ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এমএলএম কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ গ্রাহকদের

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিয়ানশি নামে একটি এমএলএম কোম্পানির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করেন ভুক্তভোগীরা। সোমবার দুপুরে প্রেসক্লাবে
ছবি: প্রথম আলো

নুসরাত জাহান একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। এক বন্ধু চাকরি দেওয়ার কথা বলে একটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানিতে নিয়ে যান। সেখানে দুই ‍দিনের প্রশিক্ষণ নেন। স্বাবলম্বী হওয়ার প্রলোভনে পড়ে ঘর থেকে দুই দফায় মায়ের দুই ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে ওই কোম্পানির লোকজনের কাছে দেন। তাঁরা এর মূল্য নির্ধারণ করেন দুই লাখ টাকা, যা ওই কোম্পানিতেই বিনিয়োগ দেখানো হয়। কিন্তু বিনিময়ে কোনো টাকা পাননি নুসরাত। এখন দুই ভরি সোনা ফেরত চান এই শিক্ষার্থী।

এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা। তিয়ানশি বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির প্রতারণার শিকার হয়েছেন এই শিক্ষার্থী। আজ সোমবার দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘সর্বস্তরের জনগণ’-এর ব্যানারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই কোম্পানির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করেন নুসরাত। সংবাদ সম্মেলনে প্রতারণার শিকার আরও পাঁচজন এ ধরনের অভিযোগ করেন।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিয়ানশির ব্রাহ্মণবাড়িয়া ডিস্ট্রিবিউটর শরীফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা স্কিন কেয়ার, হাউসহোল্ড, হেলথ ইকুইপমেন্ট, পার্সোনাল কেয়ার—এই চার ধরনের পণ্য বিক্রি করি। তাঁদের (অভিযোগকারী গ্রাহক) সঙ্গে সভা করেছি। থানায় অভিযোগ দিয়েছি। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আদালতের আইনজীবী সমিতির ভবনে সভায় সালিস হয়। প্রতারিত হয়েছেন এমন ৫৮ জন ভুক্তভোগীর তালিকা দিলেও তাঁরা কাউকে হাজির করাতে পারেননি ও অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেননি। সময় দিলেও তাঁরা আর সালিসে উপস্থিত হননি। তাঁদের অভিযোগ ভিত্তিহীন। তাঁরা কোনো টাকা পাবেন না।’

‘হেল্প লাইন কমিউনিটি বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা বায়েজিত আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, চীনা কোম্পানি তিয়ানশি ও তাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় কিছু ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটর চাকরি, ব্যবসা, উদ্যোক্তা তৈরি, বিভিন্ন স্কিলের প্রশিক্ষণ, বিনা খরচে বিদেশ ভ্রমণসহ অর্থ উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা এবং স্বর্ণালংকার আত্মসাৎ করেছেন। শহর, গ্রাম ও স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছে। কলেজের মেয়েদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তিয়ানশির মাধ্যমে আয় করে বিনা মূল্যে দেশ-বিদেশে যাওয়ার প্রলোভন দেখান। কুমিল্লায় নিয়ে তিন দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘ব্রেন ওয়াশ’ করানো হয়। পরে শিক্ষার্থীদের টাকা দিয়ে ‘পণ্য কিনে বিনিয়োগ’ করতে বলে। টাকা না থাকলে পরিবার থেকে স্বর্ণালংকার চুরি করতে উদ্বুদ্ধ করেন। টাকা ও স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নিয়ে কিছু পণ্য দিয়ে পরে আর যোগাযোগ রাখেন না তাঁরা। প্রতিবাদ করলে উল্টো বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়াসহ নানা ধরনের হুমকি দেন।

বায়েজিত আহমেদ বলেন, টাকার বিনিময়ে তিয়ানশির ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটররা বিভিন্ন পণ্য দিয়ে থাকেন। ৩৫ টাকা দামের মাথাব্যথা কমানোর যন্ত্র, বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে কাজ করে জানিয়ে ১৩ হাজার টাকা মূল্যের ব্রেসলেট, সাড়ে চার হাজার টাকার ডায়াবেটিকসের ওষুধ, সাড়ে তিন হাজার টাকা দামের টি প্যাক, দুই হাজার টাকা দামের ক্যালসিয়াম জিংকের পাউডার, তিন হাজার টাকা দামের গ্যাসট্রিকের ওষুধ, বয়সের ছাপ কমানোর তিন হাজার টাকা দামের ওষুধ ইত্যাদি।

সদর উপজেলার ঘাটিয়ারা এলাকার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান বলেন, ‘স্কুলের পুরোনো এক বন্ধুর সঙ্গে গত নভেম্বরে অনেক দিন পর দেখা। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দেড় হাজার টাকা নিয়ে তিয়ানশিতে যেতে বলে। সেখানকার লোকজন সাড়ে চার হাজার টাকা দিতে বলেন। পরে দুই দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিনিয়োগ করতে বলেন। টাকা না থাকায় বাড়ি থেকে স্বর্ণালংকার চুরি করতে বলেন। প্রলোভনে পড়ে দুই দফায় মায়ের দুই ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে সুবর্ণা আক্তার নামের একজন ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে দিই। সেখানে চেইন, আংটি, এক জোড়া কানের দুলসহ ৭ প্রকার জিনিস ছিল। তাঁরা দুই লাখ টাকা মূল্য ধরে আমাকে ২০ হাজার টাকার পণ্য দেন। সেসব পণ্য সবই নকল। পরে বুঝতে পারি, আমি প্রতারিত হয়েছি। স্বর্ণ ফেরত চাইলে তাঁরা নানা ধরনের ভয় দেখাচ্ছেন। আমি দুই ভরি স্বর্ণ ফেরত চাই।’

আরেক ভুক্তভোগী ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সাফা বলেন, ‘স্বাবলম্বী হতে ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করি। তারা ইসলামি বিষয় তুলে ধরে। “লস (লোকসান) থেকেই লাভ” বলে আশ্বাস দেয়। মেয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে।’ তিনি বলেন, কোম্পানির লোকজন ৭৫ হাজার টাকার পণ্য কিনলে ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ, ১ লাখ ২০ হাজার টাকার পণ্য কিনলে ২০ শতাংশ লভ্যাংশ এবং ৫ লাখ টাকার পণ্য কিনলে ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ পাওয়ার প্রলোভন দেখান। তা ছাড়া অন্য ক্রেতাদের সম্পৃক্ত করলে লভ্যাংশ পাওয়ার লোভ দেখানো হয়। এসব পণ্যের বিনিময়ে কোম্পানিতে টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে বলে ক্রেতাদের লোভ দেখানো হয়।

বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস স্কুল অ্যান্ড কলেজের এসএসসি পরীক্ষার্থী শেখ শাহরিয়ার বলে, ‘১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়েছি। আরও তিনজন লোক নিতে বলেছে। কিছু পণ্য দিয়ে আর টাকা ফেরত দিচ্ছে না। এক লাখ টাকা পাওনা আছি।’

শাহরিয়ার সেজান, রাফসান রিফাত ও মো. নাঈম নামের আরও ভুক্তভোগী তাঁদের প্রতারিত হওয়ার কথা জানান। তাঁরা বলেন, তিয়ানশির ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিস্ট্রিবিউটর শরীফুল ইসলাম, সুবর্ণা আক্তার, আশরাফুল ইসলাম মেহেদী, ইকবাল হোসেনসহ ১৮ থেকে ২০ জনের নামে তাঁরা অভিযোগ করেন। উল্টো প্রতারকেরা ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছেন বলে তাঁরা জানান।