
মিথ্যা ও অশ্লীল, নীতিভ্রষ্টতা, মানহানি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি—এই শব্দগুলো ব্যবহার করে এ বছরের প্রথম ছয় মাসে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় দেশের বিভিন্ন জেলায় কমপক্ষে ২০টি মামলা হয়েছে। আইন প্রণয়নের শুরু থেকে মানবাধিকারকর্মীরা বলে আসছিলেন, শব্দগুলোর ব্যাখ্যা না থাকায় অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে, হচ্ছেও তাই।
২০১৫ সালে সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের ও তাঁকে গ্রেপ্তারের পর ধারাটি বাতিলের জন্য বিভিন্ন পক্ষ থেকে দাবি ওঠে। ধারাবাহিকভাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ধারাটি বাতিল হবে—এমন প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত এটি বহাল আছে এবং এর ব্যবহারও হচ্ছে। গত বছর এই আইনের ৫৭ ধারা ব্যবহার করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আসামি হয়ে কমপক্ষে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জেল খেটেছেন, একজন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার হয়েছেন। কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করে মামলার আসামি হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ভুক্তভোগীদের তালিকায় মৎস্যজীবী এবং সাংবাদিকও রয়েছেন।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় সর্বশেষ মামলাটি হয়েছে গত মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের সাংবাদিক গোলাম মুজতবার বিরুদ্ধে। মামলাটি করেন মানিকগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সহকারী বিচারক মো. মাহবুবুর রহমান। মানিকগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাবিবুল্লাহ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার বাদী অভিযোগ করেছেন, ‘ওই সাংবাদিক মিথ্যা, বানোয়াট ও অসত্য তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন লেখায় বাদীর মানহানি হয়েছে।’ ১১ জুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরে ‘একটি অসুস্থ শিশু, বিচারকের ট্রাক ও একটি মামলা’ শিরোনামে গোলাম মুজতবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
মানিকগঞ্জে মামলা দায়েরের এক দিন আগে ১২ জুন বানিয়াচং থানায় মামলা হয় হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি ও হবিগঞ্জ সমাচার সম্পাদক ও প্রকাশক গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে। হবিগঞ্জ সমাচার-এ ৮ জুন কয়েকটি অনলাইন পত্রিকার বরাত দিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়, ৮০ জন সাংসদ মনোনয়ন থেকে বাদ পড়তে পারেন। ওই তালিকায় হবিগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ আবদুল মজিদের নাম ছিল। প্রতিবেদন প্রকাশের পর আবদুল মজিদ খানের ভাইপো ও পুকুড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আফরোজ মিয়া ‘মানহানি’র অভিযোগে বানিয়াচং থানায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেন।
গত ২৮ জানুয়ারি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সদ্য স্থগিত কমিটির সভাপতি মেহেদি হাসান শিশির ডলার নামের এক ব্যক্তিসহ সাত-আটজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। রংপুর কোতোয়ালি থানায় করা ওই মামলার এজাহারে মেহেদি ইউটিউব ও ফেসবুকের মাধ্যমে তাঁর ‘মানহানি ও ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ন করার অভিযোগ আনেন।
জানা গেছে, ডলার যে ভিডিও চিত্র ছড়ান, সেটিতে মেহেদি ইয়াবা সেবন করছেন এমন একটি দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল।
রংপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ বি এম জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সে (মেহেদি) তো প্রথমে আমাদের বলেছে, তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ভিডিও করেছে। পরে আমরা তদন্ত করে দেখলাম সে আসলে নেশা করে। ডলারকে আমরা ধরেছিলাম। সে এখন জামিনে আছে।’
‘অসত্য বক্তব্য’ দেওয়ার অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, শিক্ষক ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে লে. জেন ারেল (অব.) মাসুদ উদ্দীন চৌধুরী, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা’র জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের শিক্ষার্থী ও ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক সম্পাদক চায়না পাটোয়ারী ও ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য শাওন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ কর্মী এহসান উদ্দীন চৌধুরী ঋতু চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’ এই ধারার অপরাধগুলো আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য। তবে আদালতের বিবেচনায় আসামি জামিন পেতে পারেন।
দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেরিতে হলেও আসামিরা জামিন পাচ্ছেন। প্রশ্ন উঠছে, অপরাধ যদি সত্যিই গুরুতর হয়, তাহলে জামিন হচ্ছে কী করে?
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫৭ ধারায় যে অপরাধগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করা হয়নি। যেমন ধরুন “রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন”। এ দিয়ে কী বোঝা যায়? যেহেতু সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করা হয়নি, ফলে কেউ মনঃক্ষুণ্ন হলেই মামলা করছেন। আইনটি যে অবস্থায় আছে এবং যেভাবে ব্যবহার হচ্ছে তা বিপজ্জনক।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বারবার বলছি কারও মানহানির অভিযোগে যেন ফৌজদারি মামলা না হয়।’
মামলার বাদী যাঁরা
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০১৬ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে ৩৫টি মামলা দায়েরের তথ্য দেওয়া হয়েছে। এই মামলার ১৬টি প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ‘মিথ্যা ও অশ্লীল’ মন্তব্য করা ও ছবি বিকৃত করার দায়ে। মামলাগুলো দায়ের করেছেন মূলত ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
সাংসদদের ‘মানহানি’তেও মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন তাঁদের অনুসারীরা। তাঁরাই মামলা করেছেন। গত বছরের নভেম্বরে হবিগঞ্জের দৈনিক প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক শোয়েব চৌধুরী আনন্দবাজার পত্রিকাকে উদ্ধৃত করে ‘হবিগঞ্জের সাংসদসহ ৬৫ জন সাংসদকে মনোনয়ন দেবেন না শেখ হাসিনা’ নামে একটি প্রতিবেদন ছাপেন। ওই ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় আলাদাভাবে চারটি মামলা হয়। তিন মাস জেল খেটে ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি জামিনে মুক্ত হন। ওই মামলার বাদীদের তিনজনই আওয়ামী লীগের কর্মী।
শোয়েব চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি হবিগঞ্জ জেলে তিন মাস আটক থাকার পর জামিন পাই। এখন কিছু লিখতে গেলেই ভয় হয়, আবার না ৫৭ ধারায় আটকায়।’
৫৭ ধারা রহিত হবে কবে?
ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে ফাঁসিয়ে দিতে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পটিয়ার একটি সরকারি কলেজের শিক্ষক মাসুদ রেজা প্রথম আলোকে বলেন, বরগুনার আমতলী কলেজটি গত বছরের ৭ এপ্রিল জাতীয়করণ করার পর তাঁকে চাখার শের-ই-বাংলা কলেজ থেকে অধ্যক্ষ হিসেবে বদলি করা হয়। পুরোনো শিক্ষকদের কেউ কেউ এতে খেপে যান। এর মধ্যে একদিন তিনি অসাবধানতাবশত লগআউট না করে বেরিয়ে যান। তাঁর আইডি ব্যবহার করে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর নামে কটূক্তি করা হয়। পরে ওই কলেজের একজন শিক্ষক আদালতে মামলা করেন। আদালত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ায় তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছেন বলে জানান।
গত বছরের ২৯ অক্টোবর ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা’র অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মৎস্যজীবী রসরাজের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনটির যেন কোনো অপব্যবহার না হয়, সে জন্য কী করা যায় আমরা ভাবছি। ডিজিটাল সুরক্ষা আইন নামে নতুন একটি আইন হচ্ছে। আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলছি।’
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সচিব সুবীর কিশোর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আইনের খসড়াটি ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। সপ্তাহ তিনেক আগে এ নিয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। ভেটিংয়ের পর আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। তবে কবে নাগাদ মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে, তা তিনি জানাননি।
তবে প্রস্তাবিত ডিজিটাল সুরক্ষা আইনের খসড়া নিয়ে সমালোচনা আছে। আইনজীবীরা বলছেন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা সংশোধন করলে আর নতুন আইনের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু ডিজিটাল সুরক্ষা আইন হচ্ছে, হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৫৭ ধারাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি শাহাদৎ হোসেন)