অমঙ্গল, হিংস্র, শত্রু, লোভী—আরও কত কী! কবিতা, রাজনৈতিক বক্তৃতা, বিবৃতি—সবখানে এই নেতিবাচক উপস্থাপনা একটা পাখির। অথচ বাস্তবে শকুন মৃত প্রাণীর মাংস খায়। এভাবে এটি প্রকৃতির ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মী’ হিসেবে আছে যুগ যুগ ধরে। দেশে ও বিশ্বে এই মহাবিপদাপন্ন পাখির অবস্থা এখন ভালো নয়।
নানা কারণে দিন দিন শকুনের সংখ্যা সারা দেশেই কমে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে পুরোনো ও বড় গাছ কেটে ফেলায় বাসস্থানসংকট, খাদ্যসংকট ও মৃত পশুর মাংসে ক্ষতিকর ব্যথানাশক ওষুধের উপস্থিতি। সারা দেশে শকুনের সংখ্যা কমলেও মৌলভীবাজারসহ বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে আজও বেশ শকুন দেখা যায়।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, তিন দশক আগেও দেশে অনেক শকুন ছিল। উঁচু গাছগাছালিতে সেগুলো বাস করত। কোথাও গবাদিপশু মারা গেলে ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন এসেছে। শকুনই একমাত্র পাখি, যেটি সতেজ থাকাকালেই মৃত পশুর চামড়া ফুটো করে মাংস খেতে পারে। মৃত পশুকে খেয়ে ফেলায় দুর্গন্ধমুক্ত হয় এলাকার পরিবেশ। অ্যানথ্রাক্সসহ বিভিন্ন রোগজীবাণু হজমের ক্ষমতা আছে শকুনের। কিন্তু গত দুই-আড়াই দশকে শকুনের সংখ্যা দ্রুত কমেছে। শকুনকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার বিশ্ব শকুন সচেতনতা দিবস পালিত হয়ে থাকে।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোটের (আইইউসিএন) তালিকায় মহাবিপদাপন্ন পাখির তালিকাভুক্ত শকুন। বাংলাদেশে এই পাখির সংখ্যা কমেছে অতি দ্রুত। বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০০৮ সালে দেশে ১ হাজার ৯৭২টি শকুন ছিল। ২০১৫ সালের সর্বশেষ শুমারিতে সেই সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে ২৬০টিতে। এর মধ্যে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ১০০টির মতো শকুন আছে। তার মধ্যে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা জাতীয় উদ্যানে আছে ৭০-৮০টি শকুন।
সারা দেশের মধ্যে শুধু সিলেট অঞ্চল ও সুন্দরবন এলাকায় শকুন ভালোভাবে টিকে আছে। গত ২০ ও ২১ জুলাই মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাগাবলার আটগাঁও এলাকায় ১৪টি শকুনের একটি দলকে দেখা যায়। রেমা-কালেঙ্গার আবাসস্থল থেকে এসব শকুন মৌলভীবাজারসহ বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শকুন দুই বছরে একবার একটিমাত্র ডিম পাড়ে। কোনো কারণে সেটি নষ্ট হলে প্রজাতির সংখ্যা বাড়ার সুযোগ থাকে না। শকুন সাধারণত রেইনট্রি, কড়ই, শিমুল, শেওড়া, তালগাছে বাস করে। ঝুঁকিতে থাকা এই পাখিকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই নানা উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ জন্য জলাভূমি, প্রাকৃতিক খাদ্য এবং প্রাচীন ও উঁচু গাছ সংরক্ষণ করতে হবে। সরকারি খাল-নালার পাশে এ রকম গাছ রোপণ করা যেতে পারে।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মধ্যে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলেই শকুন এখনো কিছুটা ভালো আছে। প্রকৃতির এই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের টিকিয়ে রাখতে হলে গবাদিপশুর জন্য নিষিদ্ধ ব্যথানাশক ওষুধ বিক্রি একেবারে বন্ধ করতে হবে। চা-বাগানসহ বিভিন্ন স্থানের উঁচু গাছ কাটা যাবে না। তাহলেই মানুষের জন্য উপকারী এই পাখির সংখ্যা আগের অবস্থায় ফিরতে পারে।