একসময় চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত রবিউল ইসলামই এখন এলাকার অনেক মানুষের আশার প্রতীক। হতাশা আর দুশ্চিন্তার দিন পেছনে ফেলে এখন তিনি লাখপতি খামারি। টিউশনির জমানো টাকা দিয়ে কেনা ভেড়া শুধু তাঁর নিজের ভাগ্য বদলায়নি, তিনি আশপাশের অনেক পরিবারে এখন অনুপ্রেরণার উৎস। প্রতিবছর শুধু ভেড়া থেকে রবিউল ইসলামের আয় তিন লাখ টাকা।
রবিউল ইসলাম রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কর্শা গ্রামের হাকিমুদ্দিন ও কোহিনুর বেগমের বড় ছেলে। কোনো আবাদি জমি ছিল না, মাত্র আট শতক ভিটেমাটিই ছিল একমাত্র সম্বল। অভাবের সংসারে থেকেও রবিউল থেমে থাকেননি। নিজের পড়ালেখার খরচ টিউশন করে চালিয়েছেন। ২০২০ সালে রংপুরের ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেন তিনি।
রবিউল বলেন, ডিগ্রি থাকলেই চাকরি জুটবে—এমন ভাবনা থাকলেও বাস্তবতা দেখিয়ে দেয় ভিন্ন পথ। বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য ছোটাছুটি করেও কিছুই হয় না। মন ভেঙে যায়, হতাশায় ডুবে যান তিনি। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি বেড়াতে যান উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামে তাঁর দূরসম্পর্কের নানি মমেনা বেগমের বাড়ি। সেখানে শুনেন গ্রামবাসীদের ভেড়া পালনের গল্প। মমেনার একটি কথাই তাঁর জীবন বদলে দেয় ‘ভেড়া তো মানুষকে না খাইয়া থাকতে দেয় না। যারা ভেড়া পালন করেছে, তারাই ভালো আছে।’
নানি মমেনা বেগমের বাড়ি থেকে ফিরে রবিউল সিদ্ধান্ত নেন ভেড়া পালনের। নিজের টিউশনির জমানো ৩০ হাজার টাকা দিয়ে কিনে আনেন ১২টি ভেড়া। সেই ২০২১ সালের শুরু হয় তাঁর নতুন পথচলা। বর্তমানে তাঁর খামারে ৮৯টি ছাগল ও ভেড়া আছে। প্রতিদিনের যত্ন, খরচ, চিকিৎসা—সব নিজ হাতে সামলান। বছরে তাঁর আয় এখন প্রায় ৩ লাখ টাকা।
রবিউলের মা কোহিনুর বেগম বলেন, ‘আগে ওকে (রবিউল) দেখলে মনে হতো চিন্তায় ডুবে আছে, এখন তো দেখলেই হাসে। ওর এই ভেড়ার খামারটা শুধু ওর না, আমাদেরও গর্ব। ছেলের দুশ্চিন্তা, সংসারে অভাব দূর করেছে ভেড়া।’
কুর্শা গ্রামের সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘রবিউল আগে শুধু নিজের মুখে ভাত জোগানোর চিন্তায় ছিল। এখন পুরো পাড়া তাঁকে নিয়ে খুশি হয়। তাঁর ভেড়া দু–একটা করে পাড়ার সব বাড়িতে ছড়িয়ে আছে। তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে আমিও ভেড়া পালন করছি, সুখে আছি।’
শুধু সাইফুল ইসলাম নন, তাঁর দেখাদেখি বালাপারা গ্রামের সেরাজুল ইসলাম, মমিনুল ইসলাম এবং ইকরচালী গ্রামের কৃষক শরিফুল, গৃহবধূ আসমা খাতুন, সোলেমা বেগম, মরিয়ম খাতুনও এখন ভেড়া পালন করছেন। সবার মুখে হাসি, সংসারে সচ্ছলতা।
রবিউল বলেন, ‘চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছি, হতাশায় ডুবে গিয়েছিলাম। একদিন নানির কথায় সাহস পেয়ে ১২টি ভেড়া দিয়ে শুরু করি খামার। তখন ভাবিনি, ওরাই একদিন আমার জীবন বদলে দেবে। আজ আমি স্বাবলম্বী, বছরে আয় তিন লাখের বেশি। আমার মতো যারা হতাশ, তারা যেন বুঝে—নিজে কিছু শুরু করলেই পথ তৈরি হয়।’
তারাগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কে এম ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, একটা সিদ্ধান্ত, কিছু সাহস আর গ্রামের প্রতি মমতা, এর চেয়ে বড় কোনো মূলধন নেই রবিউলের কাছে। তাঁর গল্প এখন শুধু একটি সাফল্যের গল্প নয়, এটি নতুন গ্রামীণ অর্থনীতির ছোট্ট জ্বলজ্বলে আলোকস্তম্ভ।