খেতে সেচ দিতে নালা থেকে পাইপের মাধ্যমে নেওয়া হয় পানি। ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর চৌচাল এলাকায়
খেতে সেচ দিতে নালা থেকে পাইপের মাধ্যমে নেওয়া হয় পানি। ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর চৌচাল এলাকায়

নালার পানিতে শাকসবজির চাষ, কী খাচ্ছে নগরবাসী

নালার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কলকারাখানার বর্জ্যমিশ্রিত নোংরা পানির দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগছিল। সেই নালা থেকে পাম্পের মাধ্যমে পানি তুলছিলেন শমসুল আলম। পানি এসে জমা হচ্ছিল ছোট একটা জলাধারে। সেখান থেকে নিয়ে ষাটোর্ধ্ব এই কৃষক তা ছিটাচ্ছিলেন টমেটোর চারা, লালশাকের খেতে।

৬ জানুয়ারি দুপুরে পতেঙ্গার আউটার রিং রোড লাগোয়া দক্ষিণ হালিশহরের নারকেলতলায় গিয়ে শমসুল আলমের সঙ্গে কথা হয়। এবারের রবি মৌসুমে ছয় কানি জমিতে তিনি শীতকালীন সবজি, বরই, পেয়ারা, ও লালশাক চাষ করছেন। সেচে ব্যবহার করছেন জমির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নালার ময়লা পানি। কেননা, আশপাশে কোনো গভীর নলকূপ কিংবা পুকুর নেই। একটা গভীর নলকূপ বসাবেন, এমন সামর্থ্যও নেই শমসুল আলমের।

শমসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, গভীর নলকূপ স্থাপন করতে কয়েক লাখ টাকা খরচ হবে; কিন্তু এত টাকা তাঁর নেই। বাধ্য হয়ে তিনি নালার ময়লা পানি ব্যবহার করছেন। এ পানি ব্যবহার করলে ক্ষতি কী, তা তিনি জানেন না।

পতেঙ্গার আশপাশে একাধিক কলকারখানা রয়েছে। এসব কারখানার ভারী পদার্থ অপরিশোধিত অবস্থায় নালা-নর্দমায় যাচ্ছে। আর নালা থেকে পানি নিয়ে ফসলের উৎপাদন করছেন কৃষকেরা। ফলে শাকসবজিতে এসব ভারী পদার্থ থাকবে। সবজির মাধ্যমে মানবদেহে এসব পদার্থ ঢুকে গেলে লিভার, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। —
সুশান্ত বড়ুয়া, জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ

শুধু এই কৃষক নন, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের তিন শতাধিক কৃষক চাষবাসে নালা-নর্দমার পানি ব্যবহার করছেন। সিটি করপোরেশনের দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের চৌচালা, আনন্দবাজার, নারকেলতলা, আকমল আলী সড়কসহ বিভিন্ন এলাকায় এই কৃষকদের বসবাস। সরেজমিনে ঘুরে ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ সংখ্যা পাওয়া গেছে।

স্থানীয় ২০ কৃষকের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা জানিয়েছেন, পানির বিকল্প উৎস না থাকায় তাঁরা বাধ্য হয়ে নালা-নর্দমার পানি ব্যবহার করছেন। সেচের পানির সংকটে তাঁরা দিশাহারা। বর্ষা ছাড়া বাকি সময় এই নালার পানিই ভরসা তাঁদের।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, পতেঙ্গায় ৯৪৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়। এর মধ্যে চাষাবাদে নালার পানি ব্যবহার হয় প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে, বাকি জমিতে গভীর নলকূপ ও পুকুরের পানি ব্যবহার করা হয়। পতেঙ্গায় মোট কৃষক আছেন ১ হাজার ২০০ জন। গত চার বছরে পতেঙ্গায় ৮৭ হাজার ৩১১ টন শীতকালীন সবজি ও ফসল উৎপাদিত হয়েছে। এবারের রবি মৌসুমে শীতকালীন সবজির লক্ষ্যমাত্রা ৭ হাজার ২০০ মেট্রিক টন।

চট্টগ্রামের কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার অন্যতম উপাদান হলো, পানযোগ্য পানি সেচকাজে ব্যবহার করা। ময়লা-আবর্জনা, আর্সেনিকযুক্ত পানি চাষের কাজে ব্যবহারের সুযোগ নেই। কিন্তু পতেঙ্গার বিশাল এলাকাজুড়ে এই আদর্শ মানা হয় না। এ ক্ষেত্রে কৃষকের পাশাপাশি সরকারি দপ্তরের গাফিলতিই দায়ী।

নগরের পতেঙ্গা থেকে সাগরিকা পর্যন্ত সমুদ্রপাড়ে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ আউটার রিং সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এই সড়কের এক পাশে বিভিন্ন কলকারখানা রয়েছে। এমনকি সড়ক হওয়ার পরও কিছু কিছু কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। সড়কের এক পাশে চট্টগ্রাম ওয়াসা পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পের বিভিন্ন প্ল্যান্ট নির্মাণ করছে। ফলে কলকারখানার বর্জ্যমিশ্রিত পানি গিয়ে মিশছে স্থানীয় নালা-নর্দমায়। এসব পানিই ব্যবহৃত হচ্ছে সেচের কাজে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয় কৃষকদের চাষাবাদে নানা পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেয়। কার্যালয়ের উপপরিচালক আবদুচ ছোবহান নালার পানি ব্যবহারের বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, নালার পানিতে এভাবে চাষাবাদ করলে নিরাপদ শাকসবজি পাওয়া যাবে না। এটি নিরাপদ প্রক্রিয়া নয়। আর পানি জোগান দেওয়ার দায়িত্ব বিএডিসির। সংস্থাটির সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। তাদের সেখানে সেচের পানির ব্যবস্থা করা উচিত। এতে অনেক কৃষক লাভবান হবেন। মানুষও নিরাপদ শাকসবজি কিনতে পারবেন।

সবই চলে নালার পানিতে

চৌচালা এলাকার মোহাম্মদ জাহিদ আট কানি জমি বর্গা নিয়ে টমেটোর চাষ করেছেন। ৬ জানুয়ারি বেলা ১১টায় যখন কথা হচ্ছিল, তখন তাঁর দম ফেলার ফুরসত ছিল না। নালা থেকে পানি এনে টমেটোর চারার ওপর পানি ছিটাচ্ছিলেন তিনি। এক ফাঁকে এ প্রতিবেদকের কাছে পানিসংকটে বিপর্যস্ত হওয়ার তথ্য তুলে ধরেন। বলেন, সমুদ্রের কাছাকাছি হওয়ায় পতেঙ্গার বাসিন্দারা লোনাপানির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করছেন। চট্টগ্রাম ওয়াসা খাওয়ার পানি দিতে পারে না। আবার কৃষিসম্পর্কিত সরকারি সংস্থাগুলো সেচের ব্যবস্থা করতে পারেনি। তাই চাষাবাদে নালার পানি ব্যবহার করতে হয়। আর পানের জন্য কিনতে হয়।

জাহিদের খেতের এক পাশে নালা। মোটর দিয়ে সেখান থেকে পানি তুলে পাইপের মাধ্যমে ছিটিয়ে দেওয়া হয় খেতের আলে। চাষাবাদ ও শাকসবজির ধোয়ামোছা সবই চলে নালার পানিতে। নালার আশপাশের জমিতে চাষ হচ্ছে ফুলকপি, বেগুন, শালগম, লালশাক, মিষ্টিকুমড়াসহ নানা শীতকালীন সবজি।

৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের মুনির নগর এলাকার কৃষক মো. আজিজুল হক (৪০) পাঁচ কানি জমি বর্গা নিয়ে ফুলকপি, শালগম, টমেটো, লালশাকের চাষ করছেন। এবারের রবি মৌসুমে প্রায় তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন তিনি। ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা আয় করার আশায় আছেন। সেচের পানি কোথায় পান, এমন প্রশ্নে আজিজুল পাশের একটা নালার দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখান। বলেন, ওই নালায় মোটর বসিয়ে পাইপের মাধ্যমে পানি টেনে আনা হয়। তারপর খেতে খেতে এসব পানি পৌঁছে যায়।

নালার পানি কেন ব্যবহার করেন, তা জানতে চাইলে আজিজুল বলেন, এলাকায় আবাদি জমির আশপাশে গভীর নলকূপ নেই। জলাধারও নেই। এ কারণে নালার পানিই ভরসা।

একই এলাকার আরেক কৃষক জসিম উদ্দিন জানালেন, কিছুদিন আগে কৃষকেরা নিজেদের অর্থায়নে দুটি গভীর নলকূপ বসানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গভীর নলকূপ বসেনি। খরচের চিন্তা করে কেউ নিজ উদ্যোগে নলকূপ বসাননি।

বছরের ১৫ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত রবি মৌসুম। এ মৌসুমে সাধারণত বোরো ধান, শীতকালীন সবজি, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন তেল ও ডালজাতীয় ফসলের উৎপাদন হয়। পতেঙ্গার আনন্দবাজার, চৌচালা, বেড়িবাঁধ, বাকের আলী ফকিরের টেক, আকমল আলী সড়ক,নারকেলতলা, আবদুল গফুর সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, মৌসুমের এই মাঝামাঝি সময়ে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, শিমসহ নানা শীতকালীন সবজি বিক্রির ধুম চলছে। এসব শাকসবজি চট্টগ্রাম নগরের সবচেয়ে বড় পাইকারি মোকাম রেয়াজউদ্দিন বাজার থেকে শুরু করে বহদ্দারহাট, চকবাজার, আগ্রাবাদ, ২ নম্বর গেটের বাজারে পৌঁছে যায়। কয়েক শ পাইকারি ও খুচরা সবজি বিক্রেতা এসব কিনে নিয়ে বিক্রি করেন।

কথা হয় খুচরা বিক্রেতা মোহাম্মদ সুজনের সঙ্গে। তিনি জানান, নগরের আগ্রাবাদে সবজি বিক্রি করেন তিনি। সপ্তাহে দুইবার পতেঙ্গার বিভিন্ন খেত ঘুরে সবজি কেনেন। শহরের ভেতরে হওয়ার কারণে পরিবহন খরচ কম লাগে। আর সতেজ সবজি পাওয়া যায়।

এত বছরে বসেনি একটিও নলকূপ

সেচ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হলো বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি)। কিন্তু সংস্থাটি এখন পর্যন্ত পতেঙ্গায় কোনো সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেনি। এমনকি পানির সংকট দূর করতে সেখানে কোনো প্রকল্প প্রয়োজন কি না, তা–ও কখনো খতিয়ে দেখেনি সংস্থাটি। অথচ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা কয়েক বার বিএডিসিকে পানিসংকটের বিষয়টি জানিয়েছেন, কিন্তু কাজ হয়নি।

জানতে চাইলে বিএডিসি চট্টগ্রামের সেচ বিভাগের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পতেঙ্গায় এত দিনে কোনো গভীর নলকূপ বসেনি। কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ওখানে যে নালার পানি দিয়ে চাষাবাদ হয়, তা এত দিন তিনি জানতেন না। এখন বিষয়টি জানার পর তিনি প্রকৌশলী পাঠিয়ে সমাধানের চেষ্টা করবেন। কেননা, কৃষককে সেচসুবিধার আওতায় আনার দায়িত্ব বিএডিসির।

নালার পানিতে চাষাবাদে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্যসচিব জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ সুশান্ত বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পতেঙ্গার আশপাশে একাধিক কলকারখানা রয়েছে। এসব কারখানার ভারী পদার্থ অপরিশোধিত অবস্থায় নালা-নর্দমায় যাচ্ছে। আর নালা থেকে পানি নিয়ে ফসলের উৎপাদন করছেন কৃষকেরা। ফলে শাকসবজিতে এসব ভারী পদার্থ থাকবে। সবজির মাধ্যমে মানবদেহে এসব পদার্থ ঢুকে গেলে লিভার, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সুশান্ত বড়ুয়া বলেন, নালার পানি যাতে ব্যবহার করতে না হয়, তা নিয়ে সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। বিশুদ্ধ পানিতেই চাষাবাদ করতে হবে।