
বাঘ-ভালুকের গল্প শুনতে শুনতে আমরা বড় হই বটে, কিন্তু আদৌ কি খোঁজ রাখি, কেমন আছে আমাদের ভালুকেরা? বেশ কিছুদিন হলো সে খোঁজই করছিলাম। সাফারি পার্ক, চিড়িয়াখানা, ছোট ছোট পার্ক আর পিকনিক স্পটের পাশাপাশি বুনো পরিবেশে। এক বন্ধু পাঠালেন যশোরের একটি চিত্তবিনোদন উদ্যানে বন্দী এক ভালুকের ভিডিও। ভালুকটি সম্পর্কে জানা ছিল।
অনেকেই বলেছিলেন, এটি এশীয় কালো ভালুক নয়। বুকের দাগ আর মাথার আকার দেখে নিশ্চিত হলাম, এটি সূর্য–ভালুক। পৃথিবীতে ভালুক প্রজাতির সবচেয়ে ছোট প্রতিনিধি। বাংলাদেশে মহাবিপন্ন। বদ্ধ পরিবেশে এ দেশে একমাত্র জীবিত নমুনা।
তবে ভিডিওটি দেখে মন অসম্ভব খারাপ হলো। কংক্রিটের মেঝে, লোহার খাঁচা। চারপাশ খোলা। লুকানোর জায়গা নেই। নেই উৎসুক দর্শনার্থীদের হাত থেকে একবিন্দু নিস্তার। পায়চারি করছে ক্রমাগত, চক্রাকারে। খাঁচাবন্দী বন্য প্রাণীদের এটি স্নায়বিক অসুখের প্রকাশ। আরও মর্মস্পর্শী বিষয় হচ্ছে মেঝেটি ভেজা। হাঁটতে গিয়ে বারবার পিছলে যাচ্ছে। তবু হেঁটেই চলেছে। বাঁ চোখেও গুরুতর সমস্যা। বেশ ফুলে আছে।
বাংলাদেশে সূর্য–ভালুক অত্যন্ত দুর্লভ। একসময় এ দেশের বনে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিন প্রজাতির ভালুক একই সঙ্গে বাস করত। এখন কোথাও এ রকম নেই। ২০১৫ সালে শ্লথ ভালুক বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। মৌলভীবাজার আর পার্বত্য চট্টগ্রামের মিশ্র-চিরসবুজ বনগুলো বাংলাদেশে ভালুকের শেষ আবাসস্থল।
সংখ্যায় এশীয় কালো ভালুকেরাই বেশি। কিন্তু ভোঁতা মাথা, চওড়া কপাল, ছোট কান আর বুকে হলুদ দাগ লাগানো সূর্য–ভালুকের খোঁজ সহজে মেলে না। এক দশক আগের সারা দেশে এক মাঠ সমীক্ষায় সূর্য–ভালুকের নিশ্চিত কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তবে খুব অল্প হলেও এ দেশে তারা এখনো আছে। ২০১৬ সালে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স আর ২০২১ সালে আইইউসিএন বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্যামেরা-ট্র্যাপ গবেষণায় এদের ছবি পাওয়া গেছে। সেটাই বুনো পরিবেশে সাম্প্রতিক সময়ে সূর্য–ভালুকের উপস্থিতির একমাত্র প্রমাণ।
উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতেও সূর্য–ভালুকের উপস্থিতি কম। অল্প পরিমাণে আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বনগুলোতে। উঁচু গাছ, নিভৃত বন আর মধু এদের অত্যন্ত প্রিয়।
বর্তমানে ভালুক থাকার মতো কোনো বন যশোরে নেই। সূর্য–ভালুকের বন্দী নমুনাটি সম্ভবত একসময় পার্বত্য বনে বাস করত। জাতীয় তথ্য বাতায়ন যশোর সদর উপজেলা অনুযায়ী, পার্কটি ১৯৯৮ সালে যশোর শহরের উপকণ্ঠে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
আশ্চর্য হলাম জেনে যে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর বনভোজনের স্থান এই পার্কের মিনি চিড়িয়াখানাতে সূর্য–ভালুকের সঙ্গী হিসেবে আছে মেছো বিড়াল, বন বিড়াল, অজগরসহ নানা বন্য প্রাণী ও পাখি।
বাংলাদেশ বন্য প্রাণী আইন ২০১২ অনুযায়ী, প্রতিটি প্রজাতি সংরক্ষিত। অসুস্থ কিন্তু অত্যন্ত মূল্যবান সূর্য–ভালুকের এই নমুনাকে দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া জরুরি। আরও বেশি জরুরি বিজ্ঞানসম্মতভাবে একে নিরিবিলি জায়গায় সংরক্ষণ করা। এতে প্রায় অজানা এই প্রজাতির আচরণ সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যাবে। সূর্য–ভালুক দ্রুত কমছে। সারা পৃথিবীতে বুনো পরিবেশে এদের সংখ্যা ১০ হাজারের কম।
আমাদের দেশে ভালুক অবহেলিত। ভালুকের বিস্তৃতিসীমার দেশগুলোর মধ্যে এই প্রাণী নিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণের কাজ সবচেয়ে কম হয়েছে বাংলাদেশে। সেই মন খারাপের মধ্যে ভিডিওতে বন্দী ভালুকটিকে দেখে চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
মুনতাসির আকাশ, সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়