
লক্ষ্মীপুরের পাঁচটি উপজেলার ৫৮টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এর মধ্যে ১৯টির নিজস্ব ভবন নেই। নিজস্ব ভবন না থাকায় নাগরিক সেবা দেওয়া হচ্ছে দোকানঘরসহ ভাড়া করা কক্ষে।
লক্ষ্মীপুরের দালাল বাজার ইউনিয়নের বাসিন্দা পারুল বেগম। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি জন্মনিবন্ধনের কাগজ তুলতে যান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কার্যালয়ে। কার্যালয় বলতে বাজারের ভেতর ছোট্ট একটি দোকানঘর। সেখানে নাগরিক সেবার জন্য উপস্থিত ছিলেন আরও ১২ থেকে ১৫ জন বাসিন্দা। ফলে দোকানঘরটির ভেতরে পর্যাপ্ত স্থান না থাকায় তপ্ত রোদের মধ্যেই দীর্ঘ সময় বাইরে অপেক্ষা করতে হয় তাঁকে।
এমন চিত্র শুধু দালাল বাজার নয়, লক্ষ্মীপুর জেলার আরও ১৮টি ইউনিয়নের চিত্রও প্রায় একই রকম। এসব ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব ভবন না থাকায় নাগরিক সেবা দেওয়া হচ্ছে দোকানঘরসহ ভাড়া করা কক্ষে। এতে সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
পারুল বেগম বলেন, ‘এত ছোট অফিস, মানুষের দাঁড়ানোর জায়গাও ঠিকমতো হয় না। সেবা নিতে রোদ-বৃষ্টিতে বাইরে অপেক্ষা করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরেই মানুষ দুর্ভোগে রয়েছেন।’
‘আমরা বহুবার নতুন ভবন নির্মাণের জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। ৪ হাজার টাকায় দোকানঘর ভাড়া নিয়ে ইউপি কার্যালয় চালাচ্ছি।’—মো. নুরুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, দালাল বাজার ইউনিয়ন পরিষদ
সরেজমিন দেখা যায়, দালাল বাজার ইউনিয়ন পরিষদের অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে থাকা দোকানঘরটিতে রয়েছে ৩টি বৈদ্যুতিক ফ্যান, ১২ থেকে ১৫টি চেয়ার, ৩টি টেবিল ও ২টি আলমারি। গত বৃহস্পতিবার সেখানে গ্রাম আদালত পরিচালনার সময় দেখা যায়, বাদী-বিবাদীসহ ১০ জন ভেতরে অবস্থান করছেন। বাইরে অপেক্ষা করছেন ২০ থেকে ২৫ জন মানুষ।
সরেজমিনে ইউপি কার্যালয়টির সামনে কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। তাঁর বলেন, অস্থায়ী কার্যালয়টিতে পর্যাপ্ত বসার জায়গা নেই, নথিপত্র রাখার নিরাপদ ব্যবস্থাও অপ্রতুল। শৌচাগার পর্যন্ত নেই কার্যালয়টিতে। এভাবেই ২০ বছর ধরে কার্যক্রম চলে আসছে।
দালালবাজার ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের ভেতরে দাঁড়ানোরও জায়গা পাওয়া যায় না। সরকারি সেবা নিতে এলে মনে হয় যেন কোনো দোকানে আসছি। শৌচাগারে যাওয়ার জরুরি প্রয়োজন হলে আশপাশের বাসাবাড়ি খোঁজ করতে হয়।’
জানতে চাইলে দালাল বাজার ইউপির চেয়ারম্যান মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বহুবার নতুন ভবন নির্মাণের জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। চার হাজার টাকায় দোকানঘর ভাড়া নিয়ে ইউপি কার্যালয় চালাচ্ছি।’
নিজস্ব কার্যালয় না থাকা ইউপিগুলো হলো—লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার হাজিরপাড়া, দক্ষিণ হামছাদী, দালাল বাজার, চর রুহিতা, বাঙ্গা খাঁ, শাকচর, টুমচর, চর রমণী মোহন; কমলনগর উপজেলার চর কালকিনি, সাহেবেরহাট, চর লরেঞ্চ, পাটারীরহাট, হাজিরহাট, তোরাবগঞ্জ; রামগতি উপজেলার চর আলগী, চর আবদুল্লাহ, চর বাদাম, বড়খেড়ী এবং রামগঞ্জ উপজেলার ভাটরা ইউনিয়ন।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, লক্ষ্মীপুরের ৫টি উপজেলার ৫৮টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এর মধ্যে ১৯টির নিজস্ব ভবন নেই। স্থানীয় সরকার বিভাগে নতুন ভবন নির্মাণের প্রস্তাব পাঠানো হলেও এখনো বরাদ্দ মেলেনি। নিজস্ব কার্যালয় না থাকা ইউপিগুলো হলো—লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার হাজিরপাড়া, দক্ষিণ হামছাদী, দালাল বাজার, চর রুহিতা, বাঙ্গা খাঁ, শাকচর, টুমচর, চর রমণী মোহন; কমলনগর উপজেলার চর কালকিনি, সাহেবেরহাট, চর লরেঞ্চ, পাটারীরহাট, হাজিরহাট, তোরাবগঞ্জ; রামগতি উপজেলার চর আলগী, চর আবদুল্লাহ, চর বাদাম, বড়খেড়ী এবং রামগঞ্জ উপজেলার ভাটরা ইউনিয়ন।
ইউপি কার্যালয়গুলোয় ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তারা কোনোরকমে ছোট কক্ষ নিয়ে চালাচ্ছেন তাঁদের কার্যক্রম। এতে জন্ম ও মৃত্যুসনদ, নাগরিকত্ব সনদ, ওয়ারিশ সনদসহ বিভিন্ন সেবা নিতে গিয়ে সেবাগ্রহীতারা ভোগান্তিতে পড়ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেবাগ্রহীতাদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চর রুহিতা ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা ইফতেখার সাকিব বলেন, ‘ডিজিটাল সেন্টারের কক্ষটি এতটাই ছোট যে আমরা নিজেরাই ঠিকমতো বসতে পারি না। ফলে সেবা নিতে আসা মানুষদের কাজও ঠিকভাবে করা যায় না।’
একই ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (সচিব) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘চেয়ারম্যানের জন্য আলাদা কোনো কক্ষ নেই ইউপি কার্যালয়ে। ডিজিটাল সেন্টারের জন্যও আলাদা কক্ষ নেই। এসব কারণে ইউনিয়নের দৈনন্দিন কার্যক্রম এবং জনগণের সেবা—দুটিই ব্যাহত হচ্ছে। মানুষ সত্যিই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।’
কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘ইউনিয়নে নিজস্ব পরিষদ ভবন না থাকায় নাগরিক সুবিধা ঠিকভাবে পাওয়া যায় না। যখন যিনি চেয়ারম্যান হন, তিনি নিজের সুবিধামতো জায়গায় অস্থায়ী অফিস বসান। এতে আরও ভোগান্তি বাড়ে ইউনিয়নবাসীর।’
তোরাবগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান মীর্জা আশ্রাফুল জামাল রাসেল বলেন, ইউপি কার্যকালয়ের স্থায়ী ভবন না থাকায় নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়। গ্রাম আদালত চালানো যায় না ঠিকভাবে। অফিসের মালামাল অরক্ষিত থাকে। ভবন না থাকায় অনেক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব ভবন না থাকায় সেবা কার্যক্রমে অসুবিধা হচ্ছে। আমরা এর তালিকা প্রস্তুত করছি। ধাপে ধাপে এসব ইউনিয়নে ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’