‘কিছুই নাই, সমস্ত কিছু পুড়ে গেছে, সব ছারখার হয়ে গেছে’
আজ সোমবার সকাল সাড়ে ছয়টার কয়েক মিনিট আগে পৌঁছে গেলাম কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুর ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের মাঠে। তখন পুব আকাশে সবেমাত্র সূর্য লাল আভা নিয়ে উদিত হচ্ছে। গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতেই কান্নার শব্দ ভেসে এল। ‘আমার চারিদিক কী ক্ষতি হইল রে। ও আল্লাহ আমার যদি একটা বরজ ভালো থাকত মনে বুঝ দিতুক রে। আমি ছেইলিপিলি নিই কী কইরি খাব রে...।’
মেঠোপথে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন ভানু খাতুন। কথা বললে জানালেন, স্বামী হামিদুল ইসলামের সঙ্গে মিলে মাঠে তাঁদের ৩ বিঘা জমিতে পান চাষ করেছিলেন। গতকাল রোববার সেই পানের বরজে আগুন লেগে সব পুড়ে গেছে। পরিবারের একমাত্র আয় এই পান বরজ থেকে। এর ওপরেই সংসারের সব। এক ছেলে ও এক মেয়ে, তাঁদের বিয়ে হয়ে গেছে। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কেউ নেই। কারণ, ভানুর মতো ওই এলাকার প্রায় সবার মাঠের বরজ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
রাস্তা ধরে পদ্মা নদীর পাড়ের দিকে হাঁটতেই গ্রামের নারী-পুরুষ ভিড় বাড়তে থাকে। সবাই তাঁদের খেতে যাচ্ছেন। পোড়া গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। এই এলাকা গতকাল সকালেও ছিল পানপাতার সুগন্ধে ভরা। খেতে গিয়ে নিঃস্ব পরিবারগুলোর সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
কয়লার কালি হাতে খেতে পোড়া পান দেখছিলেন রেজাউল ইসলাম। তিনি বললেন, ‘কিছুই নাই, সমস্ত কিছু পুড়ে গেছে। এলাকার আর কিছুই নাই। এ বছর এই গ্রামের মানুষ কীভাবে চলবে, কেউ বলতে পারবে না। সব ছারখার হয়ে গেছে।’
চান্দেরা খাতুনের স্বামী গণি অসুস্থ। মেয়ে আছে একজন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। তিনি বললেন, ‘মেয়েকে কীভাবে পড়াব, সেই চিন্তায় দিশাহারা। ছেইলি ডিম ছাড়া ভাত খাই না। এখন তাকে কী দিয়ে খেতে দিবো।’
ষাটোর্ধ্ব মিনারুল ইসলাম বললেন, ‘দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। খড়ের আগুন লাগা ফুলকি উইড়ি উইড়ি একটা বরজ থিকি আরেক বরজে ধরছিল। অন্য আবাদ আছে কিন্তু বরজই বেশি। অন্য মানুষকে বর্গা দিই। তার কাছে ট্যাকাও নিতি পারব না। ক্ষতির হিসাব দিবার মতো নাই। মাঠের পর মাঠ শেষ।’
বরজের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছিলেন রাশিদা খাতুন। বলেন, ‘আমরা এখন ক্যান্দা করি চইলবো। পানই আমার সংসার চালায়। স্বামী ইয়ারুল ইসলাম পান চাষ করে হাটে বিক্রি করে। কী কইরবো এখন নিজেই ভাইবি পাচ্ছিনি। আমারে আর কোনো ডাল নাই যে, সেই ডাল ধইরি চইলো। সব ডাল ভাঙগিচে।’ চোখ মুছতে মুছতে তিনি বরজের ভেতরে আগুনে পোড়া ছাই মাড়িয়ে চললেন।
দেখা গেল, মাঠের পর মাঠ বরজের খেত। বাঁশের চিকন খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো পোড়া। পানগাছের লতা পুড়েছে। কোথাও কোথাও ধোঁয়াও বের হচ্ছে।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় বাহাদুর ইউনিয়নের চারটি গ্রাম রায়টা, আড়কান্দি, মাধবপুর ও গোসাইপাড়ার মাঠে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় পানের বরজ। আগুন নেভাতে কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলার ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিট কাজ করে। পানের বরজের চারপাশে খড় ও পাটকাঠির বেড়া এবং ওপরে একই ধরনের ছাউনি হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে যায়। রায়টা গ্রামের মিলন আলীর পানের বরজে সবার প্রথমে আগুন লাগে। তবে কীভাবে আগুন লাগল, সেটা কেউ বলতে পারছে না। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন।
ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আকাশ কুমার কুণ্ডু প্রথম আলোকে বলেন, ১০০ হেক্টর জমির পান পুড়ে গেছে। আরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তালিকা করে সহায়তা দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন
-
রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারচর্চার খোঁজ নিলেন লু
-
নতুন করে রিজার্ভ চুরি হয়নি: বাংলাদেশ ব্যাংক
-
‘যুদ্ধশিশু’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন মেরিনা, পিতার নাম ছাড়াই সব সুবিধা পাবেন তিনি
-
ছাত্রলীগের ওপরে কোনো সন্ত্রাস নাই, কোনো শক্তি নাই: জাজিরা ছাত্রলীগের সভাপতি
-
‘সন্তান দুনিয়াতে আসবে, দেখতে পাব কি না, জানতাম না’