, কারিগরদের মজুরি, দোকান ভাড়া, সুতা ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় পোশাক বানানোর মজুরি কিছুটা বাড়াতে হয়েছে।
গতকাল দুপুরে রাজধানী সুপার মার্কেট এলাকায় কাপড় কিনতে আসেন ওয়ারীর পারভীন আক্তার ও রুবি আক্তার। তাঁরা দুজনই দাবি করেন, এবার জামা বানানোর মজুরি অনেক বেশি। এক সেট থ্রিপিস বানাতে মজুরি লাগছে ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, পল্লবী ও উত্তরার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শপিং মলে দরজির মজুরি কয়েক হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে।
ফরমাশ দেওয়ার ব্যবস্তা থাকলেও এখনই ডেলিভারি নিচ্ছেন না গ্রাহকেরা। বেশির ভাগ ডেলিভারিই হবে ঈদের আগের সন্ধ্যায়, অর্থাৎ চাঁদ দেখে অনেকে ভিড় করবেন নতুন জামাকাপড়ের জন্য। এতে করে অন্যদের চমকে দেওয়ার সুযোগও থাকে বৈকি!