মায়ের সঙ্গে নুহাশের জন্মদিন (১ জানুয়ারি) উদ্‌যাপন। ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪
মায়ের সঙ্গে নুহাশের জন্মদিন (১ জানুয়ারি) উদ্‌যাপন। ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

গুলতেকিন খান ও নুহাশ হুমায়ূনের সঙ্গে আলাপ

চিত্রনাট্যকার মা ও পরিচালক ছেলে

পেট কাটা ষ–এর দুটো ভৌতিক সিরিজ বানিয়ে শুধু দেশের নয়, দেশের বাইরের দর্শকদেরও মাত করে দিয়েছেন নুহাশ হুমায়ূন। এর দ্বিতীয় সিরিজে ছেলে নুহাশের সঙ্গে চিত্রনাট্যকার হিসেবে যোগ দিয়েছেন মা গুলতেকিন খান। মা ও ছেলের সঙ্গে আলাপে বসেছেন সাজ্জাদ শরিফ। 

প্রশ্ন

গুলতেকিন খানকে দিয়ে শুরু করি। পেট কাটা ষ–এর প্রথম সিজনে আপনার ভূমিকা কী ছিল? আপনি কি নিছকই দর্শক ছিলেন?

গুলতেকিন খান: নুহাশ কোনো গল্প লিখলে সেটা প্রথমে আমাদেরই শোনায়। আমাকে একা না; আমি, নোভা আর নোভার সন্তানদেরও। আমাদের কেমন লাগছে, নুহাশ সেই প্রতিক্রিয়া দেখার আর বোঝার চেষ্টা করে। পেট কাটা ষ–এর প্রতিটি গল্পই সে আমাদের শুনিয়েছে। আমাদের প্রতিটি গল্পই ভালো লেগেছিল। পর্দায় কখন দেখতে পাব, সেটা নিয়ে আমাদের সব সময়ই আগ্রহ ছিল।

নুহাশ হুমায়ূন: মা সব সময় আমার গল্পগুলো নিজে থেকেই পড়তে চায়। এমনও হয়েছে যে আমি ছোট কিছু নির্মাণ করছি, সবাইকে হয়তো গল্প শোনানোর সময় নেই। তখনো মা চিত্রনাট্য চেয়ে নেয়। আমি ব্যস্ত থাকলে মা নিজেই রুম থেকে বের করে সেটা পড়ে ফেলে। কীভাবে যেন খুঁজে বের করে নেয়! চিত্রনাট্যে ফন্টের আকার ছোট হলে বড় করে প্রিন্ট করিয়ে এনে পড়ে। বলে, কোন বিষয়টি ভালো লেগেছে, কোনটি লাগেনি। ভাষার ব্যবহার নিয়ে কথা বলে। আবার হয়তো কোথায় একটা গালি ব্যবহার করেছি। কেন এখানে ব্যবহার করেছি, জানতে চায়। আমি ব্যাখ্যা করে বলি যে গল্পের প্রয়োজনে এখানে এটা প্রয়োজন। মা ছোটবেলা থেকেই সত্যিকার অর্থে সমালোচনা করে। এ বিষয়টি আমার খুব পছন্দের। এ জন্য মায়ের প্রতিক্রিয়া আমার সত্যিই ভালো লাগে।

প্রশ্ন

পেট কাটা ষ–এর প্রথম সিজনের চিত্রনাট্য আফতাব আহমেদের সঙ্গে মিলে তুমি করেছিলে। দ্বিতীয় সিজনে গুলতেকিন খান যুক্ত হলেন। আফতাব আহমেদ তো তারপরে চলে গেলেন। মা যুক্ত হলেন কী করে? চিন্তাটা কার মাথায় এসেছিল?

নুহাশ: আফতাব আঙ্কেল প্রথম মৌসুম থেকেই কাজ করেছেন। তাঁর আগে অনেকের সঙ্গে গল্প লেখার কাজ করেছি, কিন্তু কেন জানি সেভাবে জমে ওঠেনি। আফতাব আঙ্কেল ছিলেন কবি। সে কারণে আমার তাঁকে যুক্ত করার চিন্তাটা আসে। আমি বাংলা জানি না, বিষয়টি তা নয়। কিন্তু আমার ব্যাকগ্রাউন্ড তো ইংরেজি মাধ্যম। ধরা যাক, আমার গল্পের একটা চরিত্রের বাংলা খুবই সুন্দর, কিন্তু আমার বাংলা তো সে পর্যায়ের না। তখন গল্পের প্রয়োজনে কারও সহায়তা লাগতেই পারে। বিশেষ করে পেট কাটা ষ-এ আফজাল হোসেনের চরিত্র ছিল জিনের। চরিত্রটি লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, তার খুব সমৃদ্ধ একটা শব্দভান্ডার থাকা প্রয়োজন। ভাবছিলাম কার সহায়তা নেওয়া যায়। যে দু-একটা শব্দের যথার্থ বাংলা আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না, সেটার জন্য আফতাব আঙ্কেলের সঙ্গে কাজ শুরু হয়। এর মাধ্যমে আফতাব আহমেদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। আমার একটা সুন্দর মুহূর্তের কথা মনে আছে। চঞ্চল চৌধুরী চরিত্রটা ওই জিনকে একটা উপহারের কথা বলছিল। আমি ইংরেজিতে ‘গিফট’ বা ‘এক্সচেঞ্জ’ এ রকম কিছু একটা লিখে রেখেছিলাম। আফতাব আঙ্কেল সেটা পাল্টে লিখলেন ‘বখশিশ’৷ শব্দটা আমার খুবই পছন্দও হলো৷ মনে হলো চিত্রনাট্য লেখার ক্ষেত্রে গদ্যকারের চেয়ে একজন কবি বেশি অবদান রাখতে পারেন। কারণ, কবি শব্দের ওজন বোঝেন। কবিতার মূল বিষয়ই তো কত কম শব্দে অনুভূতি প্রকাশ করা যায়। আফতাব আহমেদের সঙ্গে কাজ করাটা আনন্দদায়ক একটা যাত্রা ছিল৷

সেন্ট মার্টিনে মা গুলতেকিন খানের সঙ্গে দুই বছর বয়সী নুহাশ। ১৯৯৪

একদিন আমার এক বন্ধু আমাকে বলল, ‘আচ্ছা, তোমার প্রোডাকশনে তুমি তোমার মাকে কখনো নাও না কেন? আমি ভেবে দেখলাম, আসলেই তো, কেন আমি মায়ের সঙ্গে কাজ করিনি। একটা ভয় তো থাকেই, মা তো। ভাবলাম, আমি তো মাকে ভয় পাই, আবার আমি পরিচালকও। বিষয়টা কি কাজ করবে? দ্বিতীয় সিজনের গল্পগুলো লেখা শুরু হলো—‘ভাগ্য ভালো’, ‘অন্তরা’ এসব। আমার কাছে মনে হলো, একটা ভিন্ন পটভূমি প্রয়োজন। বিশেষ করে একজন ভালো লেখক এবং নারীর একটা দৃষ্টিভঙ্গি। এটা এমন না যে নারী বলেই কাউকে নিতে হবে। কিন্তু আমার কাছে মনে হলো, সম্প্রতি বাংলাদেশের ওটিটি বা সিনেমাসহ যেসব কাজ হচ্ছে, তার সবই পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হচ্ছে। ট্রেলারে ধর্ষণসংক্রান্ত বিষয় বা যৌনতা যেসব দেখানো হয়, তা থেকে বোঝা যায় লেখক একজন পুরুষ। অর্থাৎ, কনটেন্টগুলোতে পুরুষের গন্ধ থেকে যায়। আমার দ্বিতীয় সিজনের গল্পগুলোয় একটা কোমলতা, একটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন ছিল। ভয়ে ভয়ে মাকে একটা গল্পের কথা বললাম। আমরা প্রথমে অন্তরা করেছি, তারপর ভাগ্য ভালো৷ এ দুটো করার পর আমাদের ভালো একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। গল্পগুলো একটা ভিন্নমাত্রা পেয়েছিল। আমার মনে হলো মা তো সুন্দর কবিতা লেখে। তাহলে কবিতানির্ভর পুরো একটা পর্ব করা যায় কি না। তত দিনে আমার মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস জন্মেছে যে মাকে দিয়ে সুন্দরভাবে কাজটা হবে। মা নিজেও বিষয়টা ভালোভাবে নিচ্ছিল। ফলে চ্যালেঞ্জিং কিছু একটা করার কথা ভাবলাম। এভাবে বেসুরার জন্ম হলো।

প্রশ্ন

নুহাশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব পেয়ে আপনার মনে কী প্রতিক্রিয়া হলো?

গুলতেকিন: নুহাশ তখন যুক্তরাষ্ট্রে। আমার সময়টা তখন ভালো যাচ্ছিল না। বাসায় একা। সবাই দূরে দূরে৷ বাসায় রঙের কাজ চলছে৷ এর মধ্যে নুহাশ একদিন ফোন করে বলল, ‘মা, এভাবে করতে চাই। তুমি কী বলো।’ আমি বললাম, ‘আমি পারব কি না বুঝতে পারছি না।’ এর আগে আমি আর আফতাব যৌথভাবে মধুরেণ নামে একটা কাব্যনাট্য লিখেছি। নুহাশের কাছে জানতে চাইলাম, সে আমার কাছে ঠিক কী চায়। সে আমাকে পুরো স্বাধীনতা দিয়ে বলল, ‘তুমি যেভাবে চাও সেভাবে লেখো, একদম নিজের মতো করে।’ বিষয়টা আমার কাছে খুবই ভালো লাগল। লিখতে গিয়ে আমি আরও বেশি করে বুঝতে পারলাম নুহাশ কেন কোনো কাজ সব সময় ভিজ্যুয়ালি দেখতে চায়। লেখার কাজটা আমি খুবই উপভোগ করেছি। আমি দুই-তিনটি খাতা কিনে রাখলাম। বাসায় রঙের কাজ চলছে। কখন কোথায় যেতে হয়, তার তো ঠিক নেই। এমনও হয়েছে, ফোনে যখন চিত্রনাট্য নিয়ে আলোচনা করতাম তখন একটা পর্যায়ে নুহাশ বলত, ‘আজ এ পর্যন্তই থাক।’ আমি বলতাম, ‘আরেকটু আলোচনা করি।’ বিষয়টা আমার কাছে খুবই চমৎকার লাগছিল। আমি আমার বন্ধুদের বলতাম, আমার ছেলের সঙ্গে কাজ করছি এবং খুবই উপভোগ করছি। আমার কোনো একটা বিষয় যদি ভালো না-ও হয়, সেটাও সে সুন্দর করে বলছে। নিহাশের একটা গুণ হলো সে কারও সঙ্গে কথা বলার সময় খুব সহজেই একটা স্বচ্ছন্দ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে পারে। আমার সঙ্গে এ বিষয়টি আরও তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে। ফলে আমরা খোলামেলাভাবে গল্প নিয়ে নিজেদের ধারণাগুলো আলোচনা করতে পেরেছি৷

গুলতেকিন খান, আবার সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার পথে। ১৯৯৬
প্রশ্ন

আপনি কবিতা লেখেন। কবিতা তো খুবই অন্তরঙ্গ, খুবই নিজের জিনিস। কিন্তু চলচ্চিত্র বা সিরিজে প্লটের দরকার হয়। তাতে একাধিক চরিত্র থাকে, প্রতিটি চরিত্রের পটভূমি আর বেড়ে ওঠার একটা নিজস্ব ও নেপথ্য গল্প থাকে। প্রতিটি চরিত্রের সংলাপ আলাদা, পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। এসব চরিত্রের মধ্যে নানা মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গল্পটা দাঁড়ায়। তা ছাড়া নুহাশ নতুন প্রজন্মের ছেলে। তাদের জগৎ, ভাষা, পৃথিবীকে দেখার চোখ আলাদা। ওদের গল্প তো অন্য রকম হওয়ার কথা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলেন কী করে?

গুলতেকিন: আমি পুরোনো নাটক-সিনেমা যেমন দেখতাম, তেমনি এ সময়েরও প্রচুর দেখেছি। নুহাশরা যেসব গান শোনে, সেসব আমিও শুনি। আবার আগের গানও শুনি। সংবাদপত্রে দেখি কোন গানগুলো টপচার্টে আছে। ইউটিউবে সেগুলো খুঁজে বের করে শুনি। যেগুলো ভালো লাগে, ডাউনলোড করে রাখি পরে শোনার জন্য। ফলে এ যুগের পৃথিবী থেকে আমি যে খুব বিচ্ছিন্ন, বিষয়টা এমন না। তা ছাড়া আমার বড় মেয়ে নোভার দুটো মেয়ে তো বড় হচ্ছে। ওরা আমার খুব বন্ধু। তিন-চার বছর ধরে আমরা একসঙ্গে বন্ধুর মতো কফি খেতে যাই। তাদের প্রজন্মের বিষয়গুলো আমার মোটামুটি জানা হয়ে যায়।

সেন্ট মার্টিনে মা ও সন্তানেরা: নুহাশ হুমায়ূন, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ, গুলতেকিন খান ও বিপাশা আহমেদ। ১৯৯৬
প্রশ্ন

নুহাশ, অনেকে সময় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, অনেকে আবার যুক্ত থাকতে পারে। তোমার মা যে যুক্ত আছেন। এমনও তো হতে পারে যে তোমার গল্পের একটা চরিত্র খুব নোংরা গালি দেবে বা জঘন্য কোনো কথা বলবে। আবার তোমাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতের অমিলও হতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে কী করেছ?

নুহাশ: কাজ শুরু করার আগে পরিচালক হিসেবে আমার মূল ভূমিকা হচ্ছে আমার কোন কোন বিভাগে ঘাটতি আছে, সে সম্পর্কে জানা। কাজটার ভিজ্যুয়াল ল্যাংগুয়েজ কী হবে, আমি জানি না। আমাকে আবিষ্কার করতে হবে। কোনো একটা চরিত্র কী কাপড় পরবে বা কীভাবে কথা বলবে, সেটা আমি জানি না। জানতে হবে। পেট কাটা ষ–এর দ্বিতীয় সিজন লেখার সময় আমি এ বিষয়ে সচেতন ছিলাম। কারণ, সেখানে এ রকম কিছু কিছু গল্প ছিল। যেমন মোশাররফ করিমের একটা চরিত্র ছিল যে কড়াইল বস্তিতে থাকে। তার সঙ্গে তার মায়ের দৃশ্যে সংলাপ কেমন হবে, আমি জানি না। আমি সপ্তাহখানেক কড়াইল বস্তিতে গিয়ে থাকলেও সেটা হবে না। এভাবে জীবন জানা যায় না। তাতে বড়জোর চমক দেখানো যায়। আবার অন্তরায় একটা বিবাহিত দম্পতির মধ্যে যে কথোপকথন কেমন হবে, তার ধারণাও আমার নেই। প্রচলিত এমন কিছু ছোট সংলাপ আছে, যা অনেক কিছু বোঝায়। ধরা যাক, স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হলো, তার পরে তাদের কথাবার্তা কেমন হবে। এসব বিষয়ে আমি মাকে জিজ্ঞেস করতাম।

সংলাপ বলার সময় একটা ছন্দ থাকে, গানের মতো। মা হয়তো খুব সুন্দর করে লিখেছে৷ কিন্তু আমার কাছে বাক্যের দৈর্ঘ্য হয়তো ঠিক লাগছে না। আমার কাছে মনে হচ্ছে, কীভাবে একে আরও সহজ করা যায়, একটা লাইনকে ভেঙে দুইটা লাইন করা। এমন একটা বাক্য দরকার, যা এক সেকেন্ডে বলা যায়, পাঞ্চলাইনের মতো। মায়ের সঙ্গে এগুলো নিয়ে কথা বলতাম। বেসুরা লেখার সময় একটা সংলাপ ছিল। কসাই একটা বাচ্চা মেয়েকে আটকে রেখেছে। মেয়েটা বেসুরা। সে পালিয়ে যেতে চায়। সে বলে, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি পালিয়ে যাব। কসাই বলছে, ‘প্রতিভাহীনরা কি হয়? হয়ে যায় সমালোচক, অন্যের গুণে আগুন জ্বালায়। হয় তারা শিক্ষক, সবাইকে গরুর রচনা লেখায়। হয় শিল্প–পরীক্ষক, একই তালগাছ বারবার আঁকায়। নাহলে ক্রিয়েটিভ সংস্থার পরিচালক; সবাইরে দেয় উপদেশ, বিবেকের ঠেলায় শেষ। তরে পলাইতে দিলে ধ্বংস হইব সারা দেশ।’ এখানে বিভিন্ন সমালোচকদের সমালোচনা করা হয়। মা বললেন, এটা কি রাখা ঠিক হবে? এটা তো ওদের জন্য অসম্মানজনক হবে। মাকে বোঝালাম, এই কাজে এটার প্রয়োজন আছে। এ লাইনগুলো মানুষ খুব পছন্দ করল। সংলাপগুলো আলাদা করে শেয়ার করেছে৷ অনেকে ভেবেছে এটা আমার কথা। আসলে তো সেটা ছিল ওই কসাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি।

মা গুলতেকিনের সঙ্গে শিশু নুহাশ হুমায়ূন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। ১৯৯৬
প্রশ্ন

এই ভুলটা হয়। অনেকে ভাবে, চরিত্র যা বলছে, সেটা লেখক বা পরিচালকেরই কথা।

নুহাশ: এটা মোটেই আমার কথা না যে আমি সমালোচনা পছন্দ করি না। আমার চরিত্রটা সমালোচনা পছন্দ করে না। এর মানে, তার অহং অনেক বেশি। সে সুন্দর গান গাইছে, কিন্তু সমালোচক আর শিক্ষকদের অসম্মান করে কথা বলছে। তার অহংয়ের সমস্যাটিই গল্পের শেষে প্রকাশিত হয়। মা ঠিকই ধরতে পেরেছিল যে এই সংলাপ মানুষ অন্যভাবে নেবে। তবে আমার দৃষ্টিভঙ্গিও ঠিকই ছিল।

প্রশ্ন

এমন পরিস্থিতি কখনো তৈরি হয়েছিল কি না, যেখানে তোমার সঙ্গে তোমার মায়ের মতপার্থক্য অনেক ছিল। হয়ে থাকলে তোমরা সেটা কীভাবে সমাধান করেছ?

নুহাশ: এ রকম কোনো বিষয় হয়নি। আমাদের বেশি চ্যালেঞ্জ ছিল কারিগরি দিকটায়৷ বেসুরায় প্রথম নারী আর প্রথম পুরুষ নিয়ে একটা গান আছে। কত কম লাইনে আমরা গল্পটা বলছি। সুন্দর শব্দ বা বাক্যের পরিপূর্ণতায় আমরা হারিয়ে যাচ্ছি, নাকি গল্পটা বলতে পারছি—এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অনেক কারিগরি চ্যালেঞ্জ ঠিক করতে হয়তো দু-এক সময় লেগে যাচ্ছিল। কিছু বিষয়ের সমাধান খুব সুন্দরভাবে বের হয়ে আসে। বেসুরায় মায়ের লেখা একটি সংলাপ আমার খুব প্রিয়৷ সুমাইয়া শিমুর চরিত্রে সংলাপটি ছিল এ রকম, ‘কিছু ফুল ফুটে আগে, কিছু ফুলের সময় লাগে। বলা যায় না আগেভাগে। আগেই যদি বিচার করেন, কেমনে কইরা ফল পাবেন।’ আমার মনে হয়েছিল, এই সংলাপটা তো একটা ছোট কবিতা হতে পারে। মা যে চিত্রনাট্য লিখেছে, সেটা তো শিল্পের একটা অংশ।

মায়ের সঙ্গে ছবি দেখা। যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৯৭
প্রশ্ন

তোমার মা কবি বলে সেটার বাড়তি কিছু সুবিধা তুমি পেয়েছ।

নুহাশ: হ্যাঁ, সেটা বলতে হবে।

প্রশ্ন

সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে ছবিতে অন্ত্যমিল রেখে সংলাপ লেখা হয়েছিল। এটাতে এভাবে সংলাপ লেখার ভাবনা কার মাথা থেকে এসেছিল?

গুলতেকিন: নুহাশের মাথা থেকেই। নুহাশ বলল, সে এ রকম কিছু একটা চায়। তখন আমার মাথাতেও হীরক রাজার দেশের কথা এসেছিল। ভাবলাম, ও রকম কিছু তো করা যাবে না। লোকে বলবে, ধারণা চুরি করেছি৷ ভিন্নভাবে করতে গিয়ে কিছুটা সময় লেগেছিল। আপনি বললেন না, মাকে নিয়ে নুহাশ গালাগালি কীভাবে ব্যবহার করবে? ওয়াক্ত-তে কাজ করার সময় নুহাশ কিন্তু আমাকে রাখেনি। সে প্রথমে বলল, ‘এখানে একজন মারা যাবে। তুমি যদি ভয় পাও।’ পরে সত্য কথাটা বলেছে। বলল, ‘ওই পর্বে তো অনেক গালাগালি থাকবে। তুমি তো গালি পছন্দ করো না।’ আমার বাসায় কেউ কখনো গালি দেয় না। ওয়াক্ত-এর চিত্রনাট্য আমার পড়া হয়নি। ও বলেছিল, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে পর্বটা বানাবে। ওরা অনেক গালি ব্যবহার করবে। আমি আর ওর মধ্যে ঢুকিনি।

মায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়েরা: গুলতেকিন খান, শীলা আহমেদ, নোভা আহমেদ, নুহাশ হুমায়ূন ও বিপাশা আহমেদ। জানুয়ারি ২০২৫
প্রশ্ন

নুহাশ, পড়াশোনা করেছ ইংরেজি মাধ্যমে। তুমি একটা নিরাপদ আর স্বাচ্ছন্দ্যময় সামাজিক ঘেরাটোপের মধ্যে বড় হয়েছ। কিন্তু তোমার প্রোডাকশনগুলো হচ্ছে বাংলায়। তুমি বাংলাদেশের জনজীবনে ছড়িয়ে থাকা গল্প বলছ। গল্পগুলো তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দারুণভাবে জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে। একে তারা নিজেদের কল্পনার সঙ্গে সেগুলো সংযোগ করতে পারছে। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?

নুহাশ: এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি সব সময়ই খুব সচেতন। আমার পড়াশোনা ইংরেজি মাধ্যমে৷ আমরা বন্ধুরাও ইংরেজি মাধ্যমের। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে টিফিন পিরিয়ডেও বাংলায় কথা বলতে দেয় না। এ কারণে বাংলায় আমাদের কম কথা বলা হতো। কিন্তু ভাষা বোঝা এক জিনিস, সুন্দর করে বলা ভিন্ন একটা বিষয়৷ যারা হিন্দি সিনেমা দেখে, তারা হিন্দি বোঝে, কিন্তু বলতে পারে না। বিষয়টা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমার বাংলা উচ্চারণে ইংরেজি মাধ্যমের ছাপ থাকার মানে এই নয় যে আমার চিন্তাভাবনা বিদেশি। আমি আন্ডারগ্র্যাডে বাইরে পড়তে যাওয়ার কিছুদিন পরেই দেশে ফিরে এসেছিলাম। সেখানে একা একা ভালো লাগত না। এখানে এসে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই৷ ব্র্যাকের টার্কে বিচিত্র সামাজিক–অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে দীর্ঘদিন একসঙ্গে ছিলাম। সেটা আমার জন্য ভালো একটা অভিজ্ঞতা ছিল। সেখানে আমি নতুন একটা জগতের সন্ধান পাই। আমাদের প্রোডাকশন টিমেও নানা রকমের মানুষজন থাকেন। তাদের কাছ থেকেও বহু কিছু জানা যায়।

আপনি সম্ভবত আমার আগের কাজগুলোর কথা বলছেন। সেখানে সম্ভবত আমার আগের মানসিকতার কিছু কিছুটা ছাপ ছিল। তখন আমি ভাবতাম, কীভাবে বিষয়গুলোকে আরও আধুনিক করে তোলা যায়। পরে দেখলাম, আমাদের নিজেদেরই যে এত গল্প আছে—রূপকথা থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক জীবনে। সে গল্পগুলো আমরা না বললে কে বলবে। বিদেশিরা তো তাদের গল্পগুলো খুব সুন্দরভাবে বলছে। বলিউড তার গল্পগুলো বলছে। আমাদের গল্পগুলো আমরা না বললে কে বলবে? আর আমাদের গল্প তো আমরাই সবচেয়ে ভালো করে বলতে পারব। এই জায়গায় আমার সক্রিয় একটা চেষ্টা রইল যে আমাদের গল্পগুলো তুলে আনতে হবে। পেট কাটা ষ–এর প্রথম সিজন বানানোর সময় আমার খুব ভালো একটা অনুভূতি হলো। একই বছর আমার দুটো কাজ একসঙ্গে মুক্তি পেয়েছিল—মশারী আর পেট কাটা ষমশারী যখন বাইরে নানা পুরস্কার পেল, তখন মনে হলো, আরে, আন্তর্জাতিক দর্শকেরা তো আমার কাজ পছন্দ করছে। তার এক মাস পর আবার পেট কাটা ষ মুক্তি পেলে দেখতে পেলাম, কাজগুলো বাংলাভাষী মানুষদেরও যুক্ত করতে পারছে। আমি পুরস্কারের জন্য কিছু বানাচ্ছি না। আমি এমন কিছু বানাচ্ছি না যেটা মানুষ নিতে পারছে না।

‘পেট কাটা ষ’–এর প্রথম সিরিজে চঞ্চল চৌধুরী
প্রশ্ন

রটারড্যাম চলচ্চিত্র উৎসবসহ বিশ্বের নানা উৎসবে পেট কাটা ষ প্রশংসিত হয়েছে। তুমি তো আমাদের নিজেদের গল্পই বলছ। অন্য জায়গার মানুষ তাহলে যুক্ত হচ্ছে কী করে? এখানে জাদুটা কী?

নুহাশ: রটারড্যামে পেট কাটা ষ–এর যে প্রশংসা হলো, তাতে অবাক হয়েছিলাম। কারণ, আমরা উৎসবের কথা ভেবে ওটা বানাইনি। তাঁরা বললেন, এটা যে অন্য দেশের রূপকথা, দেখলে সেটা বোঝা যায়। কারণ, রূপকথার একটা গঠন আছে। আর শেষে একটা নৈতিক উপলব্ধিতে গিয়ে পৌঁছায়। থ্রিলার বা হরর যে জনরার (ঘরানা) কথাই বলা হোক না কেন, এর মধ্যে একটা সর্বজনীনতা আছে। ডাব্বে নামে তুর্কি হরর সিনেমা মানুষ পাগলের মতো দেখে। অথচ তুর্কি সিনেমার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। আমার মনে হয় জনরা বিষয়টার মধ্যে একটা শক্তি আছে। কীভাবে যেন বাধাগুলো ভেঙে ফেলে।

‘পেট কাটা ষ’–এর প্রথম সিরিজে জিনের চরিত্রে আফজাল হোসেন
প্রশ্ন

নুহাশ এখন অডিওভিজ্যুয়াল ফিকশন করে। কিন্তু আমি শুনেছিলাম স্কুলের ছোট ক্লাসের ছাত্র থাকা অবস্থায় সে তার টিফিন বক্স নিয়ে একটা গল্প লিখেছিল। ছেলেকে সম্ভবত আপনি মুভি ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন?

গুলতেকিন: আমি আমার তিন মেয়েকেই খুব আদর করতাম। খুব পড়াশোনা করাতাম না। তারা পড়ত বাংলা মিডিয়ামে। আমি যখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এলাম, তখন স্কলাস্টিকায় যোগ দিতে পারতাম। তাহলে নোভা আর শিলা সেখানে বিনা খরচে পড়াশোনা করতে পারত। বিপাশার জন্য দিতে হতো অর্ধেক খরচ। আমি তা করিনি। কারণ, তাহলে আমার পড়াশোনা আর হতো না। আমি যখন মাস্টার্সে, নুহাশকে তখন ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করাতে হবে। তখন সানবিমস স্কুলে গিয়ে দেখি ওদের ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ। তারপরও তারা আবেদন করতে বলেছিল। আমি ভেবেছি, হয়তো এমনিই বলছে৷ সে সময় আবেদন দিয়ে আসলে হয়ে যেত। পরে তাকে সানিডেইল স্কুলে ভর্তি করি। নুহাশকে আমি বাসায় পড়াতাম। ওর সঙ্গে সব সময় ইংরেজিতে কথা বলতাম। পরে অবশ্য বেশ বড় পরীক্ষার পর ওকে সানবিমসে ভর্তি করাই। আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত হই। যাহোক, আমার মনে হয়েছিল, ছবির প্রতি ওর একটা আগ্রহ আছে। আমি তাকে একটা ভিডিও ক্যামেরা দিয়েছিলাম। দামি না। এক মিনিট ধারণ করা যেত।

নুহাশ: ক্যামেরাটা আসলে আমাকে কিনে দেওয়া হয়নি। ওটা ছিল বাসায় ছবি তোলার জন্য। এই ক্যামেরায় ভিডিও ফাংশন ছিল। আমি ভিডিও বানাতে ওটা ব্যবহার করতাম। পরে আরেকটু বড় ভিডিও বানানোর জন্য মা আমাকে একটা মেমোরি কার্ড কিনে দেয়৷

গুলতেকিন: হ্যাঁ। ক্যামেরাটা আমরা পারিবারিক ছবি তোলার জন্যই কিনেছিলাম। আমরা যখন ভাড়া বাসায় থাকতাম, ও তখন ওর বন্ধুদের নিয়ে ছাদে গিয়ে ভিডিও করত। আমি খুব মজা পেতাম। ও নিজে ভিডিও করত, নিজেই এডিট করত। ওর গল্পগুলোয় আগে থেকে কোনো আভাস পাওয়া যেত না পরে কী হতে যাচ্ছে। ও সিনেমা বানাত একদম ভিন্নভাবে। ওর বাবার মতো করে না। স্কুলে ওর ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের খাতা ছিল। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম। যদিও আমাকে স্বাক্ষর করতে হতো। লেখাগুলো পড়তে আমার খুবই ভালো লাগত। শেষে গিয়ে একদম অন্য রকম সমাপ্তি। ওর সেসব লেখা পড়া আমার নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। ও একদিন বলল, একটা ছবি বানাতে চায়। এ জন্য একটা সেমিস্টার সে বন্ধ রাখবে। প্রথমে অবশ্য বলেছিল জিআরইর জন্য পড়বে। তখন নুহাশের হাতে টাকা নেই, কিন্তু সিনেমা বানাতে তো অনেক খরচ। আমি তাকে আমাদের ফ্ল্যাটেই সিনেমাটা করতে বলি। আমি বাইরে থেকে মোরগ–পোলাও কিনে সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করি। শুক্র-শনিবার আমার ছুটি ছিল। সমস্যা হয়নি। একটা ছোট মেয়ের চরিত্র ছিল। ওর জন্য আমি নিজেই কাপ কেক বানালাম। আমি ঘরেই থাকতাম। ওদের কাছে যেতাম না। ওরা নিজেদের মতো কাজ করুক। ওরা ঘর থেকে নানা কিছু নিয়ে যেত। আমার ড্রেসিং টেবিল খালি করে ফেলত। রান্নাঘরের অ্যাপ্রনও নিয়ে গিয়েছিল। নুহাশ তো ছোট। কীভাবে এত কিছু পারবে। মনে হয়েছে, তাকে সমর্থন করা প্রয়োজন। আমি সে সমর্থন তাকে দিয়েছি।

নুহাশ: আমি যে কমিকস আঁকছি বা বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা বানাচ্ছি, প্রথম দিকে মা এটা পছন্দ করতেন না। বন্ধুদের সঙ্গে তখন সময় কাটাচ্ছি। পরচুলা কিনছি অভিনয়ের জন্য। আমাদের বন্ধুরা ছিল সব ছেলে বন্ধু। কোনো মেয়ের চরিত্র থাকলে ওদের শাড়ি পরতে হতো। মা খুব বিরক্ত হতো। মা সব সময় বলত, তুমি লেখো। তোমার লেখা খুব ভালো। কিন্তু আমি কেন জানি ভিজ্যুয়ালি গল্প বলতেই বেশি পছন্দ করতাম।

মায়ের অনুষ্ঠানে ছেলে: গুলতেকিন খানের প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনায়। বাংলা একাডেমি, ঢাকা; ২০১৬

গুলতেকিন: আমার কাছে মনে হতো, সে লিখলে লেখাটা পুরোপুরিই ওর হবে। কিন্তু লেখার ফিডব্যাক পেতে হয়তো দেরি হবে। এতক্ষণ হয়তো সে অপেক্ষা করতে চায় না। ও সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়।

নুহাশ: আমার মনে হতো, লেখকের জীবনটা খুব করুণ। শুধু বসে বসে লেখা। যা-ই হোক, মা আমার ওপর বিরক্ত হতে হতে একসময় বুঝতে পারল সিনেমা বানানো আমার সাধারণ কোনো শখ না। বিষয়টি আমি খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছি। তখন মা আমাকে শতভাগ সহায়তা দেওয়া শুরু করল। এ জন্য আমার জন্য এই যাত্রাটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মা আগে এতে বিশ্বাস করত না, আর এখন দুজনে একসঙ্গে কাজ করছি। মা কিন্তু আমাকে বলেনি সে কেন আমাকে সানিডেইল থেকে সানবিমসে এনে ভর্তি করাল। আগের স্কুলে আমি একটা নিজেকে নিয়ে ইংরেজিতে একটি রচনা লিখেছিলাম। সেখানে আমি লিখেছিলাম, আমি একটা মোটাসোটা বালক। মোটাসোটা বোঝাতে আমি ইংরেজি ‘চাবি’ শব্দটা লিখেছিলাম। শিক্ষক সেটা কেটে ‘হেলদি’ লিখে দিলেন। লজ্জা পেয়ে খাতাটা আমি লুকিয়ে রাখি। মা সেটা খুঁজে পেয়ে, পড়ে আমার কাছে জানতে চান, কী হয়েছে। আমি যখন ঘটনাটা বললাম, মা শুনে খুবই রেগে গেল। ‘চাবি’ শব্দটা তো খারাপ না। তিনি আমার সুরটা বুঝতে পারছিলেন। যে ছেলেটা নিজেকে এই শব্দে বিশেষায়িত করছে, সেটা তো একধরনের রসিকতা। এটা যে কেটে দেওয়া হলো, তাতে তো ওর নিজের সৃজনশীল প্রকাশকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। মা ঠিক করল, সেই স্কুলে আমাকে আর পড়াবে না। স্কুল বদলাতেই হবে। বিষয়টা মোটেও এমন না যে একটা স্কুল ভালো বা আরেকটা স্কুল খারাপ। নতুন স্কুল সৃজনশীলতার দিকে খুব মনোযোগী ছিল৷ আমি জানি না, আর দশটা মা এই কারণে স্কুল বদলাত কি না। গুলতেকিন খানই মনে হয় একমাত্র মা যে এই কারণে স্কুল বদলিয়েছিলেন।

গুলতেকিন: ওর বাবা তখন গাজীপুরে। আমি খুব খুশি হয়ে বলেছিলাম, নুহাশ তো সানবিমসে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। তিনি রাগ করে বলছিলেন, ‘আবার নতুন করে ভর্তি করাতে হবে। আবার টাকা লাগবে। সানবিমস কি কোনো রসগোল্লা স্কুল!’ আমি স্কলাস্টিকায় ছিলাম। ওখানে সহজে ভর্তি করানো যেত। কিন্তু আমি আমার ছেলের ম্যাম হতে চাইনি।

ছেলের অনুষ্ঠানে মা: ‘মশারি’ জন্য পাওয়া এসএক্সএসডব্লিউ জুরি পুরস্কারের স্মারক হাতে গুলতেকিনের সঙ্গে নুহাস, স্টার সিনেপ্লেক্সে ছবিটির একান্ত প্রদর্শনীতে। ২০২২
প্রশ্ন

ভৌতিক বা হরর জনরার প্রতি তোমার একটা বিশেষ আগ্রহ আছে। কিন্তু তুমি পশ্চিমা হরর জনরার দিকে গেলে না, গেলে আমাদের স্থানীয় গল্পগুলোর দিকে—ভূত, পেতনি, শাঁকচুন্নি এসবের দিকে। এর কারণ কী? ভৌতিক গল্পকে সামাজিক বার্তা দেওয়ারও বিষয় করে তুললে। এ রকমভাবে ভাবলে কেন?

নুহাশ: আমার বিভিন্ন জনরা উন্মোচন করতে ভালো লাগে—হোক সেটা মিউজিক ভিডিও হোক বা কমেডি। কিন্তু হরর করতে গিয়ে আমি নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করতে পেরেছি। এমন না যে আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই হরর বেছে নিয়েছিলাম। অনেক কিছুই চেষ্টা করছি, সব সময়ই করি। হরর করতে গিয়ে দেখতে পেলাম, নতুন কী যেন একটা আমার মধ্যে কাজ করছিল। আমি খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, হরর আমাদের রক্তে আছে। বাঙালি পরিবারের ছোটবেলার স্মৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে ভূতের গল্প। নানি-দাদি, বাবা-মা, ভাই-বোনেরা সবাই ভূতের গল্প শোনায়৷ ভূতের গল্প খুবই জনপ্রিয় বাংলা বিনোদন। ভূতের গল্প আমাদের জাতীয় গল্প। এসব শুনে আমরা বড় হয়েছি। মাঝখানে আমি কিছুদিন একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। আমরা সহকর্মীরা একটা জায়গায় গিয়ে রাতে ছিলাম। সেখানে সবাই রাতের বেলা ভূতের গল্প বলল৷ মজার বিষয় হচ্ছে, প্রত্যেকের গল্প বোঝা যাচ্ছিল, তার গ্রামের বাড়ি কোথায়। ভূতের গল্প থেকে আমাদের সবার ইতিহাস চলে আসে। বানাতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, অতিপ্রাকৃত শক্তির সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির একটা যোগসূত্র আছে। গল্পগুলো গবেষণা করতে গিয়ে দেখলাম, আমাদের হরর বিদেশি হররের মতো না। বাঙালি ভূতের গল্পে আপনি দেখবেন না, ভূত হঠাৎ করে লাফ দিয়ে উঠল আর মানুষ মারা গেল। ভূত আমাদের সঙ্গে দর-কষাকষি করে। ভূত এসে বলে, মাছ দাও। জিন এসে বলে, মিষ্টি দাও। এখানে মানুষের সঙ্গে জিনের বিয়ে হয়। এগুলো আমাদের সাহিত্যে আছে, জনজীবনে আছে। আমাদের মানুষ ও ভূতের মধ্যে সম্পর্কটা খুবই মানবিক। অন্য দেশের ভূতের গল্পে এটা নেই। এগুলো করতে গিয়ে আমি নিজেকে একজন ভিজুয়্যাল গল্পবলিয়ে হিসেবে আবিষ্কার করি। ড্রামা বা রোমাঞ্চে সবকিছু করা যায় না। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে প্রেম করছে—এটা আমি কতগুলো দৃষ্টিকোণ থেকে ধারণ করতে পারব? ছেলেমেয়ের প্রেমের একটা সুন্দর দৃশ্য যতভাবে দেখানো সম্ভব, বাংলাদেশে প্রায় সবই হয়েছে। আমি নিজেও ‘ক্লোজআপ কাছে আসার গল্প’–এ এসব করেছি৷ কিন্তু সেখানে নিজেকে ভিজ্যুয়ালি খুঁজে বের করতে পারিনি৷ এই গল্পগুলো করতে গিয়ে আমি বুঝতে পারি চলচ্চিত্র নির্মাণ অডিওভিজ্যুয়াল একটা মাধ্যম। শব্দ নিয়ে এখানে খেলা করা যায়। ভিজ্যুয়ালে এমন কিছু দেখাতে পারছি, যা কেবল বাংলাদেশে না, পৃথিবীতেই হয়তো কেউ দেখেনি৷

‘২ ষ’–এর শুটিংয়ে পরিচালক নুহাশ হুমায়ূন
প্রশ্ন

যেমন?

নুহাশ: আমাদের মেছো ভূত মাছের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। আমাদের পুরো দল এমন সব ইমেজ তৈরি করেছে, যার অস্তিত্ব কোথাও নেই। এটা থেকে আমি শিখতে পেরেছি চলচ্চিত্র নির্মাণ আসলে কী বিষয়৷ আমাকে এমন কিছু ভিজ্যুয়াল ডায়ালগ তৈরি করতে হবে, যার পূর্ব কোনো অস্তিত্ব নেই। আগে থেকেই যা আছে, তা নির্মাণ করে কোনো লাভ নেই। এর মধ্যে আমি নিজেকে শিল্পী হিসেবে আবিষ্কার করি। এমন তো নয় যে আমি সারা জীবন হররই বানাব। আমি যে জনরাতেই কাজ করি, আমাকে মাথায় রাখতে হবে যে নতুন এমন কিছু নির্মাণ করতে হবে, যার অস্তিত্ব আগে ছিল না।

মিষ্টি কিছুর গল্পে একটা জিন আসে মিষ্টি খেতে। লিখতে লিখতে মনে হলো, একটা চরিত্রের সারা জীবনে স্মৃতি সামনে চলে আসছে। ধীরে ধীরে অনেক পেছনের বহু কিছু তার মনে পড়ে যাচ্ছে। এই স্মৃতি মনে পড়ার সবচেয়ে চরম মুহূর্ত এই হতে পারে যে বিশ্বসৃষ্টির মুহূর্তটিও তার মাথার মধ্যে চলে এল। সবাই বলল, এটা বাড়াবাড়ি, দর্শক এটা নিতে পারবে না। আমরা বললাম, করেই দেখি না৷ আমরা আসলে দর্শক-শ্রোতাকে খাটো করে দেখি। তারা কিন্তু অনেক বেশি সচেতন।

‘২ ষ’–এ মোশাররফ করিম
প্রশ্ন

দর্শককে আমরা খাটো করে দেখি, এটা যেমন ঠিক। আবার দর্শককে সেভাবে গল্পের মধ্যে নিয়েও আসতে হয়। এই দুই প্রান্ত একটি জায়গায় এসে মেলে। পশ্চিমা চলচ্চিত্রে ভূত বা জম্বি যেভাবে ভয় দেখাতে হাজির করানো হয়, তখন সেটা অ্যান্টি-ক্লাইমেক্স হয়ে পড়ে, গল্পটা মরে যায়। ভয় বেশি কাজ করে যখন সেটা ভিজ্যুয়ালি হাজির না হয়ে মনের মধ্যে হাজির হয়। তোমার গল্পের বড় শক্তি ভূত এখানে কেবলই কেবল ভয় দেখাতে আসে না।

নুহাশ: চলচ্চিত্র তো একরকম ফ্রেমিংয়ের বিষয়৷ ফ্রেমের ভেতরে যা থাকবে, ততটুকুই আমরা দেখতে পাব। তার বাইরে কিছু দেখব না। পেট কাটা ষ-এর দ্বিতীয় সিজনে আমরা অনেক কিছুই দেখাইনি। অন্তরায় একটি শিশু দুর্ঘটনায় গাড়িচাপা পড়ে। গাড়ির হর্ন শুনে শিশুটি তাকায়। পরের শটে দেখা যায় রাস্তায় রক্ত পড়ে আছে। মাঝখানের মৃত্যুদৃশ্য আমরা দেখাইনি। হয়তো দেখানোর মতো বাজেট নেই। কিন্তু রুচিও তো নেই। এটা জাদুর মতো কাজ করে৷ এতে দর্শক–শ্রোতাকে অনেক বেশি সম্পৃক্ত করা যায়৷ এই শূন্যস্থান তারা মনে মনে পূর্ণ করে নেয়।

‘২ ষ’–এ সুমাইয়া শিমু
প্রশ্ন

ভিজ্যুয়ালি গল্প বলার ক্ষেত্রে এটা আপনার প্রথম অভিজ্ঞতা। আপনি গল্প লিখেছেন। কিন্তু চিত্রনাট্য তো চলচ্চিত্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি এবং চলচ্চিত্রের মূল কাঠামো। এতে ধ্বনি, রং, সংগীত, সম্পাদনাসহ নানা কিছু যুক্ত হয়ে ভিন্ন একটা রূপ গড়ে ওঠে৷ গল্পের কঙ্কাল থেকে চলচ্চিত্রের চূড়ান্ত রূপান্তরের এই প্রক্রিয়া অভিজ্ঞতা আপনার কাছে কেমন লাগল?

গুলতেকিন: পেট কাটা ষ-এ আফজাল হোসেনের সঙ্গে নওশাবার ছোট একটা চরিত্র ছিল৷ ওর অভিনয় ততটা বোঝার সুযোগ ছিল না৷ অন্তরা লেখার সময় আমি বললাম, এই চরিত্রে খুবই শক্তিশালী একজন অভিনেত্রীকে লাগবে৷ ও কি পারবে? দেখার পর কিন্তু আমার অনেক ভালো লেগেছে৷ আমি যা প্রত্যাশা করেছি, সবাই তার চেয়ে অনেক ভালো করেছে৷ পুরো টিম মিলে অসাধারণ কাজ করেছে। তবে বেসুরা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে।

‘পেট কাটা ষ’–এর জন্য পাওয়া চরকির পুরস্কার হাতে মায়ের সঙ্গে নুহাশ। ২০২৩
প্রশ্ন

ভবিষ্যতে কি মায়ের সঙ্গে তোমার একত্রে আরও কাজ করার সম্ভাবনা আছে?

নুহাশ: আমি তো খুব করেই মায়ের সঙ্গে একটা ফিচার ফিল্ম করতে চাই। মাকে আমি অনেক জোরাজুরিই করছি যেন সে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির চিত্রনাট্য লিখে দেয়। আমি পরিচালনা করব। এ রকম একটা ব্যাপার হলে সত্যিই দারুণ লাগবে৷

প্রশ্ন

তোমার মায়ের লেখার গুণ চাপা পড়ে ছিল। অনেক পরে সামনে এসেছে৷ শিলা অভিনয় বাদ দিয়ে দিল। ওকে আমি অনেকবার লিখতেও বলেছি। ও লিখল না। ও লিখলে খুব ভালো করত বলে মনে হয়। নোভাও বলল লিখবে, কিন্তু আর লেখেনি।

নুহাশ: আমাদের পরিবারের সবার মধ্যেই প্রতিভা আছে। কোনো পারিবারিক আড্ডায় বসে থাকলে কেউ বুঝবে। সবার মধ্যে আমিই সবচেয়ে কম মেধাবী। ছোটবেলা থেকে আমি বাবার সঙ্গে অনেক সিনেমা দেখতাম। মা আমাকে বাসায় সিনেমা করার অনুমতি দেওয়াসহ নানাভাবে আমাকে সিনেমা বানাতে উৎসাহী করেছে। এগুলো আমার জন্য খুবই উপকারী হয়েছে। বাবা একই শিল্পীর সঙ্গে বহুবার কাজ করে তাকে বোঝার চেষ্টা করতেন। যেমন আসাদুজ্জামান নূরের কথায় কোন সংলাপটা সুন্দর লাগবে, বাবা তা বোঝার চেষ্টা করতেন। মা আমাকে এখন এমন কিছু উপদেশ দেন, যা আমাকে শিল্পী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। এসব দিক থেকে আমি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করি।

প্রশ্ন

তোমার বাবা হুমায়ূন আহমেদ দেশের জনপ্রিয়তম গল্পকার৷ চলচ্চিত্রে আগ্রহ থাকলেও সাহিত্যই তাঁর মূল ক্ষেত্র। তোমার কাজের মূল ক্ষেত্র চলচ্চিত্র। ছোটবেলায় সিনেমা দেখা তোমাকে নিশ্চয়ই ভিজ্যুয়ালি গল্প বলতে অনেক সাহায্য করেছে। চলচ্চিত্রে তোমার বাবার সঙ্গে তোমার পথ আলাদা হয়ে গেল কী করে?

নুহাশ: সম্প্রতি আমার এক বন্ধু জানতে চাইল আমি আকিরা কুরোসাওয়ার ড্রিমস ছবিটা দেখেছি কি না৷ বললাম, দেখিনি। সে আমাকে ভর্ৎসনা করে বলল, ‘ড্রিমস দেখোনি। তুমি চলচ্চিত্রকার হবে কী করে? এখনই দেখো।’ আমি দেখতে শুরু করলাম। দেখতে গিয়ে দেখি, প্রতিটি দৃশ্যই আমার চেনা। মনে পড়ল, এটি আমি দেখেছি ১১ বছর বয়সে। বাবা আমাকে দেখিয়েছিল। কিন্তু ফিল্ম বা পরিচালকের নাম আমার মনে নেই, কিন্তু স্মৃতিটা থেকে গেছে। বাবার সঙ্গে আমি আন্দ্রেই তারকোভস্কির স্টকার দেখেছি দশ-এগারো বছর বয়সে। দেখার আগে বাবা বলল, ‘এই ছবিতে অনেকগুলো শট থাকবে অনেকক্ষণ ধরে, কিন্তু কিচ্ছু হবে না। তোমার কাছে বিরক্তিকর মনে হতে পারে৷ কিন্তু, এটা মনে রেখো এই তৈরিটা চলচ্চিত্রেরই একটা অংশ। ব্যাপারটা তোমাকে সম্মোহনের একটা অবস্থায় নিয়ে যাবে। দেখতে পাবে, তুমি অন্য একটা জগতে চলে গেছ৷’ কোনো ফিল্ম স্কুলের অধ্যাপকেরাও এত সুন্দর করে বলতে পারত না৷ কোনো কোনো ছবি দেখে বাবা বলত, ‘ইশ, আমি যদি এটা বানাতে পারতাম৷’ বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, আমি হলে কী বানাতাম। তিনি আমাকে কখনো চলচ্চিত্রকার হিসেবে দেখেননি। কিন্তু আমার মনে হয়, তিনি যত্ন করে আমার মধ্যে এই বীজটা দিয়ে গেছেন। আর আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে আমার মা আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। তবে লেখা আমাকে দিয়ে হবে না। ফিল্ম বানানোর সাহসটাই শুধু হয়৷