
রমজান মাসে ইফতারি বাদে বছরের বাকি দিনগুলো চকের আসল রোশনাই ছড়ায় পাইকারি ও খুচরা ইমিটেশনের গয়নার বাজার।
প্রতিবছর পবিত্র রমজানে পুরান ঢাকার চকবাজারও চলে আসে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, ভিডিও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভরে ওঠে চকের সুস্বাদু ইফতারির ছবি আর প্রতিবেদনে। কাবাব, রেজালা, পোলাও-বিরিয়ানি থেকে শতাধিক পদের ঝাল, মিষ্টি, টক স্বাদের খাদ্যপানীয় নিয়ে চকের ইফতারির বাজার জমজমাট থাকে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত। তারপর বদলে যায় চকের সেই ছবি। বছরের বাকি দিনগুলো চক ঝলমল করে গয়নার জৌলুশে। দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি ও খুচরা ইমিটেশনের গয়নার বাজার গড়ে উঠেছে চকে।
অলংকার ও সাজসজ্জার উপকরণের কত দোকান আছে চক বাজারে? কোথা থেকে আসে এসব মালামাল আর কারাই–বা এই ব্যবসা নিজেদের করে রেখেছেন? এসব জানার আগে দু–চার কথায় একটু ইতিহাসটা জেনে নিই চলুন।
‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন’ যতই থাকুক, সঙ্গে কাচের চুড়ির রিনিঝিনি ঝংকার না উঠলে কি আর শ্রবণ ও দৃষ্টিতে তুষ্টি আসে? কাচের চুড়ির সবচেয়ে বড় জোগানদাতা এই চকবাজার। শত শত নয়, হাজার হাজার দোকান আছে এখানে। এসব দোকানের তিন পাশের দেয়াল আর সামনে সাজিয়ে রাখা রংবেরঙের চুড়ির বর্ণবিভা যেন রংধনুর বর্ণাঢ্যতাকেও ছাড়িয়ে যায়। আর গয়নার দোকানে কত ধরনের, কত বিচিত্র নকশার অলংকার যে রয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
চকবাজারের পত্তন হয়েছিল সুবাদার ইসলাম খাঁর ঢাকায় আসার কিছু আগে। সেনাপতি মানসিংহ ১৬০২ সালে ভাওয়াল থেকে তাঁর সদর দপ্তর স্থানান্তর করেছিলেন চকে। পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগার যেখানে ছিল, সেখানেই। এখানে স্থাপিত দুর্গ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতান্তর আছে। কারও মতে এই দুর্গ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মোগল যুগে, কারও মতে দুর্গটি আরও আগে থেকেই ছিল। যাহোক, এই দুর্গের পাশেই গড়ে উঠেছিল ‘চকবাজার’। সে হিসাবে চকবাজারের বয়স ৪২৩ বছরের আশপাশে। ফারসি শব্দ ‘চক’ থেকে এসেছে চকবাজার। এখানে একসময় দাস কেনাবেচা হতো। সুবাদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৭৬ সালে চকবাজারে একটি সুদৃশ্য মসজিদ স্থাপন করেন। এ মসজিদই বর্তমানের চকবাজার শাহি জামে মসজিদ (অনেকটাই সংস্কার করা হয়েছে)। মসজিদ স্থাপনের পরেই চকবাজারের পরিধি বেড়ে উঠেছিল। তবে নবাব মুর্শিদ কুলি খানই প্রথম সুপরিকল্পিতভাবে চকবাজারকে সম্প্রসারিত করে একটি আধুনিক বাজারে রূপান্তরিত করেছিলেন ১৭১৭ সালে। ব্রিটিশ আমলে চকের বাণিজ্যিক গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াল্টার ১৮২৫ সালে চকবাজারের সড়কগুলো প্রশস্ত করে বাজারের চারপাশে উঁচু দেয়াল তৈরি করেন। ভেতরে প্রবেশের জন্য নির্মাণ করেছিলেন ১৬টি প্রবেশদ্বার। সেসবের চিহ্ন এখন আর নেই। এখন যা আছে, তা হলো ওই চকমকে ঝকমকে গয়নাগাটিসহ হরেক পণ্যের বিশাল বিপুল বাণিজ্য।
চকবাজারের কথা মনে এলে এখানকার ঐতিহ্যবাহী ইফতারির কথা প্রথম দিকেই আসে। এ ছাড়া চকের অন্য প্রধান ব্যবসার মধ্য শুরুতেই রয়েছে ইমিটেশনের গয়না ও সাজসজ্জার উপকরণ। এ ছাড়া আছে বাচ্চাদের খেলনা ও প্লাস্টিকের সামগ্রী। সুরমা, আতর আর পোশাক–পরিচ্ছদেরও কারবার চলে চকবাজারের আশপাশ দিয়ে।
চুড়ির মধ্যে আরও আছে নাগিন চুড়ি, ভেলভেট চুড়ি, ফাইবার চুড়ি। বিয়ের সাজের জন্য আছে ঝুমকা চুড়ি। ধাতব চুড়ি আছে অনেক ধরনের। এসবের দাম ৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।
‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন’ যতই থাকুক, সঙ্গে কাচের চুড়ির রিনিঝিনি ঝংকার না উঠলে কি আর শ্রবণ ও দৃষ্টিতে তুষ্টি আসে? কাচের চুড়ির সবচেয়ে বড় জোগানদাতা এই চকবাজার। শত শত নয়, হাজার হাজার দোকান আছে এখানে। এসব দোকানের তিন পাশের দেয়াল আর সামনে সাজিয়ে রাখা রংবেরঙের চুড়ির বর্ণবিভা যেন রংধনুর বর্ণাঢ্যতাকেও ছাড়িয়ে যায়। আর গয়নার দোকানে কত ধরনের, কত বিচিত্র নকশার অলংকার যে রয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
সম্প্রতি এক দুপুরে চকবাজারের এসব অলংকার ও সাজসজ্জার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হয়। শাহি জামে মসজিদের সামনের সড়কের চুড়ির দোকান ‘সোনার বাংলা চুড়িঘর’–এর ব্যবসায়ী মো. সুমন জানান, চকে রমজানে যেমন ইফতারির জমজমাট ব্যবসা, তেমনি তাঁদের ব্যবসারও প্রধান মৌসুম রমজান মাসেই। শুরু হয় শবে বরাত থেকে। চাঁদরাত পর্যন্ত চলে। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বসন্ত, বৈশাখ উৎসবেও যথেষ্ট বিক্রি হয়। এখানে কাচ, ধাতব, প্লাস্টিক প্রভৃতি উপাদানের শতাধিক রকমের চুড়ি আছে। কাচের চুড়িকে বলে ‘রেশমি চুড়ি’। এগুলো বিভিন্ন রঙে ও নকশায় পাওয়া যায়। পাইকারিতে প্রতি ডজন সর্বনিম্ন ২০ থেকে শুরু সর্বোচ্চ ৪০ টাকা পর্যন্ত। খুচরায় একেক এলাকায় একেক দামে বিক্রি হয়।
চুড়ির মধ্যে আরও আছে নাগিন চুড়ি, ভেলভেট চুড়ি, ফাইবার চুড়ি। বিয়ের সাজের জন্য আছে ঝুমকা চুড়ি। ধাতব চুড়ি আছে অনেক ধরনের। এসবের দাম ৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।
অলংকারের বেশ বড় একটি দোকান ‘অলংকার সাজঘর’। এর মালিক মো. আলমগীর হোসেন আগে অন্য দোকানে বিক্রয় প্রতিনিধি ও ব্যবস্থাপকের কাজ করতেন। পরে নিজেই দোকান দিয়ে ব্যবসা করছেন। চকের এই অলংকারের ব্যবসা তাঁর ভাষায় ‘নোয়াখালীদের দখলে’। জানালেন, প্রায় ৮৫ জন ব্যবসায়ী ও কর্মচারী বৃহত্তর নোয়াখালীর মানুষ। কেমন করে এটা হলো? তিনি জানালেন, চকে ইমিটেশনের ব্যবসা শুরু হয়েছিল আশির দশকের শুরুতে। প্রথম দিকে ভারত থেকে আসত। আর বিদেশ থেকে যাঁরা আসতেন তাঁরাও ব্যাগে ইমিটেশনের গয়না ও প্রসাধনী আনতেন। এগুলো চকের কিছু দোকানে বিক্রি হতো। বিক্রেতাদের বেশির ভাগই ছিলেন নোয়াখালীর মানুষ। ব্যবসা যখন বড় হয়েছে, তখন তাঁরা গ্রাম থেকে ভাই-ভাতিজা, মামা-ভাগনেদের নিয়ে এসেছেন। এই কারবারে বিশ্বস্ত মানুষ লাগে। দোকানে হাজার হাজার টাকার মালামাল। ছোট ছোট বাক্সে থাকে। কেউ একটি বাক্স নিয়ে উধাও হলেই লাভ খতম। তা ছাড়া নোয়াখালীর মানুষের মধ্যে আত্মীয়স্বজনের প্রতি টানও একটু বেশি। সে কারণেই দিনে দিনে তাঁরা চকের গয়নার বাজার নিজেদের করে নিয়েছেন।
চকের গয়নার মধ্যে আছে চুড়ি, বালা, মালা, টিকলি, আংটি, ঝুমকা, বিছা, নূপুরসহ যাবতীয় কিছু। আলমগীর হোসেনের কাছে জানা গেল, এই মালামালের মধ্যে তুলনামূলক কম দামের জিনিস তৈরির জন্য আমলিগোলা, শহীদনগর, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও জিঞ্জিরায় হাজার হাজার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে উঠেছে। সেখান থেকেই মালামাল আসে। আর দামি অলংকার, যেগুলোকে ‘গোল্ডপ্লেটেড’ বলে, তা তৈরি হয় সাভারের ভাকুর্তা ও বগুড়ায়। এসব অলংকারের রঙের জন্য অন্তত দুই বছরের গ্যারান্টি দেওয়া হয়। যত্ন নিলে রং অনেক বছর টেকে। এর দামও একটু বেশি। আগে এসব গয়নার প্রায় সবই ভারত থেকে আসত। এখন অধিকাংশ দেশেই তৈরি হয়।
চকের অলংকারের দাম কেমন? ‘সুলতান শেখ জুয়েলারি সেন্টার’–এর ব্যবস্থাপক বাবা সাহেব বললেন, দামের কোনো ঠিক নেই। পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকার জিনিসও আছে। যার যেমন চাহিদা ও সামর্থ্য, তেমনই জিনিস মিলবে চকবাজারে।
এখন চকবাজারে ব্যবসায় মন্দা। ব্যবসায়ীরা জানান, সারা দেশে গ্রামীণ মেলা, প্রদর্শনী, ঋতুভিত্তিক উৎসবে তাঁদের মালামালের একটি বড় অংশ বিক্রি হতো। এসব আয়োজন কমে গেছে। এর প্রভাবে পাইকারি বিক্রি কমেছে।
বেচাকেনার হিসাব তার জায়গায় থাকুক। ব্যবসা ছাড়াও চকের আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সুস্বাদু খাবার। যাতায়াতে যানজটের কিছুটা ধকলও পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের মতোই। সেটি উপেক্ষা করে চকে ঘুরতে এলে তুলনামূলক বেশ কম দামে গয়নাগাটি কেনাকাটা আর রসনাবিলাসে একটি দিন অন্যভাবে কাটাতে পারেন।
চকবাজারে ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা হলো সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মোজাম্মেল হকের সঙ্গে। তিনি জানালেন, চকে দোকান হাজার হাজার। এর মধ্যে অলংকার ও সাজসজ্জার দোকান আছে পাঁচ হাজারের বেশি। লোকে চকবাজার বলতে সাধারণত শাহি জামে মসজিদের সামনের রাস্তাকেই চেনেন। কিন্তু এই বাজার অনেক বড়। উত্তরে উর্দু রোড থেকে দক্ষিণে সোয়ারীঘাট, পূর্ব-পশ্চিমে বড়কাটরা, চক মোগলটুলি হয়ে চুড়িহাট্টা পর্যন্ত। বেশির ভাগই ছোট ছোট দোকান। কিন্তু পাইকারিতে বিক্রি হয় বলে বিক্রির পরিমাণ টাকার অঙ্কে অনেক বড়। কত বড়, সে হিসাব আন্দাজ করা কঠিন।
বেচাকেনার হিসাব তার জায়গায় থাকুক। ব্যবসা ছাড়াও চকের আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সুস্বাদু খাবার। যাতায়াতে যানজটের কিছুটা ধকলও পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের মতোই। সেটি উপেক্ষা করে চকে ঘুরতে এলে তুলনামূলক বেশ কম দামে গয়নাগাটি কেনাকাটা আর রসনাবিলাসে একটি দিন অন্যভাবে কাটাতে পারেন।