নাগরিকদের অধিকার রক্ষার করাই আইনের উদ্দেশ্য। কিন্তু কখনো কখনো আইনকে ব্যবহার করে নিরীহ মানুষদের হয়রানিও করা হয়। প্রায়ই দেখা যায়, জায়গাজমি নিয়ে বিরোধের ঘটনায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। আবার অনেক সময় প্রভাবশালী কোনো গোষ্ঠী কাউকে শায়েস্তা করার জন্যও মিথ্যা অভিযোগ করে থাকে। মিথ্যা মামলার বেশির ভাগই ফৌজদারি মামলা। এর উদ্দেশ্যই হলো মানুষকে ভোগান্তি দেওয়া। আপনি যতই নির্দোষ হন না কেন, কেউ আপনার বিরুদ্ধে শত্রুতা করে মিথ্যা মামলা করলে প্রাথমিক অবস্থায় মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে মানুষ যে ভুল সবচেয়ে বেশি করে, তা হলো পালিয়ে যাওয়া। এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে মানসিকভাবে যতটা সম্ভব শান্ত থাকুন। মনে রাখতে হবে, আইনের চোখে আপনার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আপনি নিরপরাধ। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে মিথ্যা মামলার অভিযোগ থেকে রেহাই পাবেন?
যদি আপনার বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়, তাহলে এজাহারের কপিটি সংগ্রহের চেষ্টা করুন। আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করুন। জেলা আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে পারেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটির সত্যতা না পেলে আপনাকে নির্দোষ দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করবেন।
চার্জশিট বা অভিযোগপত্র হয়ে গেলে জেলা আদালতে জামিন চাইতে হবে। জামিন না হলে পর্যায়ক্রমে উচ্চ আদালতে আবেদন করতে হবে। আপনি মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করতে পারেন। অব্যাহতির আবেদন নাকচ হলে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন।
যদি এমন হয়, আপনি কিছু জানা বা বোঝার আগেই হঠাৎ পুলিশ এসে আপনাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে গেল, তাহলে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে আদালতে প্রেরণ করা হবে। তখন আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করতে হবে।
যদি থানায় মামলা না হয়ে আদালতে (সিআর মামলা) হয়, তাহলে আদালত সমন দিতে পারেন কিংবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে হাইকোর্ট বিভাগে আগাম জামিন চাইতে পারেন।
দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে মিথ্যা অভিযোগকারী বা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করতে পারেন। ওই ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা ফৌজদারি মামলা করেন, তবে দুই বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। যদি এমন গুরুতর মিথ্যা ফৌজদারি মামলা করে, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সাত বছর বা তার ঊর্ধ্বে কারাদণ্ড হতে পারে, সে ক্ষেত্রে মিথ্যা মামলাকারী বা বাদীপক্ষ সাত বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ইদানীং নারী ও শিশু নির্যাতনের মিথ্যা মামলা অনেক বেড়ে গেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীন ভুয়া ও মিথ্যা মামলায় কাউকে সামাজিকভাবে অপদস্থ করা যায়। এ ছাড়া মামলার খরচ জোগাতে গিয়ে বিবাদীকে আর্থিক ক্ষতিরও সম্মুখীন হতে হয়। নারী ও শিশু নির্যাতনের মিথ্যা মামলার শিকার হলে আইনের মধ্যে থেকেই আদালতে লিখিত পিটিশন দায়ের করার মধ্য দিয়ে প্রতিকার পেতে পারেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারায় মিথ্যা মামলা বা অভিযোগের দায়ে অপরাধীর সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
মিথ্যা মামলাকারী সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে আদালত ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ করতে পারেন। এ ছাড়া কোনো পুলিশ কর্মকর্তা আমলযোগ্য নয়—এ রকম কোনো মামলায় মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তাঁর বিরুদ্ধেও এ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ দেওয়া যায়।
আইন যথার্থভাবে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হোক। কোনো নিরপরাধ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন—এটাই সবার প্রত্যাশা।
ইশরাত হাসান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী