
‘ও পলাশ, ও শিমুল/ কেন এ মন মোর রাঙালে/ জানি না, জানি না/ আমার এ ঘুম কেন ভাঙালে…’ আগুনরাঙা ফাগুন এলেই মনে পড়ে লতা মঙ্গেশকরের এই কালজয়ী গান। বাংলার বসন্ত মানেই পলাশ। আর পলাশ মানেই পর্ণমোচী (ফুল-ফল পাকলে ঝরে যায়) বৃক্ষের লাল আভা।
সবুজের ভিড়ে পলাশ ফুল দেখে মনে হতে পারে থোকা থোকা আগুনের শিখা। পলাশ যেন বসন্তের ফাগুন-প্রকৃতির মন রাঙানোর দায় নিয়েছে।
মৌলভীবাজার শহর থেকে মাত্র দেড়-দুই কিলোমিটারের পথ। দক্ষিণে বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক। শহরের কাছে নির্জন ও প্রকৃতির বুনো ঘ্রাণমাখা জায়গা। ইকোপার্কে ঢুকলে বুনো মগ্নতার স্বাদ পাওয়া যায়। ইকোপার্কের এক পাশে শালবন। আলগা মাধুর্য নিয়ে আকাশে মাথা তুলেছে শালবীথি। শালের মরচে রঙের গোলগাল শরীর ও চুলখোলা মাথা বলে দেয়, ভিড়ের মধ্যেও তারা আলাদা।
ঝোপের মধ্যে বারো মাস এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে শালগুলো। পাশ দিয়ে চলে গেছে কমলগঞ্জের কালেঙ্গা ও দেওরাছড়া চা-বাগানের দিকে পাকা সড়ক। বর্ষিজোড়া ইকোপার্কের প্রবেশপথ পার হলেই বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়।
সম্প্রতি মৌলভীবাজার-কালেঙ্গা সড়ক থেকে কার্যালয়ের উঁচু টিলার দিকে উঠতে গিয়ে নাগকেশরের সবুজ, পীত রঙের পাতাভরা গাছের ভিড়ে চোখে পড়ে কোথাও যেন আগুন লেগেছে। পরপর কয়েকটি গাছে ফুটে আছে রাঙা পলাশ। এলাকায় অনেক গাছের সমাহার। অনেক দূরে পশ্চিমে তখন সূর্য ডুবছে। তার রং লেগেছে বনের গাছে, পাতায় পাতায়। টিলার ওপর সেই রঙের ছোপ পড়েছে। একটু দূরে চারটি পলাশগাছ। সব কটি গাছে ফুল ফুটেছে। লাল, হলদে আর সোনালি আভায় পলাশ ফুল রাঙিয়ে রেখেছে পুরো অঙ্গন। মনে হতে পারে সবুজের ভিড়ে থোকা থোকা আগুনের শিখা।
ফুল হিসেবে পলাশ পরিচিত নাম হলেও মৌলভীবাজার অঞ্চলে তেমন দেখা মেলে না। বসন্তে, ফাগুনে কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে নজর কাড়ে দু-একটি পলাশগাছ। সেখানকার চারটি গাছের মধ্যে সব কটি একই আকারের নয়। কার্যালয় ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তার বাসভবনের দিকে যাওয়ার পথে রাস্তার দক্ষিণ পাশে দুটি গাছ। গাছ দুটি এখনো ছোট, কিন্তু ডালে ডালে ফুল ফুটেছে। একদম হাতের নাগালেই অনেক ফুল। তাকালে চোখ ফেরানো যায় না।
অন্য গাছ দুটি বাসভবনের কাছে। বেশ বড়। গাছ দুটির শাখা-প্রশাখাজুড়ে আগুনের শিখা উড়ছে। নিচে পড়ে আছে বেশ কিছু পলাশের পাপড়ি। পাকা সড়ক ও ঘাসের মধ্যে পাপড়িগুলো তৈরি করেছে রঙিন তৈলচিত্র। ফাগুন এলেই তারা ফোটে। চোখাচোখি হলে হেসে ওঠে ফুলগুলো।
যারা ফুলের খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের অনেকে নীরবে পলাশ ফুল দেখতে সেখানে ছুটে যান। সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘ফসল’-এর সম্পাদক প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ আব্দুল খালিক, কানাডাপ্রবাসী ফুলপ্রেমী নুরুর রহমান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মৌলভীবাজার শহরকে ফুলে ফুলে সাজিয়ে তুলতে বছরের বেশির ভাগ সময় দেশে কাটান নুরুর রহমার। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী কবি সুমন সুপান্থসহ আরও অনেকে ওই পলাশ ফুল দেখতে সেখানে ছুটে যান।
নুরুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত দুবার পলাশ ফুল দেখতে সেখানে গিয়েছি। বসন্তের এ সময়ে রাঙা পলাশ দেখে আমি অভিভূত। মৌলভীবাজারের মাটির যে বৈশিষ্ট্য, পলাশগাছ লাগিয়ে ফুলে ফুলে শহরটি সুন্দর করে সাজানো সম্ভব।’
মাঝারি আকারের একটি পর্ণমোচী বৃক্ষ পলাশ। বৈজ্ঞানিক নাম বিউটিয়া মোনোসপারমা (Butea monosperma)। গাছটি ফাবিসিয়ে (Fabaceae) পরিবারের সদস্য। তবে ফুলের জন্য সবার কাছে বেশি পরিচিত পলাশগাছ। সংস্কৃতিতে কিংশুক নামে পলাশের পরিচিতি আছে। গাছটি সর্বোচ্চ ১৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়।
শীতের সময় পলাশগাছের পাতা ঝরে যায়। বাকল দেখতে ধূসর। শাখা-প্রশাখা ও কাণ্ড আঁকাবাঁকা। নতুন পাতা রেশমের মতো সূক্ষ্ম। গাঢ় সবুজ পাতা ত্রিপত্রী, দেখতে অনেকটা মান্দারগাছের পাতার মতো। তবে আকারে বড়। বসন্তে ফুল ফোটে। টকটকে লাল ছাড়াও হলুদ ও লালচে রঙের ফুল দেখা যায়। পলাশ ফুল দুই থেকে চার সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ফল দেখতে অনেকটা শিমের মতো। বাংলাদেশের কমবেশি সব জায়গায় পলাশগাছ দেখা যায়। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া পর্যন্ত পলাশের বিস্তৃতি আছে।