সকালে জলের বুকে একের পর এক জাল ফেলছিলেন পেশাদার ও শৌখিন মাছশিকারিরা। কিন্তু জাল শূন্য, মাছ নেই। তবে দুপুরের পর পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে যায়। কারও জালে এক-দুইটা করে মাছ উঠতে থাকে। কারও জালে ধরা পড়ে রুপালি মাছের ঝাঁক।
মৌলভীবাজারে মনু নদে প্রতিবছর কার্তিক মাসের কোনো এক সময় ‘লাছো বা বাটা’ মাছের ‘বারকি’ ওঠে। স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি ‘বাইরকা’ নামেই পরিচিত। তিন-চার দিন বা তার চেয়ে দু-এক দিন বেশি সময় ধরে এই মাছ ধরা পড়ে। তখন পেশাদার ও শৌখিন মাছশিকারিরা জলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
এই ‘বাইরকা’ বা ‘বারকি’ নিয়ে প্রচলিত আছে লোককথা। উপস্থিত মাছশিকারিসহ স্থানীয় কয়েকজন জানান, বাইরকা হচ্ছে একটা ‘কুত’ (রহস্যময় কিছু)। অনেকের মতে, গাছের খাঁড়ি বা টুকরার মতো দেখতে এই ‘কুত’ অনুসরণ করে মনু নদে লাছো মাছের ঝাঁক কার্তিক মাসে উজানের দিকে ছুটতে থাকে। তখন বিভিন্ন স্থানে পেশাদার ও শৌখিন শিকারির জালে এই মাছ ধরা পড়ে।
কয়েক দিন ধরে মৌলভীবাজার শহরতলির মাতারকাপনের মনু নদের মনু ব্যারাজ এলাকায় চলছে এই লাছো মাছ ধরার উৎসব। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নানা রকম জাল দিয়ে চলছে মাছ ধরা। মনু নদের টাটকা মাছ কিনতে আসেন অনেকে। অনেকে মাছ ধরা দেখতেই ভিড় করেন স্থানটিতে।
স্থানীয় লোকজন জানান, চার-পাঁচ দিন ধরে মনু নদের ব্যারাজ এলাকাতে ধরা পড়ছে এই লাছো মাছ। কোনো কোনো দিন জালে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ উঠছে। কখনো দু-চারটা করে ধরা পড়ছে। যাঁরা মাছ ধরতে আসেন, সবাই জানেন ‘বাইরকা’র মাছ এ রকমই। তারা ঝাঁকে চলে, ঝাঁকেই ধরা পড়ে।
গত শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে মনু ব্যারাজে গিয়ে দেখা গেল, ব্যারাজের পশ্চিম পাশে মনু নদের দুই পাড়ের দিকে উড়াল বা ঝাঁপি জাল ফেলছেন অনেকে। একের পর এক জাল ফেলেই চলেছেন, কিন্তু মাছের দেখা নেই। হঠাৎ কোনো কোনো খেপে দু-চারটা করে ধরা পড়ছে। এতে কেউ কেউ কিছুটা হতাশ। সবাই স্থানীয় নন। মাছ ধরা পড়ার খবর শুনে বিভিন্ন স্থান থেকে কেউ মোটরসাইকেলে করে, কেউ সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে এসেছেন।
অনেকে বলেন, হঠাৎ মনু নদে পানি বেড়ে গেছে। যে কারণে মাছ কম ধরা পড়ছে। মনু নদে পানি কম থাকলে এই মাছ বেশি ধরা পড়ে। আকাশে মেঘের আনাগোনা বেড়ে গেলে, বৃষ্টি হলে লাছো মাছের উপস্থিতি কমে যায়। মাছ কম ধরা পড়লেও পেশাদার মাছশিকারি ও শৌখিন শিকারিদের উৎসাহে খুব একটা ভাটা নেই। তাঁদের কেউ কেউ নৌকা নিয়ে এদিক-ওদিক স্থান বদল করছেন। যাঁরা জাল বাইছেন, তাঁরাও মাছের খোঁজে স্থান বদল করছেন।
তবে দুপুর থেকে পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে শুরু করে। ঝকঝকে রোদ উঠেছে। জালে মাছের পরিমাণ বাড়তে থাকে। বিকেলে গিয়ে দেখা গেল, একের পর এক লোকজন সার ধরে উড়াল জাল ফেলছেন। যাঁরা নৌকা দিয়ে মাছ ধরছেন, তাঁরা কিছু নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে খেপ মারছেন। তাতে একসঙ্গে অনেক মাছ ধরা পড়ছে। প্রতি খেপে ৮ থেকে ১০ কেজি বা তারও বেশি মাছ ধরা পড়েছে। নৌকার পাটাতনে রাখা রুপালি মাছগুলো ঝিলমিল করে লাফিয়ে উঠছে।
এখানে দল বেঁধে মাছ ধরছিলেন রাজনগর উপজেলার প্রেমনগরের রেকাত মিয়া। তাঁরা ১৫ থেকে ১৬ জনের একটা দল একসঙ্গে মাছ ধরছেন, সেই মাছ বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, ‘পানি কমলে মাছ মরে। আজকে (শুক্রবার) পানি বাড়ছে। সারা দিন কুন (কখন) সময় মাছ মরে, তার লাগি অপেক্ষা করা লাগে। দুই-তিন দিন আগে বেশি মাছ মরছে। শুধু জাল দিয়া নায়, বালুর মাঝে পাওদি উরিয়া মাইনসে মাছ মারছে (বালুর মধ্যে পা দিয়ে চাপা দিয়ে মানুষ মাছ ধরেছে)। মনু নদীত (নদে) কার্তিক মাসে একবার এই মাছ মরে।’
রেকাত মিয়া জানান, তাঁরা সবাই মিলে যে মাছ পান, দিন শেষে বিক্রির টাকা সবাই সমানভাবে ভাগ করে নেন। সব দিন সমান হয় না, কোনো দিন বেশি, কোনো দিন কম। ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা একজনের ভাগে পড়ে।