
ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। বগুড়া শহরের সার্কিট হাউস সড়কের পাশে রোজাদার ছিন্নমূল মানুষের দীর্ঘ সারি। তাঁদের হাতে ইফতারির প্যাকেট আর পানি তুলে দিচ্ছেন কয়েকজন তরুণ। এভাবে রোজার দ্বিতীয় দিন থেকে শহরের ভাসমান, দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে ইফতারি বিতরণ করছে অনলাইন রক্তদান সংগঠন নামে বগুড়ার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। প্রতিদিন ১৫০ জন রোজাদারকে বিনা মূল্যে ইফতার করাচ্ছে তারা।
সার্কিট হাউস সড়ক ছাড়াও শহরের সাতমাথায় সরকারি আজিজুল হক কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সংগঠন মুনলাইট ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি মাসব্যাপী রোজাদারদের বিনা মূল্যে ইফতারি ও রাতের খাবার খাওয়াচ্ছে। এ ছাড়া সাতমাথায় প্রতিদিন দুই শতাধিক রোজাদারের কাছে এক টাকায় ইফতারি বিক্রি করছেন একদল তরুণ। লাইফ লাইন নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে তাঁরা এ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
বগুড়া শহরে গৃহকর্মীর কাজ করেন রুপালি বেগম। এক মেয়েকে নিয়ে কষ্টে চলে তাঁর সংসার। আজ মঙ্গলবার বিকেলে সার্কিট হাউস সড়কে ইফতারি বিতরণ শুরু হলে তিনি সারিতে দাঁড়ান। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন এখান থেকে ইফতারি সংগ্রহ করি। বাড়িতে গিয়ে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে খাই। বাজারে সব জিনিসের দাম চড়া। ৫০ টাকার নিচে ইফতার করা যায় না। কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ্য নেই আমার।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনলাইন রক্তদান সংগঠনের যাত্রা শুরু ২০১৬ সালে। বগুড়া সদরের চাঁনপুর গ্রামের তরুণ সোহেল রানার (২৭) হাতে সংগঠনটির জন্ম। বগুড়ার সড়ক ও জনপথ বিভাগে (সওজ) খণ্ডকালীন নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে চাকরি করছেন তিনি। পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী নানা কাজে যুক্ত আছেন।
সোহেল রানা বলেন, ২০১৬ সালে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর জন্য এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। দীর্ঘক্ষণ পর একজন রক্ত দেন। ওই দিনই বগুড়া অনলাইন রক্তদান সংগঠন নামে ফেসবুকে একটি পেজ খোলেন। অল্প দিনে সংগঠনটির পরিধি বেড়ে যায়। তাঁর দাবি, সংগঠনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ৮ হাজারের বেশি মানুষকে রক্তদান করা হয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, রক্তদানের পাশাপাশি তাঁরা প্রতি শুক্রবার শহরের ১৫০ জন ছিন্নমূল মানুষকে দুপুরের খাবার খাওয়ানো শুরু করেন। এ উদ্যোগের নাম দেওয়া হয় ‘বগুড়া অনলাইন ফুড ব্যাংকিং’। রোজা শুরুর পর তাঁরা ইফতারসামগ্রী বিতরণ শুরু করেন। ফেসবুকে উদ্যোগের কথা জানানোর পর অনেকে তাঁদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। তাঁরা একটি প্যাকেটে ৫০ টাকার ইফতারসামগ্রী দিচ্ছেন। ইফতারির মধ্যে আছে খিচুড়ি, শসা, ডিম, খেজুর ও বোতলজাত পানি। ঈদের পর তাঁদের দুপুরের খাবার বিতরণ আবার শুরু করা হবে।
মুনলাইন ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি নামে সরকারি আজিজুল হক কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন পবিত্র রমজান মাসজুড়ে ৫০ জন ছিন্নমূল মানুষকে ইফতারি ও রাতের খাবার দিচ্ছে। ইফতারসামগ্রীর মধ্যে আছে ছোলা, বুন্দিয়া, জিলাপি, বেগুনি, পেঁয়াজু ও খিচুড়ি বা ভাত। প্রতিদিন ইফতারের আগেই সাতমাথায় ৫০ জন রোজাদারের হাতে ইফতারি ও খাবারের প্যাকেট তুলে দেওয়া হয়।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আরিফ রেহমান বলেন, দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা কলেজের এইচএসসির একটি ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা সংগঠনটি গড়ে তোলেন। মুনলাইন ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি নামে ২০০০ সাল থেকে তাঁরা ছিন্নমূল, পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সহায়তা করেন। খাবার বিতরণ, প্রতিবন্ধী শিশুদের বিদ্যালয় পরিচালনা, বৃত্তি কার্যক্রম, ত্রাণ বিতরণ, শীতার্তদের মধ্যে কম্বল বিতরণসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করেন তাঁরা। এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁরা ইতিমধ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে গত বছর দেশসেরা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পুরস্কার পেয়েছেন।
শহরের সাতমাথায় মাসজুড়ে এক টাকার বিনিময়ে ইফতারসামগ্রী বিক্রি করছেন একদল তরুণ। ‘আর্তমানবতায় সমাজ গড়ি, দানে নয় নিজের টাকায় ইফতার করি’ স্লোগানে তরুণদের ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগের নাম দেওয়া হয়েছে ‘লাইফ লাইন’। প্রতিদিন ইফতারের আগে মুসাফির, রিকশাচালক ও শ্রমজীবী মানুষ এখান থেকে এক টাকায় ইফতারি সংগ্রহ করছেন।
উদ্যোক্তারা জানান, নিম্ন আয়ের মানুষের কথা ভেবে বিভিন্ন পেশার ১২ জন সদস্য মিলে মাসজুড়ে ১ টাকায় ইফতারসামগ্রী বিক্রি করছেন। একজন রোজাদারের জন্য ৫০ থেকে ৬০ টাকা খরচ হয়। যাতে কেউ দান না ভাবেন, এ জন্য প্রতীকী অর্থে এক টাকা নেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন গরু, মুরগি, খাসির মাংসের বিরিয়ানির সঙ্গে খেজুর ও সালাদ দেওয়া হয়।
উদ্যোক্তা ১২ জনের মধ্যে বেশির ভাগই তরুণ ও ব্যবসায়ী। একজন ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রীও আছেন। আলোকচিত্রী আহসান হাবিব বলেন, রোজায় খেটে খাওয়া মানুষের কথা মাথায় রেখে এক টাকায় ইফতারি বিক্রির উদ্যোগ নেন তাঁরা।
রিকশাচালক তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘এক টাকা এখন অচল। এক টাকায় বাজারে কিছুই পাওয়া যায় না। এক টাকায় ইফতারি কিনতে পেরে মনে হচ্ছে, এখনো এক টাকার দাম আছে।’ ভিক্ষুক স্বপ্না বেওয়া বলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কাছে হাত পাততে হয়। ইফতারি ভিক্ষা করতে সংকোচ হয়। কেনার সামর্থ্যও নেই। এক টাকায় প্রতিদিন ইফতার করতে পারছি।’