চায়ের দোকানটিতে প্রায়ই আসেন শহিদুল (ডানে)। তাঁর গানের কারণে চায়ের দোকানটিতে প্রায়ই লোক জড়ো হন। এতে তাঁর চায়ের বিক্রিও ভালো হয়। গতকাল গাইবান্ধা শহরের রেলগেট এলাকায়
চায়ের দোকানটিতে প্রায়ই আসেন শহিদুল (ডানে)। তাঁর গানের কারণে চায়ের দোকানটিতে প্রায়ই লোক জড়ো হন। এতে তাঁর চায়ের বিক্রিও ভালো হয়। গতকাল গাইবান্ধা শহরের রেলগেট এলাকায়

‘ভিক্কে লয়, গানের ট্যাকা দিয়া ব্যাটাটাক মানুষ করিম’

‘এই মন তোমাকে দিলাম/ এই প্রেম তোমাকে দিলাম/ তুমি চোখের আড়াল হও/ কাছে কিবা দূরে রও/ মনে রেখো আমিও ছিলাম...।’ এ গান ভেসে আসছিল গাইবান্ধা শহরের রেলগেট এলাকার একচালা একটি চায়ের দোকান থেকে।

সেখানে বিভোর হয়ে গান গাইছেন এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী যুবক। নাম শহিদুল ইসলাম (৩০)। ছড়ি হাতে হেঁটে ভিক্ষা করেন তিনি। সপ্তাহের তিন দিন জেলা শহর আর বাকি চার দিন গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে অর্থসহায়তা চান তিনি।

রেলগেট এলাকায় কার্তিকের চায়ের দোকান নামে পরিচিত ওই জায়গায় বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান গেয়ে শোনান শহিদুল। ‘এই বুকে বইছে যমুনা/ অথই প্রেমের জল’; ‘কোনো একদিন আমায় তুমি খুঁজবে/ সেই দিন ওগো প্রিয়ে আমার ভালোবাসা বুঝবে’; ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে’।

গতকাল রোববার বিকেলে শহিদুলের গান মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী মোদাছিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও তিনি (শহিদুল) প্রতিভাবান। তাঁর সুরেলা কণ্ঠে গান শুনে মুগ্ধ হলাম। তিনি প্রায়ই চায়ের দোকানটিতে আসেন। আর গানগুলো শিকড়ের গান। যা হৃদয় স্পর্শ করে।’

মোদাছিরুজ্জামানের কথায় ভাগ বসিয়ে স্থানীয় আইনজীবী শাহনেওয়াজ খান বলেন, শহিদুলের গান শুনে উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হন। সবাই তাঁকে ভালোবাসেন। অনেকে গান শুনে আর্থিক সহায়তাও করেন।

কার্তিকের চায়ের দোকানে প্রায়ই আসেন শহিদুল। তাঁর গানের কারণে চায়ের দোকানটিতে প্রায়ই লোক জড়ো হন। এতে চায়ের বিক্রিও ভালো হয় বলে জানান কার্তিক।

গানের শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শহিদুল ইসলামের কণ্ঠে যে সুর আছে, তা অনেকেই জানতেন না। একদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁর একটি গান ভাইরাল হয়। তখন থেকেই তাঁকে দেখলে অনেকেই গান শোনার আবদার করেন। কখনো চায়ের স্টলে, কখনো ফুটপাতে কিংবা গাছতলায় বসে তাঁকে সেসব আবদার মেটাতে হয়। গান শুনে খুশি হয়ে অনেকেই ১০, ৫০, ১০০ টাকা দেন। আগে প্রতিদিন ভিক্ষা করে তিনি পেতেন ২০০-৩০০ টাকা। তা দিয়ে টেনেটুনেও পাঁচজনের সংসার চালাতে পারতেন না। এখন গান গেয়ে তাঁর কিছুটা বাড়তি উপার্জন হচ্ছে। ভিক্ষার পাশাপাশি গান গেয়ে দৈনিক আয় করছেন ৫০০-৬০০ টাকা। তবে প্রতিদিন একই অবস্থা থাকে না। শ্রোতারা গান না শুনলে ভিক্ষার টাকার ওপরই তাঁকে নির্ভর করতে হয়।

শহিদুল ইসলাম গাইবান্ধা সদর উপজেলার উত্তর ঘাঘোয়া গ্রামের দিনমজুর রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে। মা সবিরন বেগম গৃহিণী। চার ভাই–বোনের মধ্যে শহিদুল দ্বিতীয়। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে, ছোট বোন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। শহিদুল জন্ম থেকেই অন্ধ; লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। তবে ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি বেশ দুর্বলতা ছিল। কিন্তু গান শেখার সুযোগ পাননি। দুই বোনের বিয়ে দিতে গিয়ে বাবা প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অভাবের সংসার, অন্ধত্ব—এসব কারণে কাজ না পেয়ে শহিদুল মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকেই ভিক্ষাবৃত্তিতে নামেন।

পরিবারের বিষয়ে শহিদুল জানান, ২০২০ সালের শেষ দিকে তিনি এক নারীকে বিয়ে করেছিলেন। কয়েক মাস পর তাঁকে ফেলে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চলে যান স্ত্রী। পরে একটি ছেলের জন্ম হয়। ছেলেটি তাঁর কাছেই আছে। পাঁচ বছর বয়সী ছেলেসহ শহিদুলের সঙ্গে আছেন তাঁর মা, বাবা আর ছোট বোন। বাবার দিনমজুরি এবং তাঁর ভিক্ষার টাকা দিয়ে কোনোমতে পাঁচ সদস্যের সংসার চলে।

ভিক্ষাবৃত্তিকে লজ্জার কাজ বলে মনে করেন শহিদুল। তিনি বলেন, ‘ভিক্কে করান নজ্জার কাম। তাই গান কয়া কামাই করব্যার চাম। হামাক অনুষ্ঠানগুলেত গান কওয়ার দিলে ভিক্কে করান নাগতো না। একন গান কয়া কামাই করি মুই বাকি জীবনটে কাটে দিব্যার চাম। গানের ট্যাকা দিয়া ব্যাটাটাক মানুষ করিম।’