ছোট্ট রাইসুলকে দেখলে যে কারও মনে হবে সে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরিয়েছে। কাঁধে স্কুল ব্যাগ, হাতে ছাতা। তবে তার ব্যাগে বই ছিল না। খালি ব্যাগ নিয়ে মায়ের সঙ্গে বাসা থেকে বের হওয়ার কারণ, সে টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) ট্রাক থেকে পণ্য কিনবে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মা ও ছেলে পৃথক লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় ছিল টিসিবির ট্রাকের।
ট্রাক আসে সকাল সাড়ে ১০টায়। রাইসুল ও তার মা ৯টা থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। সে পড়ে রাজধানীর একটি প্রাইমারি স্কুলে, দ্বিতীয় শ্রেণিতে। তারা চার ভাইবোন। সে দ্বিতীয়। তার বাবা মোহাম্মদপুরের একটি খাবারের দোকানে কাজ করতেন। এ মাসের শুরুতে দেশজুড়ে কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হওয়ার পর হোটেলের মালিক তার বাবাকে বলে দিয়েছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে চাকরিতে ফিরতে, আপতত ছুটি।
রাইসুলের ছোট ভাইয়ের জন্ম হয়েছে দুই সপ্তাহ আগে। ওই সময়টায় তার মাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। তখন রাইসুলের বাবার সঞ্চয় যা ছিল সব চিকিৎসার পেছনে চলে যায়। তাদের বাসা মোহাম্মদপুরের টিনশেড এলাকায়। রাইসুলের মা শাহীনা বেগম জানান, অস্ত্রোপচারের পর তিনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হননি। কোমরে বন্ধনী (বেল্ট) পরে এসেছেন। কিন্তু ধাক্কাধাক্কিতে দাঁড়াতে পারছেন না। পেটের কাটা অংশে ব্যথা হচ্ছে।
রাইসুলের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন প্রখর রোদ। টিসিবির ট্রাকের সামনে নারীদের লাইনেও ছিল বিশৃঙ্খলা। কিছুক্ষণ পর রাইসুল এই প্রতিবেদককে ডেকে বলে, ‘আঙ্কেল, মায়ের জন্য ছাতাটি দেবেন?’ রাইসুলের ভয়, এক লাইনে থেকে কিছুক্ষণের জন্য সে সরে গেলে পরে আর লাইনে জায়গা পাবে না। লাইনে থাকা অন্যরা তাকে অভয় দিয়ে তখন বলছিল, ‘বাবু, তুমি গিয়ে মায়ের জন্য ছাতা দিয়ে আসো। তোমার লাইনে জায়গা থাকবে।’
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় টিসিবির ট্রাক আসে বেলা পৌনে ১১টায়। আর রাইসুল ও তার মা পণ্য কিনতে পারেন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে। টিসিবির ট্রাক থেকে একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল, দুই কেজি করে ডাল ও চিনি কিনতে পারেন। এতে একজন ক্রেতার খরচ পড়ে ৭২০ টাকা। বাজারে এই পরিমাণ পণ্য কিনতে অন্তত এক হাজার টাকা খরচ হয়। টিসিবি প্রতি কেজি চিনি ও ডাল বিক্রি করে ৫৫ টাকা দরে। আর প্রতি লিটার তেলের দাম নেয় ১০০ টাকা।
ন্যায্যমূল্যের পণ্য কিনতে রাজধানীতে টিসিবি এবং ওএমএসের ট্রাকের সামনে মানুষের ভিড় প্রতিদিনই বাড়ছে।
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে টিসিবির পরিবেশক মাইশা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের বিক্রিয় প্রতিনিধি আজহার আলী জানান, টিসিবি থেকে প্রতি ট্রাকের জন্য এক হাজার লিটার সয়াবিন তেল (৫ লিটারের ২০০টি বোতল) ৪০০ কেজি ডাল ও চিনি ৭০০ কেজি বরাদ্দ দেয়; যা দিয়ে সর্বোচ্চ ২০০ জনকে দেওয়া সম্ভব। তিনি বলেন, আগে কখনো এত মানুষ একসঙ্গে লাইনে দাঁড়াতেন না। এখন বহু মানুষকে পণ্য না পেয়ে ফিরে যেতে হয়।
মোহাম্মদপুর টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে আসা মাহফুজা আক্তারের সঙ্গে ছিল তাঁর সাড়ে চার বছরের মেয়ে হৃদিতা। সে–ও মায়ের সঙ্গে লাইনে ছিল। মাহফুজার স্বামী মো. রতন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার অপারেটরের কাজ করেন। করোনা পরিস্থিতিতে নিয়মিত বেতন হচ্ছে না তাঁর।
মাহফুজা বলেন, আগে কখনো টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে কিছু কেনেননি। করোনার কারণে সংসারের খরচ জোগাতে স্বামীর কষ্ট দেখে তাঁকে না জানিয়েই এখানে এসেছেন। টিসিবির ট্রাকে বাজারের চেয়ে কম দামে তেল, ডাল ও চিনি কেনা যায়। এটি অন্যদের কাছ থেকে কিছুদিন আগে শুনেছেন।
রাজধানীর ৬৭টি স্থানে গতকাল ট্রাকে করে ন্যায্যমূল্যে তেল, চিনি ও ডাল বিক্রি করেছে টিসিবি।
দীর্ঘ লাইন ওএমএসের ট্রাক সেলেও
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওএমএসের (খোলাবাজারে বিক্রি কর্মসূচি) ট্রাক সেলেও গতকাল ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প ও কাঁঠালবাগানে ওএমএসের ট্রাক সেলের দুটি পয়েন্টে গতকাল সরেজমিনে দেখা যায় ক্রেতার ভিড়।
১০টি ট্রাকে ওএমএসের মাধ্যমে রাজধানীতে চাল-আটা বিক্রি করছে খাদ্য অধিদপ্তর। এর বাইরে পরিবেশকদের মাধমে ৯৫টি দোকানেও ন্যায্যমূল্য চাল–আটা বিক্রির ব্যবস্থা রেখেছে অধিদপ্তর।
গতকাল সাড়ে ১২টার দিকেও জেনেভা ক্যাম্পের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ওএমএসের চাল কিনতে নারী ও পুরুষের দুটি লাইনে প্রায় ৮০ জন দাঁড়ানো। ভিড় ও বিশৃঙ্খলা সামলাতে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছিলেন।
খাদ্য অধিদপ্তরের পরিবেশক কাজল মিয়া বলেন, প্রতি ট্রাকের জন্য ২ হাজার ৬০০ কেজি চাল ও ৪০০ কেজি আটা বরাদ্দ হয়। চাল কেজিপ্রতি ৩০ টাকা ও আটার দাম কেজিপ্রতি ২৩ টাকা। একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ ৫ কেজি চাল ও ৩ কেজি আটা কিনতে পারেন।
চাল কিনতে লাইনে দাঁড়ান দুলালী বেগমের কোলে দুই মাস বয়সী মেয়ে রানি। দুলালী বলেন, তাঁর স্বামী আকরাম সেলুনে কাজ করতেন। লকডাউনে সেলুন বন্ধ, আয়ও বন্ধ। প্রতিবেশীর কাছ থেকে টাকা ধার করে চাল কিনতে এসেছেন তিনি।