
মিয়ানমারের রাখাইনে গণহত্যা থেকে প্রাণে বাঁচতে আট বছর আগে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল লাখ লাখ রোহিঙ্গা। পরবর্তী সময়ে আরও অনেক রোহিঙ্গা আসে। আর আগে থেকে বাংলাদেশে অনেক রোহিঙ্গা ছিল। সব মিলিয়ে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলোয় নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৪ লাখ ছাড়িয়েছে। নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের বাইরেও আরও রোহিঙ্গা রয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের আর নিজ দেশে ফেরানো যায়নি। এদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা অনেক কমে গেছে। শিশুদের পড়ানোর অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গত মাসে কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক মোস্তফা ইউসুফ।
রোহিঙ্গাদের জন্য বৈশ্বিক সহায়তার পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে কমে এসেছে। রোহিঙ্গাদের শিক্ষা কার্যক্রম সংকুচিত হওয়ায় স্থানীয় মানুষের চাকরি হারানোর ঘটনা ঘটছে। এ কারণে স্থানীয় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাড়ছে। এ সংকটকে ইউনিসেফ কীভাবে মোকাবিলা করছে?
রানা ফ্লাওয়ার্স: তহবিলসংকটের কারণে স্থানীয় অনেককেই ছেড়ে (ছাঁটাই) দিতে হয়েছে আমাদের। তবে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকিনি। আমরা এই স্থানীয় মানুষের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করেছি। এখানে তারা কম্পিউটার অপারেশন, গ্রাফিক ডিজাইন, ফ্রন্টডেস্ক ম্যানেজমেন্ট, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, খাদ্য-পানীয় প্রস্তুতকরণসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারছে। অনেকে ইতিমধ্যে চাকরিও পেয়েছে।
আমাদের সামর্থ্য এখনো সীমিত। তাই প্রাথমিক পর্যায় চালানো যাচ্ছে না। আমরা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ, এই বয়সীদের বাল্যবিবাহ ও জঙ্গি গোষ্ঠীতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে।
দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির সুযোগ কতজন নিয়েছেন?
রানা ফ্লাওয়ার্স: সবাই নয়। ছাঁটাই হওয়া ৬০ শতাংশ তরুণ নিজ নিজ জেলায় ফিরে গেছে। প্রায় ২৫ শতাংশ এই দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে। আর বাকি ১৫ শতাংশ অসন্তুষ্ট, তারা আন্দোলন করেছে। এমনকি সহিংস ঘটনাও ঘটিয়েছে। অফিসে হামলা-ভাঙচুর, স্থানীয় কর্মকর্তাদের আটকে রাখা, হুমকি—এসব আমাদের জন্য দুঃখজনক।
স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্তের আগে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে যথেষ্ট পরামর্শ করা হয়নি বলে অভিযোগ আছে।
রানা ফ্লাওয়ার্স: সিদ্ধান্তটি কঠিনভাবে নিতে হয়েছে। তহবিল আসবে ভেবেছিলাম, কিন্তু এল না। এ কারণে হঠাৎ করেই স্কুল বন্ধ করতে হয়েছে। হয়তো ধীরে ধীরে করা যেত। কিন্তু বাস্তবে সেটি সম্ভব হয়নি। বাস্তবতা হলো, তহবিলসংকটের কারণেই এটা করতে হয়েছে। আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তহবিলসংকট সবার জন্যই কঠিন। কিন্তু সহিংসতার কোনো যৌক্তিকতা নেই। মানবিক কার্যক্রমে নিযুক্ত কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু আন্দোলনকারীদের দাবিদাওয়ায় অনেক সময় শিশুদের অধিকারের চেয়ে নিজেদের স্বার্থ বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। এমনকি তারা চেয়েছে, শিশুদের জন্য বরাদ্দকৃত পুষ্টিকর বিস্কুট বন্ধ করে তার টাকা তাদের হাতে তুলে দেওয়া হোক।
ইউনিসেফ একাই রোহিঙ্গা শিবিরের প্রায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। ৪ হাজার ৫৩৮টি স্কুলে আমরা প্রায় ২ লাখ ২৮ হাজার শিশুকে পড়াচ্ছি। বাকিটা করছে অন্যান্য সংস্থা। তবে বড় চাপ মূলত আমাদের কাঁধেই।
এখন ইউনিসেফ রোহিঙ্গাদের জন্য কোন শিক্ষাস্তরকে গুরুত্ব দিচ্ছে?
রানা ফ্লাওয়ার্স: আমাদের সামর্থ্য এখনো সীমিত। তাই প্রাথমিক পর্যায় চালানো যাচ্ছে না। আমরা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ, এই বয়সীদের বাল্যবিবাহ ও জঙ্গি গোষ্ঠীতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে।
রোহিঙ্গা শিবিরে শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য আর্থিক বরাদ্দ কত?
রানা ফ্লাওয়ার্স:আগে বছরে প্রায় ২৬ মিলিয়ন ডলারের বাজেট ছিল শিক্ষা খাতে। কেবল শিক্ষকদের প্রণোদনা দিতে গেলেই বছরে ১৫ মিলিয়ন ডলার দরকার। আমাদের হাতে আছে অর্ধেকের কম। এ কারণে নতুন কাঠামো বানানো, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালানো, কিশোরীদের জন্য ছোট কমিউনিটি ক্লাস—এসব অনেক কিছুই বন্ধ হয়ে গেছে।
বর্তমানে কত শতাংশ রোহিঙ্গা শিশু ইউনিসেফের শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আছে?
রানা ফ্লাওয়ার্স: ইউনিসেফ একাই রোহিঙ্গা শিবিরের প্রায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। ৪ হাজার ৫৩৮টি স্কুলে আমরা প্রায় ২ লাখ ২৮ হাজার শিশুকে পড়াচ্ছি। বাকিটা করছে অন্যান্য সংস্থা। তবে বড় চাপ মূলত আমাদের কাঁধেই।
মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে রোহিঙ্গারা ফিরতে পারছে না। আর তহবিলসংকট রোহিঙ্গা শিশুদের জীবন হুমকির মুখে ফেলছে। এ সংকটের বার্তা আমরা যতটা সম্ভব জোরালোভাবে তুলে ধরছি। পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ কাজও চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
এখন সংকট সামলাতে কী পরিকল্পনা নিয়েছেন?
রানা ফ্লাওয়ার্স: এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে রোহিঙ্গারা ফিরতে পারছে না। আর তহবিলসংকট রোহিঙ্গা শিশুদের জীবন হুমকির মুখে ফেলছে। এ সংকটের বার্তা আমরা যতটা সম্ভব জোরালোভাবে তুলে ধরছি। পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ কাজও চালিয়ে যেতে হচ্ছে। কোথায় কোথায় ব্যয় কমানো যায়, কোথায় সেবা একত্র করা যায়, সেদিকে নজর দিচ্ছি। যেমন দুটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলে যদি একটি দিয়েই কাজ চালানো যায়, তাহলে একটি বন্ধ করে দিতে হবে।
নতুন পাঠ্যবই কেনার মতো অর্থ নেই। পুরোনো বই দিয়েই চালাতে হবে। সাবান, এলপিজি গ্যাস—এসব জিনিসেও কাটছাঁট আসছে। সেপ্টেম্বরে এলপিজি বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ জ্বালানির জন্য গাছ কাটতে শুরু করবে। এর পরিবেশগত বিপর্যয় ভয়াবহ হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন ও সুদানের চলমান সংঘাতের মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণে কোনো পরিকল্পনা আছে?
রানা ফ্লাওয়ার্স: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন ইউক্রেন, গাজা, সুদানসহ একের পর এক সংকট চলমান। এর ভিড়ে রোহিঙ্গা ইস্যু যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশ সাত থেকে আট বছর ধরে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। গণমাধ্যম এই সংকটকে নতুন করে বিশ্বদরবারে তুলতে পারে। কেননা, যদি তহবিল না আসে, তাহলে আমরা রোহিঙ্গা শিশুদের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে পারব না।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন ইউক্রেন, গাজা, সুদানসহ একের পর এক সংকট চলমান। এর ভিড়ে রোহিঙ্গা ইস্যু যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশ সাত থেকে আট বছর ধরে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। গণমাধ্যম এই সংকটকে নতুন করে বিশ্বদরবারে তুলতে পারে। কেননা, যদি তহবিল না আসে, তাহলে আমরা রোহিঙ্গা শিশুদের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে পারব না।
শিক্ষাকেন্দ্রগুলো নিয়ে রোহিঙ্গাদের দিক থেকে কোনো উদ্যোগ আছে?
রানা ফ্লাওয়ার্স: হ্যাঁ, তারা স্বেচ্ছাশ্রমে কিছু শিক্ষাকেন্দ্র চালাচ্ছে। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য কিছু উদ্যোগ আছে। তবে এগুলো ছোট পরিসরে। মূল চ্যালেঞ্জ হলো, ক্যাম্পের বাইরে কাজের সুযোগ না থাকায় রোহিঙ্গা তরুণদের হতাশা বাড়ছে। তাই আমরা চাই, তাদের জন্য ভেতরে কিছু প্রশিক্ষণ বা দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি চালু হোক। এতে তারা দেশে ফেরার পর তা কাজে লাগাতে পারবে। তবে সরকারের অনুমোদন ছাড়া এখন বড় কিছু করা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি এনজিওর কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কীভাবে সামলাচ্ছেন?
রানা ফ্লাওয়ার্স: পরিস্থিতি বেশ কঠিন। অনেক এনজিওর কর্মী ও তাঁদের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ অফিসে কাজ করতে পারছেন না। এমনকি কিছু কর্মীর ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। ভিডিও প্রমাণও আছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আপনাকে ধন্যবাদ।
রানা ফ্লাওয়ার্স: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।