প্রকৃতি

শত বছরের ছায়া

শতবর্ষের আমগাছ। ২ জুলাই মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারে কাগজি বাড়িতে।
 প্রথম আলো

শত বছর আগের চৈত্র মাসের এক দুপুর। কাউয়াদীঘি হাওরের বুকে আরও অনেকের সঙ্গে লাঙল দিয়ে আমনের জমিতে চাষ দিচ্ছিলেন অল্প বয়সী এক কৃষক। সারা শরীর তাঁর রোদে পুড়ছে। একটুখানি ছায়া খুঁজছিলেন, কিন্তু কোথাও এক টুকরা ছায়াও নেই। না আছে আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘ, না আছে কোনো গাছ।

সে রকম মুহূর্তে যুবক কৃষকটি মনে মনে ঠিক করলেন, এই খোলা প্রান্তরে গাছ রোপণ করতে হবে। সেই গাছের ছায়ায় বসে একটুখানি জিরিয়ে নেবেন হালচষা কৃষক, বিলে-ঝিলে থাকা মাছধরা জেলে, গরু-মোষ চরানো রাখাল। একদিন আমগাছের কয়েকটি চারা পুঁতে দিলেন একচিলতে উঁচু ভিটায়। তাঁর পুঁতে দেওয়া গাছের চারাগুলো হাওরের ঝোড়ো বাতাসকে বুকে নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াল।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের কাগজি বাড়ি নামে পরিচিত জায়গাটিতে গলাগলি করে সবুজ ছাতার মতো দুটো গাছ এখনো দাঁড়ানো। এখানে কোনো এক সময় হয়তো বাড়ি ছিল। আরও গাছ ছিল। এখন আর বাড়ি নেই। অন্য সঙ্গী-সাথিদের হারিয়ে শুধু এই দুটো গাছ টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।

২ জুলাই বিকেলে কাগজি বাড়িতে যাওয়ার পথে গ্রামের মধ্যে বেশ কয়েকজন মানুষের সঙ্গে দেখা। তাঁরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নানা কথায় মজে আছেন। আমগাছ নিয়ে কথা উঠতেই সরব হয়ে ওঠেন। বলতে থাকেন গাছটির জন্মের কথা। একাটুনা ইউনিয়নের হাতিম মিয়া নামের এক ব্যক্তি এই আমগাছগুলো রোপণ করেছিলেন। মূলত এই স্থানটিতে কোনো গাছ ছিল না। যাঁরা কৃষিখেত করতেন, মাছ ধরতেন, গরু-মহিষ চরাতেন, তাঁরা যাতে প্রখর রোদের সময় গাছের নিচে বসে একটু ছায়া পান, বিশ্রাম নিতে পারেন—এটাই ছিল তাঁর ইচ্ছা। হাতিম মিয়া প্রায় ১০০ বছর বয়সে মারা গেছেন। তা-ও প্রায় ৩০ বছর আগে।

গ্রামের মো. তোয়াহিদ (৬৪) বললেন, ‘চৈত্র মাসে ধুলিয়া খেতো (শুকনা বোনা আমনের জমি চাষ) রোদে ধরছে হাতিম মিয়ার। কুনু (কোনো) ছায়া আছিল (ছিল) না। ওই গাছ রুইছলা (এই গাছ রোপণ করেন)।’

গাছের কাছে যাওয়ার সময় সঙ্গে যোগ দিলেন স্থানীয় অনেক কিশোর-তরুণ। তাঁরা জানালেন, গাছ দুটো এখনো সজীব, সপ্রাণ। প্রতিবছরই আম ধরে। এবারও আম এসেছিল। এখানে যাঁরা বিশ্রাম নেন, তাঁরা শুধু ছায়ার সুখই পান না, কাঁচা-পাকা আমও খেতে পারেন। এ এক অন্য রকমের শান্তি, স্বস্তি। এখানে হয়তো কেউ ফেলে আসা সময়ের পাঠ্য কিছু লিখে রাখেনি। দিগন্তের কাছে একলা দাঁড়ানো গাছ দুটোই শরীরে, পাতায় শত বছরকে ধরে আছে নীরবে, নিভৃতে।

এখন গাছের আশপাশে হাওরের জলভরা ঢেউ থাকার কথা। কিন্তু এবার বৃষ্টি কম, হাওরের বুকে জলের থইথই ঢলাঢলি নেই। হাওয়া এলে পাতারা ঝিরিঝিরি মৃদু কোলাহলে নীরবতা ভাঙছে। ডানায় সন্ধ্যার আলো মেখে ফিরে আসে পাখিদল। হাতিম মিয়ার মতো লোকজন হয়তো এ রকমই। তাঁরা নিজেরা কিছু পাওয়ার লোভে নয়, একটি লোকায়ত মানবিক সমাজকে বহুদূর এগিয়ে নিতে এমন কিছু করেন, যা শত শত বছর ধরে মানুষকে ছায়া দিয়ে যায়। সুন্দর নির্মাণের পথ দেখিয়ে যায়।