শুক্রবারের বিশেষ

বাঁশের অনন্য সংরক্ষণাগার

চট্টগ্রামে বাঁশ উদ্যানে ভুদুম প্রজাতির দেশি বাঁশের ঝাড়। পূর্ণবয়স্ক এই বাঁশের উচ্চতা হয় ১০০ ফুটের ওপরে l ছবি: প্রথম আলো
চট্টগ্রামে বাঁশ উদ্যানে ভুদুম প্রজাতির দেশি বাঁশের ঝাড়। পূর্ণবয়স্ক এই বাঁশের উচ্চতা হয় ১০০ ফুটের ওপরে l ছবি: প্রথম আলো

দূর থেকে দেখলে মনে হবে, একটির পর একটি কলসি জোড়া দেওয়া হয়েছে। কাছে গেলে বোঝা যায়, এটি আসলে বাঁশ। নাম ঘটি বাঁশ। উচ্চতা প্রায় ১০ ফুট। ভিয়েতনামের এই বাঁশ দেশের মানুষের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। কিন্তু দেশে এই বাঁশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। দেখতে সুন্দর হওয়ার কারণে অনেকে এটা বাগানে লাগাতে পারেন।
চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহরে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বাঁশ উদ্যানে গেলে দেখা পাওয়া যাবে এ রকম অন্তত ৩৩ প্রজাতির বাঁশ। এর মধ্যে দেশি প্রজাতিই ২৫ ধরনের। বাকি আট ধরনের কোনোটা চীনের, কোনোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে আনা।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) গ্লোবাল ব্যাম্বু রিসোর্সেস প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাঁশের প্রজাতি বৈচিত্র্যের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীতে অষ্টম। চীনে আছে ৫০০ প্রজাতির বাঁশ। দ্বিতীয় অবস্থানে ব্রাজিলে আছে ২৩২ প্রজাতি। আর বাংলাদেশে ৩৩ প্রজাতির বাঁশ আছে। তবে গবেষক এম এ আলম এ নোটস অস ট্যাক্সনমিক প্রবলেমস, ইকোলজি অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন অব ব্যাম্বু ইন বাংলাদেশ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে ২৭ জাতের বাঁশের সন্ধান পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রামের এই বাঁশ উদ্যানের প্রধান কাজ বিলুপ্তির হাত থেকে দেশি বাঁশ প্রজাতিগুলোকে রক্ষা করা, এগুলোর বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা। অর্থাৎ এটি বাঁশের বীজের একটি জার্মপ্লাজম বা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণাগার। শুধু বীজের সংরক্ষণাগারই নয়, এটি বিভিন্ন ধরনের বাঁশের চারা এবং পূর্ণাঙ্গ বাঁশঝাড় তৈরি করেছে। সরকারি বনায়নে এখান থেকে বাঁশের চারা সরবরাহ করা হয়।
ফিলিপাইনের লোকগল্পে বলা আছে, মানবজাতির প্রথম নারী ও পুরুষের নাকি জন্ম হয়েছিল বাঁশের খোলের মধ্যে। চট্টগ্রামের বাঁশ উদ্যানে গিয়ে দেশি প্রজাতির ভুদুম বাঁশের কাণ্ড দেখলে ওই লোকগল্প বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করবে। এর একটি বাঁশের ব্যাস প্রায় দুই ফুট। কয়েক মাস আগে ভুদুম বাঁশঝাড়ের উচ্চতা মাপা হয়। সবচেয়ে বড় বাঁশটির উচ্চতা ১৩০ ফুট। ভুদুম বাঁশের মতো অতটা বড় না হলেও কাছাকাছি উচ্চতার আরও কয়েকটি প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চীনা প্রজাতির ব্র্যান্ডেসি ও দেশি প্রজাতির ফারুয়া বাঁশ। এই দুই বাঁশের উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট। ঝাড়ের নিচে দাঁড়ালে মনে হবে আকাশ ছুঁয়েছে।
বন গবেষণাগারের এই উদ্যান দেশি প্রায় সব বাঁশের প্রজাতি রয়েছে। মুলি, তল্লা, বরাক, ভুদুম, বাইজ্জা, বেথুয়া, ফারুয়া, ওরা, লতা মিরতিঙ্গাসহ দেশি প্রায় ২৫ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে এই বাঁশ উদ্যানে। এ ছাড়া রয়েছে ব্র্যান্ডেসি, হেজ, থাই, চায়নাসহ আরও সাত-আট প্রজাতির ভিনদেশি জাত।
বিএফআরআইয়ের সিলভি কালচার (বন সংরক্ষণবিদ্যা) জেনেটিকস বিভাগের অধীনে পাঁচ একর জায়গায় ওই বাঁশ উদ্যান বা ‘ব্যাম্বো সেটাম’ গড়ে তোলা হয় ১৯৭৩ সালে। মূলত গবেষক, প্রশিক্ষণার্থী ও শিক্ষার্থীদের জন্যই এই উদ্যান।
সিলভি কালচার জেনেটিকস বিভাগের প্রধান মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, তিনটি টিলার ওপর গড়ে তোলা এই উদ্যান বাংলাদেশে অদ্বিতীয়। দেশের বাঁশ প্রজাতির প্রায় সবগুলোই এই উদ্যানে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

ান বাঁশ কী কাজে লাগে

উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা বলেন, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সাত ধরনের বাঁশ বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে বরাক, করজবা, বাইজ্জা, তল্লা, মাকলা, ভুদুম অন্যতম। এসব প্রজাতির বাঁশের কাণ্ড পুরু ও কাষ্ঠল বলে ঘরের বেড়া ও খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া পাকা বাড়ি তৈরির সময় ছাদ ঢালাই দিতেও এসব বাঁশের প্রয়োজন হয়।

সিলেট অঞ্চলে বেশি দেখা যায় তল্লা, মাকলা ও করজবা বাঁশ। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাইজ্জা, যশোর ও খুলনা অঞ্চলে বরাক এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাওয়া যায় ভুদুম বাঁশ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ প্রায় সারা দেশেই মুলি বাঁশের দেখা মেলে। এই বাঁশ রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত কর্ণফুলী কাগজের কলের প্রধান কাঁচামাল।

২০১০ সালে চীনের বাঁশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই উদ্যান থেকে দেশি মুলি বাঁশের বীজ সংগ্রহ করে। বিনিময়ে তারা চায়না বাঁশের প্রজাতি দেয়। চীন, জাপানসহ বিশ্বের অনেক দেশের গবেষক এই উদ্যান দেখতে আসেন।

বিএফআরআইয়ের সাবেক গবেষক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ১৯৭৩ সালে যখন এই উদ্যান গড়ে তোলা হয়, তখন এশিয়া মহাদেশে কেবল জাপান ও চীনে এ ধরনের উদ্যান ছিল।

ঘটি বাঁশ দেখলে মনে হয় অনেক কলস ওপরে- নিচে জোড়া লাগানো l ছবি: প্রথম আলো

সরবরাহ হয় চারা
প্রতিবছর কয়েক হাজার চারা এই উদ্যান থেকে উত্তোলন করা হয়। বর্তমানে উদ্যানের নার্সারিতে ভুদুম, ওরা, বাইজ্জা, তেতুয়া ও চায়না বাঁশের আট হাজার চারা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাগান ও বন সৃজনে এই উদ্যানের চারা ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০০৮ সালে এই কেন্দ্র থেকে ১০ হাজার বাঁশের চারা নিয়ে মধুপুর অঞ্চলের বনে লাগানো হয়।
উদ্যানের খাড়া পথ বেয়ে ওঠা পথের দুধারে লাগানো হয়েছে শোভাবর্ধনকারী হেজ বা বেড়া বাঁশ। তার পাশেই দেখা যাবে ছোট আকৃতির চায়না বাঁশ। এই বাঁশের কচি কাণ্ড সুস্বাদু। মূলত সবজি হিসেবে ব্যবহারের কথা মাথায় রেখে চীন থেকে এই প্রজাতির বাঁশ এনে উদ্যানে লাগানো হয়েছে।
বিশাল উদ্যানে ছড়ানো বাঁশগুলোর কোনোটির কাণ্ড সরু, কোনোটির লতানো, কোনোটির রং সোনালি, কোনোটি আবার ছাতার মতো ঘন আচ্ছাদন তৈরি করেছে মাথার ওপর। ছায়া-সুনিবিড় ব্যাম্বো সেটামে বাঁশ পাতার ঝিরিঝিরি শব্দে কান পাতা দায়। একটু জোরে বাতাস বইলে শোনা যায় একটা বাঁশের সঙ্গে আরেকটা বাঁশের ঠোকাঠুকির শব্দ।

পাহাড়ের ঢালে কাঁটা বাঁশগুলো যেন নিজেদের চারদিকে বর্ম তৈরি করে রেখেছে। প্রায় ৫০ ফুট উঁচু বাঁশগুলোর প্রতি গিঁট থেকে বেরিয়েছে কাঁটাযুক্ত শাখা। বাঁশঝাড়টির গোড়া থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত এমন দুর্ভেদ্য কাঁটার বর্ম। থাইল্যান্ড থেকে সংগ্রহ করা এই বাঁশের বেশ কয়েকটি ঝাড় রয়েছে এই উদ্যানে।

বাগানের একটা জায়গায় এসে বাঁশের শিকড়ে ছাওয়া মাটি দেখিয়েছিলেন মাঠকর্মী মোনায়েম ভূঁইয়া। তিনি বলেন, কার্পেটের মতো শিকড় মাটি আঁকড়ে ধরে থাকে। একইভাবে বাঁশ পাহাড় ধরে রাখে। আর বাঁশ নেই বলেই পাহাড়ধস হচ্ছে।

উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা বলেন, বাঁশ দ্রুত বর্ধনশীল। চারা লাগানোর পর একটি বাঁশঝাড় পাঁচ বছরেই পূর্ণাঙ্গ ঝাড়ে পরিণত হয়। পাঁচ বছর পর একটি ঝাড় থেকে বছরে পাঁচটি বাঁশ কাটা যায়। এরপরের বছর থেকে আরও একটি করে বেশি বাঁশ পাওয়া যায় বাঁশঝাড়ে। একমাত্র মুলি বাঁশই ঝাড় ছাড়া জন্মায়।

সংরক্ষণাগারের চেয়ে বেশি কিছু

িলভি কালচার জেনেটিকস বিভাগের প্রধান মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, পরজাতি সংরক্ষণের পশাপাশি বাঁশঝাড় ব্যবস্থাপনা, চারা উৎপাদন, বীজ সংরক্ষণ ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবেও কাজ করছে এই উদ্যান। এখানে বাঁশের জিনবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এই উদ্যান ঘিরে চারা উত্তোলনের টিস্যু কালচার সেন্টার ও নার্সারিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ পর্যন্ত তিন প্রজাতির বাঁশের টিস্যু কালচারের মাধ্যমে চারা উত্তোলন করা গেছে। কঞ্চি কলম পদ্ধতিতে বাকি প্রজাতিগুলোর চারা তৈরি হচ্ছে।

উদ্যানের পাশেই বাঁশ গবেষণাগার। সেখানে হরেক প্রজাতির বাঁশের বীজের দেখা মিলবে। এর কোনোটি গমের মতো, কোনোটির চেহারা পেঁয়াজের মতো। ২৫ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে বাঁশে ফল ধরে ও বীজ আসে। বাঁশের বংশবৃদ্ধিতে এখন কলম ও টিস্যু কালচার পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিবছর কয়েক হাজার চারা এই কেন্দ্র থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণও করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল গফুর বলেন, দেশি জাতের বাঁশের জিনবৈচিত্র্য এখানে সংরক্ষিত হচ্ছে। এর মধ্যে ভুদুম, মুলি ও বাইজ্জার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক। এসব প্রজাতির বাঁশের জিনবৈচিত্র্য বিশ্বের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।