
ফেসবুক—মার্ক জাকারবার্গের এই সৃষ্টিতে তামাম দুনিয়ার মানুষ মন ও প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে অর্থকড়িও সঁপে দিচ্ছে। অর্থাৎ, এটি এখন নিজেকে অন্যভাবে দেখার বা দেখানোর এবং পেটে দানাপানি দেওয়ারও উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু জাকারবার্গের ফেসবুকে আমাদের অনেকের চরিত্র আসলে কেমন?
আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ এখন ফেসবুকবাসী। এ দেশের কোটি কোটি মানুষের একটি হলেও ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট আছে। তারা লাইক-কমেন্ট-শেয়ারের খেলায় মাতে। কিছুদিন আগে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের উপস্থিতিতে ফেসবুক ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) মধ্যে বিনিয়োগসংক্রান্ত ভার্চ্যুয়াল বৈঠক হয়। তাতে জানানো হয়েছে, ৪ কোটি ৮০ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে বাংলাদেশে।
ফেসবুকের শুরুটা হয়েছিল নিখাদ সামাজিক যোগাযোগের মঞ্চ হিসেবে। ব্যস্ত পৃথিবীর ততোধিক ব্যস্ত সমাজে বিকল্প যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এটি সৃষ্টি হয়েছিল। এখন তা হয়ে উঠেছে মহিরুহ। এতটাই যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ফেসবুক বিপ্লব ও আন্দোলনের মঞ্চ হয়ে উঠেছে। কিছু ক্ষেত্রে হয়ে উঠছে ই-কমার্সের ভিত্তি। ফেসবুকের নিজেদের হিসাব অনুযায়ী, এর মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারী এখন ২৯০ কোটি। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী এই পরিমাণ অ্যাকাউন্ট থেকে মাসে একবার হলেও ফেসবুকে লগইন করা হয়।
সুতরাং আমাদের দেশেও ফেসবুককে ভিত্তি করে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরে হচ্ছে ট্রল এবং ঘৃণা বা বিদ্বেষসূচক বাক্যের অবাধ ব্যবহারও। যদিও ট্রল নির্দোষ হতে পারে, তবে ঘৃণা কখনো নয়। বরং আমাদের দেশে প্রায় সময় ট্রলকে উপচে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সামনে চলে আসে। এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমাদের অনেকের মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
উদাহরণ চান? ভূরি ভূরি আছে। তবে এদেশীয় ফেসবুক অঙ্গনে বাড়তি যা আছে, তা হলো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সীমাহীন বিষোদ্গার। আর পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজ নারীদের ঘটনার শিকার বা ঘটনার কারণ, যে হিসেবেই পাক, সেটিকে অস্ত্র বানাতে সিদ্ধহস্ত। উদাহরণ কটি প্রয়োজন? নিকট অতীতের যেকোনো নারী নির্যাতনের ঘটনার সংবাদ দেখতে পারেন। সেসব সংবাদ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে সাধারণত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোই শেয়ার দিয়ে থাকে। আর সেসবের নিচে এদেশীয় ফেসবুকপ্রবাসীদের মন্তব্য পড়লে কখনো কখনো এমনও মনে হতে পারে, সব অপরাধের গোড়া বুঝি স্রেফ লিঙ্গভিত্তিক।
যেমন ধরুন, নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি যদি কোনো নারী হন, তবে শুরুতেই খুঁজে বের করার চেষ্টা হয়, তাঁর কী কী দোষত্রুটি আছে; সেই ত্রুটি পুরোটাই উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা যদিও। তবে কানকথায় প্রবল মনোযোগ দেওয়ার যে চল ভার্চ্যুয়াল সমাজে তৈরি হয়েছে, সেটিই অনেক মিথ্যাকে সত্যি বানিয়ে দেয়। আর এরপর শুরু হয় সেই চরিত্রকে নানা প্রকারে ভার্চ্যুয়ালি লাঞ্ছিত করা। সেই ‘জোশ’ দেখলে মনে হতে পারে, তারা হয়তো নিজেদের রায়ে তৈরি অপরাধীকে সামনে পেলে নিজেদের বিচার অনুযায়ী শাস্তিও দিয়ে দেবে। অপরাধের কারণ নারী হলে তো কথাই নেই। সে ক্ষেত্রে আর কষ্ট করে দোষ খুঁজে বের করতে হয় না। গণমাধ্যম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে যা বলে, তাতে শুধু নানা রং চড়িয়ে দেওয়া হয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে।
অর্থাৎ বাংলাদেশের ফেসবুক সমাজে লৈঙ্গিক পরিচয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে অশালীন, নোংরা ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও অভিমত প্রদানের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে তনু থেকে পরীমনি—সবাই একই আচরণ পেয়ে থাকেন এ দেশে। একইভাবে এ অঞ্চলে নারীদের ব্যাপারে বেশির ভাগ পুরুষ আদতে কেমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকে, তারও লজ্জাজনক প্রদর্শনী হয় বারবার।
এবার আসা যাক সাধারণ তারকাদের বিষয়ে। ফেসবুকে তাঁরাও বিড়ম্বনার শিকার হন বারবার। এ দেশে টিভি বা চলচ্চিত্র থেকে ক্রিকেট তারকা, সবাই-ই এ বিষয়ের মুখোমুখি হয়েছেন কোনো না কোনো সময়। যেমন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী কিছুদিন আগে হলেন। জনপ্রিয় ক্রিকেটাররাও কথিত ফলোয়ারদের অপমানসূচক মন্তব্য ও আচরণ পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা, ব্যক্তিগত আক্রমণ থেকে শুরু করে চরম অবমাননাকর মন্তব্যও আমাদের নেটিজেনরা করে থাকে। বিষয়টা অনেকটা এমন, ‘ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আমার, যা খুশি তা–ই করার অধিকার আমার আছে’ ঘরানার।
আচ্ছা, এ দেশের অনেক ফেসবুকারের এমন ধারা আচরণ কি কোনো হতাশা থেকে তৈরি হয়েছে? তারা যেটা বাস্তবিক সমাজে করে না, সেটি কেন ভার্চ্যুয়ালি করছে? চোখের সামনে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে দেখলে যে হাত ব্যস্ত হতো হাত মেলাতে, সেই হাতই ফেসবুকে গিয়ে টাইপ করছে অশ্রাব্য গালিগালাজ। কিন্তু কেন? আশা করি, এ বিষয়ে একদিন পর্যাপ্ত গবেষণা হবে এবং আমরা আমাদের এহেন চরিত্রের মূল সার জানতে পারব।
আশা করছি, কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব ও সেই সঙ্গে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমাজের বদলে যাওয়া চিহ্নিত করছে। ফেসবুক যেমন সুচিন্তিত আন্দোলনের সূচনা করে, তেমনি অযাচিত সংঘাতও বয়ে আনতে পারে। কোনটি কোন সমাজে বেশি হচ্ছে, তার ওপরই নির্ভর করবে সেই সমাজে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কার্যকারিতা।
কয়েক বছর আগে পিউ রিসার্চের এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম যে দিন দিন ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর মাধ্যম হয়ে উঠছে, তা আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে যেতে পারে। কারণ, মানুষ তার ক্ষোভ, ঘৃণা প্রকাশ করার উন্মুক্ত মঞ্চ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে বেছে নিতে শুরু করেছে। এই ক্রোধ, ঘৃণা, উদ্বেগ একপর্যায়ে ক্ষমতা ও অর্থের জোগান অব্যাহত রাখতে সহায়তা করে। ফলে, ক্ষমতাশালীরা সব সময়ই এ ধরনের কাঠামো ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়।
এদিকে করোনার এই মহামারি এমন প্রবণতাকে আরও উসকে দিয়েছে। এক্সিওস ডট কমে গত মার্চ মাসে প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়েছে, করোনার মহামারির মধ্যে অপেক্ষাকৃত তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বেশি সময় কাটাচ্ছে এবং তারা ঘৃণা ও বিদ্বেষের মুখোমুখি হচ্ছে প্রবলভাবে। ২০১৮ সালের তুলনায় বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য বেড়ে ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে, যা আগে ছিল ১২ শতাংশ। একই সময়ে সেক্সিস্ট মন্তব্য ১৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ২১ শতাংশ।
একই অবস্থা এ দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যেও বিরাজমান। প্রমাণ পাওয়াও খুব সহজ। তবে পরিমাণ কতটা, সেটি জানতে গবেষণা ও জরিপের বিকল্প নেই। তবে আমরা হয়তো নিজেদের চরিত্র উদ্ঘাটনের ভয়েই তাতে নজর দিচ্ছি কম। নিজেদের অন্ধকার দিক কে আর জানতে চায়, বলুন?
শেষটায় আবার মার্ক জাকারবার্গের কথায় ফিরে আসি। সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন মেটাভার্স বিষয়ে। ফেসবুক আসলে বলছে এক ভার্চ্যুয়াল ইউনিভার্সের কথা, যেখানে ব্যবহারকারীর নিজস্ব অবতার থাকবে। সেই জীবনটা হবে নিজের ইচ্ছেমাফিক। আরও সহজ করে বলতে গেলে আনতে হবে ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া স্টিভেন স্পিলবার্গের ছবি ‘রেডি প্লেয়ার ওয়ান’-এর প্রসঙ্গ। সেখানে দেখা গিয়েছিল এক নতুন ভার্চ্যুয়াল পৃথিবী, ভিআর প্রযুক্তিতে যাতে যুক্ত হতো মানুষ। পর্দার সেই কল্পনা এবার বাস্তব করার প্রত্যাশা জানাচ্ছে ফেসবুক।
যদিও কতটা কী হবে, সেটি এখনই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। তবে ধরুন, এমন ভার্চ্যুয়াল পৃথিবী তৈরি হয়েই গেল। এ দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অসংখ্যজন তখন কি শুধু অসভ্য বখাটের অবতারই পছন্দ করবে?