
বাড়ির সামনে তখনো শোভা পাচ্ছিল বিয়ের সুসজ্জিত গেট। বাড়ির ভেতরে অতিথিদের জন্য টাঙানো শামিয়ানাও সরানো হয়নি। সেই শামিয়ানার নিচে বসে কোস্টগার্ডের সদস্যদের কাছে ট্রলারডুবির বর্ণনা দিচ্ছিলেন প্রাণে বেঁচে যাওয়া মো. ইব্রাহিম সওদাগর।
ট্রলারডুবিতে মা ও নববিবাহিত মেয়েকে হারিয়ে বিহ্বল ইব্রাহিমের গলা আটকে যাচ্ছিল বারবার। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, তখন নদীতে ভরা জোয়ার। হঠাৎ স্রোতের তোড়ে উল্টে যায় ট্রলার। সেটি ভেসে লক্ষ্মীপুরের রামগতির টাংকিরঘাটের কাছে চলে যায়। সেখানে জেলেদের সহায়তায় ট্রলারের কেবিন থেকে মেয়েসহ পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
আজ বুধবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার নলের চরের উত্তর আজিমনগর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা হয়। তখন পাশের ঘরে চলছিল আহাজারি। একটি ঘরে অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে ছিলেন বর ফরিদ উদ্দিন।
ইব্রাহিম জানান, এক মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। মেয়েটিই ছিল সবার বড়। একমাত্র মেয়ে হওয়ায় ঢাল চরে বসবাসকারী বোনের ছেলে ফরিদ উদ্দিন ওরফে শরীফের সঙ্গে তাঁর বিয়ে ঠিক করেন। সোমবার বিয়ে হয়। মঙ্গলবার বেলা একটার দিকে চানন্দিঘাট থেকে ঢাল চরের উদ্দেশে বরযাত্রীরা রওনা দেন। ট্রলারটি চেয়ারম্যান ঘাটের দক্ষিণ-পশ্চিমে মেঘনায় ডুবে যায়।
ট্রলারটিতে ঠিক কতজন যাত্রী ছিল, তাঁরা এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি বলে জানান ইব্রাহিম সওদাগর। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত সাতজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। অন্য দুটি লাশ পাওয়া যায় হাতিয়ার চানন্দি ঘাটে। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখনো আটজন নিখোঁজ। বিষয়টি কোস্টগার্ড ও প্রশাসনের লোকজনকে জানানো হয়েছে।
নিখোঁজ আটজনের মধ্যে একই পরিবারের চারজন। তাঁরা হলেন হাতিয়ার আল-আমিন গ্রামের নাছির উদ্দিনের স্ত্রী জাকিয়া খাতুন (৫৫), তাঁদের ছেলেপক্ষের নাতি মো. হাসান (৫) ও নাতনি নুর নাহার (৩) এবং মেয়েপক্ষের নাতনি হালিমা খাতুন (৪)। অন্য চারজন হলো পূর্ব আজিমনগরের রিয়াজ উদ্দিনের মেয়ে নিহা আক্তার (১), বয়ার চরের মো. ইলিয়াছের ছেলে আমির হোসেন (দেড় বছর) এবং ভোলার মনপুরার মহিউদ্দিনের মেয়ে নামিয়া আক্তার (৩) ও আবদুর রহিমের ছেলে মো. আলিফ (২)।
বেলা দেড়টার দিকে আল-আমিন গ্রামের নাছির উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের ভেতরে স্বজনদের আহাজারি চলছে।
ট্রলারডুবিতে বেঁচে যাওয়া নাছিরের জামাতা নাজিম উদ্দিন বলেন, তিনি ডুবে যাওয়া ট্রলারের একটি অংশ ধরে আরও লোকজনের সঙ্গে প্রায় ২০ মিনিট ভেসে ছিলেন। এরপর মাছ ধরা ট্রলার গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে।
এ পর্যন্ত উদ্ধার করা সাতটি লাশ নববধূ তাছলিমা, তাঁর ফুফাতো বোন মোহম্মদপুর গ্রামের আক্তার হোসেনের মেয়ে আসমা বেগম (১৯), পূর্ব আজিম নগর গ্রামের বাসিন্দা ও তাছলিমার দাদি নুরজাহান (৬৫), একই এলাকার আলা উদ্দিনের স্ত্রী রাহেনা বেগম (৩০), নলের চরের কালাদুর গ্রামের ফয়জ্জুল্লার মেয়ে হোসনে আরা বেগম (৫) এবং সদর উপজেলার বদরিপুর গ্রামের আকবর হোসেনের মেয়ে আফরিনা আক্তার ওরফে লামিয়া (৯) ও আলমগীর হোসেনের মেয়ে লিলি আক্তারের (৮)।
আজ সন্ধ্যায় হাতিয়া নৌ পুলিশের পরিদর্শক মো. একরাম উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নববধূসহ সাতজনের লাশ উদ্ধার করা হলেও এখনো আটজন নিখোঁজ। তাঁদের উদ্ধারে নৌ পুলিশের পাশাপাশি কোস্টগার্ডের সদস্যরা কাজ করছেন। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত আর কারও লাশ পাওয়া যায়নি।