‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি।...আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো। জীবনের প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই।’ এই তো ছিল ৫ আগস্ট, রাজধানীর চানখাঁরপুলে শহীদ হওয়া আমাদের দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট্ট শাহারিয়ার খান আনাসের চিঠি। বাবা-মায়ের উদ্দেশে লেখা শেষবিদায়ের চিঠি!
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণ–অভ্যুত্থানের ইতিহাস বইপুস্তকে পড়েছি। মুরব্বিদের কাছ থেকে ’৬৯ আর ’৯০–এর গল্প শুনেছি। তবে ২০২৪ সালে সামনে থেকে গণ–অভ্যুত্থান ঘটতে দেখেছি। অংশ নেওয়ারও সুযোগ পেয়েছি। ১৭ বছরের এক দীর্ঘ সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গগুলো যেন দাবানলে রূপ নিয়েছিল চব্বিশের জুলাই-আগস্টে।
এই সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করতে পারি, কোনো গণ–অভ্যুত্থান একক নেতৃত্ব কিংবা কৃতিত্বের মধ্য দিয়ে হয় না। গণ–অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীরা একে অপরের সাহস হয়ে ওঠে। চব্বিশে যখন ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরল, তখন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, রিকশাচালক, গৃহিণী, প্রবাসী শ্রমিক, পথশিশু, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সামগ্রিক রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা একে অপরের সাহস হয়ে প্রতিবাদে নেমে পড়েন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাহিনীর লোকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘স্যার, একটা মরলে একটাই যায়, তার সাথে থাকা অন্যরা যায় না।’ এমনটাই তো ছিল আমাদের চব্বিশের ঐতিহাসিক গণ–অভ্যুত্থানের বীরত্বের গল্প।
চব্বিশের চেতনা অপশাসন, স্বৈরশাসন ও মানুষের মুখ চেপে ধরার বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ আপসহীন সংগ্রাম। গণ–অভ্যুত্থানের এই চেতনাকে অবশ্যই আমাদের ধারণ করতে হবে। এই চেতনাকে তখনই ধারণ করা হবে, যখন এই সংগ্রামের সামগ্রিক শক্তিগুলো পারস্পরিক শ্রদ্ধা, স্নেহ, বিশ্বাস ও সহনশীলতা দেখিয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থে সবাই এক ও ঐক্যবদ্ধ থেকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখা যাবে। যদিও মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসকে যেভাবে কুক্ষিগত ও বিকৃত করা হয়েছিল, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের ইতিহাসের ক্ষেত্রেও সে রকম নানা অপচেষ্টা আমরা দেখছি। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অপতথ্য ও প্রচারণার শিকার।
যে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই করে আমরা শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনকে হটিয়েছি, গত এক বছরে সেই অপসংস্কৃতিকে কি আমরা রুখতে পেরেছি? আমরা কি পেরেছি দুর্নীতি বন্ধ করতে? আমরা কি পেরেছি যাঁদের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা মুক্ত, সেসব শহীদ এবং তাঁদের পরিবারের প্রতি ইনসাফ করতে? আমরা কি পেরেছি আন্দোলনে চিরজীবনের জন্য অঙ্গহানি হয়ে যাওয়া বীর যোদ্ধাদের পাশে থেকে সান্ত্বনা দিতে? আমরা কি পেরেছি দীর্ঘ সময়ের মজলুম শক্তিগুলোর পারস্পরিক কাদা-ছোড়াছুড়ি বন্ধ করতে? নৃশংসভাবে মানুষ হত্যায় জড়িত আওয়ামী সন্ত্রাসীদের আইনের আশ্রয়ে আনতে? প্রতিটি প্রশ্নেরই উত্তর—না।
পারস্পরিক অশ্রদ্ধা আজ গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ব্যাহত করেছে। বিগত ঈদের পরপর বহু শহীদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের অনুভব করতে চেয়েছি। তাঁদের পরিবারের প্রত্যেকের মনে গভীর শূন্যতা। জুরাইন কবরস্থানে গিয়ে এক এতিম সন্তানের সাক্ষাৎ পেলাম, বিকেল হলেই যে শহীদ বাবার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ঢাকা মেডিকেল থেকে তখনো সে তার বাবার মৃত্যুর সনদ পায়নি।
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত পতিত স্বৈরাচারের নেতা-কর্মীদের বিচার এখনো শ্লথ ও সংশয়াচ্ছন্ন। ক্যাম্পাসগুলোতে বিভিন্ন গুপ্ত সংগঠনকে ছাত্রলীগ একধরনের দখলদারত্বের মাধ্যমে সাধারণের বেশে আশ্রয় দিয়েছিল। আওয়ামী লীগপন্থী কর্মকর্তাদেরও আশ্রয় দিয়ে নিজেদের দাবি আদায় করে নিতে দেখেছি। ক্ষুদ্র স্বার্থে এ ধরনের আপস গণ–অভ্যুত্থানের চেতনাকে নষ্ট করেছে।
দীর্ঘ অপশাসনে এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ব্যাপক ক্ষয় হয়েছে। অথচ অসংখ্য শহীদের রক্ত এবং অগণিত মানুষের অঙ্গহানির বিনিময়ে সেই অপশাসনের পতনের পরও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে গণ–অভ্যুত্থানের কোনো কোনো অংশ। যে রাজনৈতিক শক্তির দীর্ঘ ১৭ বছরের লড়াই গণ–অভ্যুত্থানের ভিত্তি তৈরি করেছে, তাদের ‘০% কন্ট্রিবিউশন, ১০০% সেলিব্রেশন’ জাতীয় মব–লাঞ্ছনার শিকার করা হয়েছে। এ যেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিরই পুনরুত্থান।
যে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই করে আমরা শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনকে হটিয়েছি, গত এক বছরে সেই অপসংস্কৃতিকে কি আমরা রুখতে পেরেছি? আমরা কি পেরেছি দুর্নীতি বন্ধ করতে? আমরা কি পেরেছি যাঁদের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা মুক্ত, সেসব শহীদ এবং তাঁদের পরিবারের প্রতি ইনসাফ করতে?
গত বছর ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে দশটার দিকে ঢাকা মেডিকেলের নতুন ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আমি আকুতি জানিয়ে বলেছিলাম, ‘প্লিজ, কেউ কাউকে ছেড়ে যাবেন না।’ উপস্থিত ছাত্র–জনতা সেদিন ছেড়ে যাননি। তাঁরা ছিলেন প্রতিজ্ঞা পালনে দৃঢ়। সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আমাদের সে বিক্ষোভ থেকে পাঁচজন শহীদ হন। মাঝেমধ্যে নিজেকেই প্রশ্ন করি, সে পাঁচজন শহীদের দায়ভার কি আমার পক্ষে এড়ানো সম্ভব?
গণ–অভ্যুত্থানে ধনী, দরিদ্র, পথশিশু, শিক্ষক, আইনজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী, রিকশাচালক প্রত্যেকে প্রত্যেকের মধ্যে অপ্রতিরোধ্য সাহসে মিশে গিয়েছিলেন, বৈষম্যহীনভাবে একে অপরের পরিপূরকে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। স্বৈরাচারমুক্ত নতুন রাষ্ট্রে যখন প্রতিটি শ্রেণি–পেশার মানুষের ভেদাভেদহীনভাবে মূল্যায়ন হবে, প্রত্যেকে যখন নিজেদের অধিকার ফিরে পাবে, তখনই আমরা শহীদদের রক্তের দায় শোধ করতে পারব।