
শুধু ভাতা ও বৃত্তি দিয়ে প্রান্তিক নারীদের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাঁদের সত্যিকার উন্নয়নের জন্য দরকার আইনি সুরক্ষা ও সব ক্ষেত্রে অধিকার নিশ্চিত করা। প্রচলিত আইন, নীতি ও সামাজিক সুরক্ষা পরিকল্পনায় কাঠামোগতভাবে প্রান্তিক নারীর অবস্থান সুদৃঢ় করতে হবে। আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে প্রান্তিক নারীদের জন্য করণীয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলো ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এ আহ্বান জানান বক্তারা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘কাঠামোগতভাবে প্রান্তিক নারীদের অধিকার ও করণীয়’ শিরোনামে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
বিষয়বস্তুর ওপর মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক সাইমী ওয়াদুদ। প্রতিবেদনে বলা হয়, দলিত, প্রতিবন্ধী, লিঙ্গবৈচিত্র্যপূর্ণ জনগোষ্ঠী, আদিবাসী—এমন ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারী তাঁর নারী পরিচয়ের কারণে অধিক ও ভিন্নতর বৈষম্যের শিকার হন। আইন-আদালত, শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ সব ক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীরা তাই বিশেষভাবে প্রান্তিক হয়ে ওঠেন।
বৈঠকে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আবু ইউছুফ বলেন, সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে। তবে জনসংখ্যার তুলনায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা যতখানি হওয়া উচিত, এখনো ততখানি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ভাতার পরিমাণও প্রতীকী, তবে এটা পরিবারে ভাতাভোগীদের মর্যাদা বাড়ায়। তিনি বলেন, ‘আমরাও ভাতার ওপর নির্ভর করতে চাই না। এ কারণে নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন, তাঁদের তৈরি পণ্য বাজারে পৌঁছাতে সংযোগ স্থাপনে জোর দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি সমস্যা সমাধানে সরকারের কাজে বিভিন্ন সংগঠনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সাইদুর রহমান খান বলেন, প্রান্তিক নারীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। তবে সরকার কিছু করছে না, তা নয়। গত অর্থবছরে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় করা হয়েছে। সচেতনতা বাড়াতে ইউনিয়ন সামাজিক ফোর্স গঠন করা হচ্ছে। প্রান্তিক নারীদের জন্য কীভাবে আরও ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করা যায়, সেসব নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কোনো সংগঠন বা গবেষক তাঁদের প্রস্তাব নিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সঙ্গে কাজ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব করে সরকার সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য ৬০ শতাংশ এবং এর বাইরের এলাকার জন্য ৮০ শতাংশ আর্থিক সুবিধা দেবে।
মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান বলেন, পাহাড়, উপকূল ও সমতলভেদে কোন এলাকার জন্য কী ধরনের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, সেটা যাচাই করে কর্মসূচি নেওয়া উচিত। সামনে নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাইলে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রান্তিক নারীদের জন্য করণীয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাহাড়ি নারীদের অধিকার বঞ্চনার কথা তুলে তিনি বলেন, যত দিন রাষ্ট্র নজর না দেবে, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হবে, তত দিন পাহাড়ি নারীদের প্রতি সহিংসতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ হবে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, দেশের জনগোষ্ঠীর ৫১ শতাংশ নারী হলেও তাঁরা প্রান্তিক। ভাবা হয় ভাতা ও বৃত্তি দিলে সব সমস্যার সমাধান হবে। সংকট হচ্ছে মানসিকতায়, চেতনায়, গ্রহণযোগ্যতায়। এর ফলে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী অনগ্রসরই থাকে। এখনো নারীর মজুরিবৈষম্য প্রকট।
দলিত নারী ফোরামের প্রকল্প কর্মকর্তা তামান্না সিং বড়াইক বলেন, নারী চা–শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এখন ১৮৬ টাকা। এত কম টাকায় এই সময়ে চলা যায় না। নারী শ্রমিকদের উন্নয়ন করতে চাইলে আগে নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ দলিত অ্যান্ড ইনডিজেনাস উইমেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বনানী বিশ্বাস দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের কথা গণমাধ্যমে বেশি করে তুলে আনার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দলিত নারীদের বিবাহ নিবন্ধন, বিবাহ বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকারের অধিকার নিয়ে সরকারকেই উদ্যোগ নেওয়া দরকার। কারণ, এগুলো সম্প্রদায়ের নেতারা কখনো হতে দেবেন না।
যশোরের দলিত নারী প্রতিনিধি ও গবেষক মিনা রানী বিশ্বাস সামাজিক পরিসরে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘যতক্ষণ পরিচয় না জানে, ততক্ষণ আমরা মানুষ থাকি। যখন পরিচয় জানে, তখন আমাদের ঘৃণার চোখে দেখা হয়। পড়াশোনায় যোগ্যতা অর্জন করার পরও অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়।’ তিনি বলেন, দলিত জনগোষ্ঠী সরকারি ভাষায় যেটাকে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে সেবা দেওয়া হয়, তাদের সেই সব সেবা নিয়ে প্রচার বাড়ানো উচিত। একদিকে সেবা কম, অন্যদিকে সেবা সম্পর্কে না জানার কারণে বঞ্চিত হয় তাঁর জনগোষ্ঠীর মানুষ।
উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটি ডেভেলপমেন্ট কর্মসূচির সহসমন্বয়কারী শারমিন আক্তার বলেন, সেবা নিতে প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে সরকারি অফিসগুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য র্যাম্প, লিফট, টয়লেট থাকা দরকার। বিল্ডিং কোড মেনে র্যাম্প করতে হবে। অনেক ভবনে নির্দিষ্ট মাপ ছাড়া র্যাম্প করা হয়। ওই সব র্যাম্পে হুইলচেয়ার একা চালিয়ে কোনো প্রতিবন্ধী উঠতে পারেন না, বরং তা ঝুঁকি তৈরি করে।
গবেষক ও অধিকারকর্মী সুচিত্রা সরকার হিন্দু নারীদের উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পদের ওপর অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
‘সম্পূর্ণা’র নির্বাহী পরিচালক জয়া সিকদার ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের প্রতি সংবেদনশীল আচরণ ও সরকারি সেবা বাড়ানোর ওপর জোর দেন।
অধিকারকর্মী প্রাপ্তি তাপসী বলেন, নারীর জন্য কোটা ছিল ইতিবাচক বৈষম্য। এই কোটা না থাকলে অনেক প্রান্তিক নারী উঠে আসতে পারেন না বলে মনে করছেন অনেকে।
ঢাকার মিরনঝিল্লার দলিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি পূজা রানী দাস বলেন, শুধু ভাতা-বৃত্তি নয়, দলিত নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে যথাযথ পরিমাণে ঋণসুবিধা থাকা দরকার। তিনি জানান, তাঁদের পঞ্চায়েত কমিটিতে নারীর জন্য কোনো আসন বরাদ্দ নেই।
অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন ব্লাস্টের পরিচালক (পরামর্শ ও যোগাযোগ) মাহবুবা আক্তার। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।