
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে হতদরিদ্র পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার প্রকল্পে নয়ছয় করার অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে তালিকায় নাম থাকার পরও ঘর পাননি এমন ব্যক্তি যেমন রয়েছেন, তেমনি তালিকায় নাম না থাকার পরও টাকার বিনিময়ে ঘর পেয়েছেন, এমন ব্যক্তিও আছেন। আবার ঘর পেয়েছেন স্থানীয় পল্লি চিকিৎসক, পাকা বাড়ির মালিক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীও।
সম্প্রতি উপজেলার কাদিরপুর ও জিরতলী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ঘর বণ্টনে এসব অনিয়মের তথ্য দেখা গেছে। এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জেলা প্রশাসক তন্ময় দাস প্রথম আলোকে বলেন, ঘর দেওয়ার বিনিময়ে কেউ টাকা নেওয়ার কিংবা অন্য কোনো অনিয়ম করার অভিযোগ তাঁর কাছে কেউ করেননি, করলে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি কিছুদিন আগে সেনবাগ উপজেলায় এক ইউপি সদস্যকে শাস্তি দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
কাদিরপুর ইউনিয়নের কাদিরপুর গ্রামের দিনমজুর জাকের হোসেন (৩৫) প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় দেড় বছর আগে সরকারের পক্ষ থেকে ঘর করে দেওয়ার কথা বলে স্থানীয় ইউপি সদস্য তাঁর কাছ জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি, জায়গার খতিয়ানের ফটোকপি জমা নিয়েছিলেন। ঘরের জন্য মাটি ভরাটও করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁকে ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়নি। ঘর পেয়েছেন একই গ্রামের অন্য ব্যক্তিরা। যাঁদের মধ্যে পাকা ঘর রয়েছে, এমন ব্যক্তিও ঘর পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন জাকের হোসেন।
জাকের হোসেনের বাড়ির প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ১০০ গজের ব্যবধানে দুটি নতুন টিনের ঘর তোলা হয়েছে। ঘর দুটিতেই দুটি সাইনবোর্ড টাঙানো। সাইনবোর্ডে লেখা ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প-২, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার, কাদিরপুর ইউনিয়ন, ঘর নম্বর-২৭’। পাশের আরেকটি ঘরের নম্বর-১১। ২৭ নম্বর ঘরের মালিক এলাকার পল্লি চিকিৎসক মো. সবুজ। এই ঘরটি তৈরি করা হয়েছে একটি বাগানের ভেতর। ঘরে কেউ থাকেন না। দরজায় তালা ঝোলানো। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘরটি নির্মাণ করা হয়েছে।
অপর দিকে ১১ নম্বর ঘরটির মালিক আবদুল হাকিম। তাঁর ঘরের পাশেই একটি পাকা ভবনের কাজ চলছে। জানতে চাইলে আবদুল হাকিম বলেন, তাঁর নিজের কোনো ঘর নেই। পুরোনো বাড়িতে ভাইয়ের ঘরে থাকেন। এই বাড়িতে যে পাকা ঘরটি নির্মাণ করা হচ্ছে, তা তাঁর ভাইয়ের। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। তা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তাই চেয়ারম্যান তাঁকে এই ঘরটি দিয়েছেন। তবে প্রতিবেশী একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, নির্মাণাধীন পাকা ঘরটিও আবদুল হাকিমের। তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন।
ঘর পেয়েছেন চাকরিজীবী
কাদিরপুর গ্রামে ২২ নম্বরটি ঘরটি উপহার পেয়েছেন আবু তাহের নামের এক ব্যক্তি। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই গ্রামের বাড়িতে থাকেন না। ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন এবং স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সেখানেই থাকেন। তাঁর ঘরটিও একই অর্থবছরে তৈরি। আবু তাহেরের বোন পরিচয় দিয়ে রেখা আক্তার নামের এক তরুণী বলেন, তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে কোনো ঘর নেই। তাই ঘরটি করে দেওয়া হয়েছে।
টাকা দিয়ে ঘর কিনেছেন সাদ্দাম: আশ্রয়ণ প্রকল্প-২–এর আওতায় ঘর নির্মাণের জন্য কাদিরপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সরবরাহ করা তালিকার কোথাও সাদ্দাম হোসেনের নাম নেই। কিন্তু সাদ্দাম হোসেন একই এলাকার জসিম উদ্দিন ও নয়ন কাজির কাছ থেকে একটি ঘর কিনেছেন ৩০ হাজার টাকা দিয়ে। স্থানীয় ইউপি সদস্য বাহার এ কাজে মধ্যস্থতা করেন।
এ তথ্য জানিয়ে সাদ্দাম হোসেনের মা আনোয়ারা বেগম বলেন, তাঁর ছেলের ঘর নেই। পুরোনো বাড়িতে ভাঙাচোরা ঘরে থাকতে কষ্ট হতো। তাই ছেলের জন্য এই ঘরটি ৩০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন। ইতিমধ্যে ১০ হাজার করে ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। বাকি ১০ হাজার টাকা এখনো পরিশোধ করতে পারেননি।
তালিকায় থাকার পরও ঘর না পাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে কাদিরপুর ইউনিয়নের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন বলেন, তালিকার কারও কারও অবস্থার উন্নতি হয়েছে, তাঁদের কেউ কেউ ওই ঘর নিতে রাজি হননি; যার কারণে অন্যজনকে ঘর দেওয়া হয়েছে। দু-একটি ক্ষেত্রে হয়তো এ রকম এদিক-সেদিক হতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে অনিয়ম কিংবা আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রুহুল আমীন আশ্রয়ণ প্রকল্প-২–এ হতদরিদ্রদের ঘর বরাদ্দে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চেয়ারম্যানরা যে তালিকা জমা দিয়েছেন, ওই তালিকার মধ্যে যাঁদের নামে ঘর অনুমোদন হয়ে এসেছে, তাঁরাই পেয়েছেন।