
‘মজা পুকুরে বদ্ধ জল হিসেবে পড়ে আছি, যদি সেই সজল বরষা আসে, তবে সেই বরষার জলে সংস্কার হতে পারব’, কথাগুলো বলছিলেন প্রবীণ ফকির নহির শাহ। লালনের মরমি বাণী, ‘রাখিলেন সাঁই কূপজল করে আন্ধেলা পুকুরে, কবে হবে সজল বরষা চেয়ে আছি সেই ভরসা’র মর্ম কথা বোঝাতে তিনি কথাগুলো বলেন। বহু বছর ধরে তিনি ভক্ত–অনুসারীদের নিয়ে ছেঁউড়িয়ায় লালন আখড়াবাড়িতে আসেন।
নহির শাহ যুক্ত করলেন, সাঁইজি গুরু জ্ঞানের অপেক্ষায় ছিলেন। আত্মা–সংস্কারের সৎ উপায় খুঁজছিলেন। তিনি মনে করেন, ‘সাঁইজি সর্বস্তরে সংস্কারের বাসনা করতেন। সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত শুদ্ধ মানুষ না, শুদ্ধ সমাজ না, শুদ্ধ রাষ্ট্র না। আত্ম–সংস্কার আমাদের প্রত্যেকের দরকার।’
আজ শুক্রবার বিকেল থেকে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়ায় শুরু হয়েছে ফকির লালন শাহর তিরোধান দিবসের তিন দিনের অনুষ্ঠান। সাধু-ফকিরেরা সেখানে অষ্টপ্রহর কাটাবেন। করবেন আত্মজিজ্ঞাসা, লালন শাহর অমর গান।
সাধু-ফকিরেরা জানালেন, এই অষ্টপ্রহরে তাঁরা গুরুকার্য করবেন। রাখালসেবা, অধিবাস, বাল্যসেবা ও শনিবার দুপুরে পুনঃসেবার মধ্যে তাঁদের সাধুসঙ্গ শেষ হবে। তাঁরা গানে গানে লালন শাহকে স্মরণ করবেন। রাতে তাঁরা একতারা বাজিয়ে গান করেন।
দুই দিন ধরে আখড়াবাড়িতে আসতে থাকেন সাধু-ফকির ভক্তরা। শুক্রবার আখড়াবাড়ি চত্বর কানায় কানায় ভরে যায়। দর্শনার্থীদের ভিড়ে সেখানে তিলধারণের ঠাঁই নেই।
মূল মঞ্চের আয়োজন
কালী নদীর পাড়ে মাঠের মূলমঞ্চে আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। রাষ্ট্রীয় কাজে আটকে পড়ায় না আসতে পেরে তিনি ঢাকা থেকে ভিডিও বার্তায় দুঃখ প্রকাশ করেন। সেখানে স্বাগত বক্তব্য দেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক রেজাউদ্দিন স্টালিন। বক্তব্য দেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মফিদুর রহমান।
‘রাখিলেন সাঁই কূপজল করে আন্ধেলা পুকুরে, কবে হবে সজল বরষা চেয়ে আছি সেই ভরসা’ প্রতিপাদ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এ আয়োজনে মুখ্য আলোচক ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান লেখক ও গবেষক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। তিনি বলেন, ‘আমি কথা বলি, গানও করি। কিন্তু করোনা আমার কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। আমি আঞ্চলিকতার টানে এখানে ছুটে এসেছি। লালন নিয়ে অবশ্যই গবেষণা হবে, ছোটরা গান শিখবে।’
লালনের বাণীর মধ্যে সারা বিশ্বের তথ্যের সংযোগের কথা তুলে ধরেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। লালনের কয়েকটি গান বাজিয়ে তা ব্যাখ্যা করেন। বক্তব্যের শেষে তিনি মনুষ্যত্বের জায়গা থেকে রোহিঙ্গা ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা জানান।
বিশিষ্ট কবি, লেখক ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, ‘এই ধামে সংগীতচর্চা হবে, জ্ঞানের চর্চা হবে, ভাবের চর্চা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। লালনের চর্চা অস্পষ্ট, এটাকে স্পষ্ট করে তুলতে হবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে।’ তিনি বলেন, ‘গায়ত্রী এখানে আসায় আজ থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল।’
জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীনের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য দেন মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আ–আল মামুন। আলোচনা শেষে মূল মঞ্চে সাধু-ফকিররা লালনের উদ্বোধনী গান পরিবেশন করেন। চলে রাতভর।
পরিপাটি মেলা
লালন শাহর এ আয়োজনে প্রতিবছর বেশ বড় পরিসরে মেলার আয়োজন করা হয়। জাতীয়ভাবে পালনের জন্য মেলার মাঠে পরিপাটি করে সাজানো হয়। সেখানে আধুনিক মানে ১০০ স্টল তৈরি করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। সেসব স্টলে বিভিন্ন ধরনের দোকান সাজিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
১৮৯০ সালের ১ কার্তিক ফকির লালন সাঁই কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ছেঁউড়িয়া গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। এর পর থেকে আখড়াবাড়ি চত্বরে তাঁর ভক্ত–অনুসারীরা তাঁদের সাঁইজিকে স্মরণ করে আসছেন।