আহত শিশুকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে গিয়েছিল মো. আরমান হোসেন মোস্তফা (১৩)। সে মাইলস্টোন স্কুলের বাংলা মাধ্যমের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র
আহত শিশুকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে গিয়েছিল মো. আরমান হোসেন মোস্তফা (১৩)। সে মাইলস্টোন স্কুলের বাংলা মাধ্যমের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র

ভাইরাল সেই ছবির সাহায্যকারী ছেলেটির নাম মোস্তফা

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পেছনে মানুষ আতঙ্কে ছোটাছুটি করছে। একটি ভবনে আগুন জ্বলছে। সেই ভবনের সামনে দগ্ধ, রক্তাক্ত এক ছেলেকে জড়িয়ে ধরে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে এক কিশোর। ভিডিও থেকে এই দৃশ্যের একটি ছবি তৈরি করেন কেউ একজন। ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী ভবনের ওপর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার পর ছবিটি মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মর্মস্পর্শী অনেক রূপক ক্যাপশন ছিল সেই ছবি ঘিরে। এর মধ্যে যে ক্যাপশনটি সবচেয়ে বেশি ঘুরতে দেখা যায়, সেটি হচ্ছে, ‘আমার বন্ধু আমাকে দেখে হাসল এবং তার শেষ কথাটা বলল, আমি জানতাম তুমি আসবে!’ এই ছবি ও রূপক ক্যাপশন কাঁদিয়েছে অসংখ্য মানুষকে।

বাস্তবে আহত ও সাহায্যকারী কিশোর কেউ কাউকে চেনে না, তারা সহপাঠী-বন্ধু নয়। ঘটনার সময় সাহায্যকারী কিশোর আহত সেই অচেনা কিশোরকে উদ্ধারে ছুটে গিয়েছিল। ভিডিওতে সাহায্যকারী কিশোরের চেহারা স্পষ্ট হলেও আহত কিশোরের শুধু পেছন দিকটা দেখা যায়।

খোঁজ করে জানা গেছে, ভাইরাল সেই ছবিতে আহত শিক্ষার্থীকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাওয়া কিশোরের নাম মো. আরমান হোসেন মোস্তফা (১৩)। সে মাইলস্টোন স্কুলের বাংলা মাধ্যমের ষষ্ঠ শ্রেণির মার্স (মঙ্গল গ্রহ) শাখার ছাত্র। ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম ও আয়েশা বেগমের ২ মেয়ে ও ৩ ছেলের মধ্যে চতুর্থ সে। উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নির্মিত বহুতল ফ্ল্যাট ভবনের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চার বছর ধরে বসবাস করছে মোস্তফার পরিবার। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ওই বাসায় গিয়ে কথা হয় মোস্তফার মা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে। সে সময় উপস্থিত ছিল মোস্তফা। বাবা ছিলেন অফিসে।

মোস্তফার বড় দুই বোন রাবেয়া আক্তার ও নাদিয়া আক্তার বিয়ে করে আলাদা সংসারে। এই বাসায় তিন ভাই মা–বাবার সঙ্গে থাকে। বড় ভাই মো. আবির হোসেন আন্তর্জাতিক ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন করার জন্য ইউরোপের দেশ লিথুয়ানিয়ায় যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছেন। তিন বছর মাদ্রাসায় পড়ে বাংলা মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি হওয়ার কারণে কিছুটা পিছিয়ে মোস্তফা। ছোট ভাই মো. আদিব হোসেন মিকাইল তার সঙ্গে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।

আহত শিশুর কাছে দৌড়ে গিয়ে তাকে সহযোগিতা করার জন্য চিৎকার করে অন্যদের ডাকছিল মোস্তফা। তার এই ছবি অনেকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়

উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলের প্রধান ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা গেছে, বাংলা মাধ্যমের একতলা ভবনটি স্কুলে ঢুকতে বাঁ পাশে। সোজা রাস্তা ধরে এগিয়ে বাঁয়ে মোড় নিলে ডান পাশে হায়দার আলী ভবন, যেখানে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।

মোস্তফা শিশু হওয়ায় তার কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা শোনেনি প্রথম আলো। সেই দিনের ঘটনা শোনা হয় মোস্তফার মা ও ভাইয়ের কাছ থেকে। তাঁরা জানান, ২০২৩ সালে মোস্তফা ও ছোট ভাই মিকাইলকে মাইলস্টোন স্কুলে ভর্তি করা হয়। প্রতিদিনের মতো ঘটনার দিন ২১ জুলাই দুই ভাই একসঙ্গে স্কুলে যায়। এরপর যা ঘটেছে, তা দুই ভাই তাঁদের কাছে পুঙ্খানুপঙ্খ বর্ণনা দিয়েছে। বেলা একটায় স্কুল ছুটির পর বাংলা মাধ্যমের ভবনের সামনের মাঠে দাঁড়িয়ে ছিল মোস্তফা। ছোট ভাই মিকাইল তখনো ভবনের ভেতরে। হঠাৎ হায়দার আলী ভবনে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শুনে মোস্তফা সেদিকে দৌড়ে যায়। গিয়ে দেখে বীভৎস অবস্থা। আতঙ্কে সবাই ছোটাছুটি করছে। কেউ পুড়ে শেষ, কেউ ভয়াবহ দগ্ধ হয়ে ভবনের সামনে পড়ে রয়েছে। ওই অবস্থায় মোস্তফা ঘটনাস্থল থেকে সরে না গিয়ে উদ্ধারের জন্য দৌড়ে যায়।

দগ্ধ ছেলেটিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মোস্তফা

আহত ছেলেটিকে ধরে সাহায্য করার জন্য চিৎকার করে অন্যদের ডাকছিল মোস্তফা। সেই ঘটনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মা আয়েশা বেগম অঝোরে কাঁদতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘মোস্তফা বলেছে, সে গিয়ে দেখে, হায়দার আলী ভবনের সামনে ছেলেটি পড়ে রয়েছে। ছেলেটি মারাত্মকভাবে পুড়ে গিয়েছিল। আগুনের হলকায় তার গা ছিল গরম। গা থেকে রক্ত ঝরছিল। মোস্তফা গিয়ে ছেলেটিকে ধরে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকে।’ মা জানান, কেউ একজন আগুন লাগার সময়টা ভিডিও করেছিলেন। সেই ভিডিওতে এই দৃশ্য ধরা পড়ে। মোস্তফার চিৎকারে একজন লোক (ভিডিওতে নীল শার্ট পরা একজন লোককে মোস্তফার দিকে ছুটে যেতে দেখা যায়) তখন সাহায্য করার জন্য দৌড়ে আসেন। দুজন মিলে ছেলেটিকে ধরে এক পাশে সরিয়ে নেয়। মোস্তফা দেখেছিল, আহত কিশোরের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তখন সে ‘অক্সিজেন লাগবে’ বলে চিৎকার করতে থাকে।

মা আয়েশা বেগম আরও বলেন, তখন কলেজের এক ছাত্র দৌড়ে আসে। ওই ছাত্র ও মোস্তফা মিলে স্কুলের প্রাথমিক চিকিৎসা কক্ষে নিয়ে যায়। মোস্তফা প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাদানকারীদের একজনকে বলে, ‘আঙ্কেল, ওকে (আহত ছাত্র) অক্সিজেন দেন।’ মোস্তফা ছেলেটের নাম জানতে চায়, কিন্তু ছেলেটি কোনো কথা বলতে পারছিল না। প্রাথমিক সেবাদানকারী ‘আঙ্কেল’ আহত ছেলেটিকে অক্সিজেন দেন। পরে ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে যান সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা। আয়েশা বেগম বলেন, আহত ছেলেটা কে, কোন শ্রেণিতে পড়ে, সে বেঁচে আছে কি না, তা–ও তাঁরা জানেন না। কথা বলার এ পর্যায়ে অচেনা সেই কিশোরের জন্য কেঁদে ফেলেন তিনি। মোস্তফার কাছ থেকে শুনেছেন, ছেলেটি সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণির ছাত্র বলে মনে হয়েছে তার। তিনি বলেন, হায়দার আলী ভবনে এক বছর তাঁর ছেলেরাও কোচিংয়ে ক্লাস করেছে। আগুনে পোড়ার আগে ভবনের সামনে ছিল ফুলের বাগান। সাজানো-গোছানো। এত মৃত্যু আর পোড়া ভবনের দৃশ্য তাঁকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

মাইলস্টোন স্কুলের ইংরেজি মাধ্যমের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মোহাম্মদ সায়েদুল আমীন ঘটনার সময় দোতলার বারান্দার এক পাশের গ্রিল ভেঙে কয়েক ছাত্রকে নিয়ে বের হন। তাঁর কাছে ভিডিওটি পাঠিয়ে আহত ছেলের পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। তবে ছেলেটার শুধু পেছন দিকটা দেখে তিনি চিনতে পারছেন না বলে জানান। তিনি বলেন, ছেলেটা কে, তা তিনি খোঁজ করবেন। তিনি ছবির সাহায্যকারী কিশোরকে মোস্তফা বলে নিশ্চিত করেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আজ বুধবার সকাল ১০টার তথ্য অনুসারে, এ ঘটনায় পাইলটসহ এখন পর্যন্ত ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৪৫ জন। এর মধ্যে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৩৩ জন, ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ১১ জন এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১ জন চিকিৎসাধীন। মাইলস্টোন স্কুল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে, নিহতদের মধ্যে ২৭ জন শিশু, ৩ জন অভিভাবক, ২ জন শিক্ষক ও ১ জন কর্মচারী।

মা ও অন্য দুই ভাইয়ের সঙ্গে মো. আরমান হোসেন মোস্তফা

মোস্তফার শার্ট ছিল রক্তে ভেজা

মোস্তফার বড় ভাই মো. আবির হোসেন বলেন, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে তাঁরা জানতেন না। বেলা ১টা ৫২ মিনিটে অন্য একজনের ফোন থেকে তাঁর নম্বরে ফোন করে ছোট ভাই মিকাইল। ঘটনা শুনে তিনি দৌড়ে বাসা থেকে বের হন। স্কুলে গিয়ে দেখেন, মানুষের ভিড়। স্কুলে ঢোকাই কঠিন হচ্ছিল। স্কুলের খুব কাছেই সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন। ফলে ঘটনার পরপরই তাঁরা স্কুলে এসে উদ্ধারকাজ শুরু করে দেন। তিনি স্কুলে ঢুকে ছোট ভাই মিকাইলকে বাংলা মাধ্যমের ভবনের কাছেই পান। কিন্তু মোস্তফাকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ৩০-৪০ মিনিট পর মোস্তফাকে পান। পরনের শার্ট পুরোটাই রক্তে লাল ছিল। মোস্তফা আহত ভেবে তিনি ভীত হয়ে পড়েন। পরে মোস্তফা জানায়, এ রক্ত সেই আহত ছেলের। ওই ছেলেকে হাসপাতালে নেওয়ার পর সে ফায়ার সার্ভিসকে বালতি দিয়ে পানি আনা–নেওয়ার কাজে সাহায্য করেছে। আগুন নেভানোর পর ধ্বংসাবশেষ অপসারণেও সাহায্য করেছে। মোস্তফা শিশু। উদ্ধারকাজ তার জন্য বিপজ্জনক। একপর্যায়ে উদ্ধারকারী দল মোস্তফাকে সরে যেতে বলে। আবির জানান, বেলা সাড়ে তিনটার দিকে মোস্তফা ও মিকাইলকে নিয়ে তিনি বাসায় ফেরেন।

ট্রমায় ছিল মোস্তফা

মোস্তফার মা আয়েশা বেগম বলেন, মোস্তফার শার্টে এত রক্ত দেখে তিনি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। পরে শোনেন, এই রক্ত সেই আহত ছেলের। ছেলের শার্ট-প্যান্ট ধোওয়ার সময় বালতির পর বালতি পানি লেগেছিল রক্ত পরিষ্কার করতে। তিনি প্রার্থনা করে বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! না জানি কার সন্তানের এত রক্ত ঝরল! ছেলেটা যেন বেঁচে থাকে! মায়ের বুক যেন খালি না হয়!’

মা বলেন, মোস্তফা ঘটনার সময় সাহসী ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এরপর সে ট্রমার (মানসিকভাবে বিপর্যস্ত) শিকার হয়। রাতে প্রচণ্ড জ্বর আসে। তিন দিন ছিল সেই জ্বর। ঘুমের মধ্যে ছটফট করত। এখনো কিছু খেতে পারে না। ওজন কমে গেছে। তিনি বলেন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, স্কুলের শিক্ষক সবাই ঘটনার পর থেকে খোঁজ নিয়েছেন। সেই ভাইরাল ছবিটি নিয়ে মোস্তফার জন্য গর্ব করেছেন। তিনি বলেন, সবাই দোয়া করবেন, মোস্তফা যেন মানবিক মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে। যারা আহত, তারা যেন সুস্থ হয়ে ওঠে।