
ইট বিছানো একটি পায়ে চলা সরু পথ বনের ভেতর দিকে চলে গেছে। ও পথে আশপাশের গ্রামের মানুষ আসা-যাওয়া করেন। পথের দুই পাশে সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছে শাল, গর্জনসহ নানা জাতের গাছ। গাছের নিচে, সড়কের পাশে শুকনা পাতার স্তূপ জমে আছে। শুকনা পাতায় মর্মর শব্দ তুলে দু–একটা বুনো প্রাণী, গিরগিটি এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। ও রকম প্রকৃতি দেখেই কি উৎপল কুমার বসু লিখেছিলেন ‘পথ হতে সরে যাও। শোনা যায় পাতার মর্মর।’
দু–একটি কোকিলও তখন কোথাও শালগাছের পাতার আড়ালে, প্লাবনের ঢেউয়ের মতো ফোটা শালফুলের কাছে বসে শরীর লুকিয়ে ডেকে চলছে। চৈত্রের মৃদু দমকা হাওয়া টুকরা-টাকরা হয়ে ভেঙে পড়ছে কোকিলের ডাকে।
সম্প্রতি মৌলভীবাজারের বর্ষিজোড়া ইকোপার্কের বনে, বুনো জঙ্গলে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেল। তখন মাত্র দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে ঢলে পড়েছে সূর্য। বাতাসে রোদের গরম তেজ আছে, তবে বনের ছায়ায় গরমের সেই আঁচ খুব একটা ছিল না। মৃদু ও দমকা হাওয়া বইছে। পাতারা ঝিলমিল করে লাফিয়ে উঠছে, দুলছে। ঝলমলে রোদ নেমেছে গাছে গাছে, পাতায় পাতায়। লাফিয়ে লাফিয়ে সময় চলছে।
মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের দক্ষিণ দিকে কালেঙ্গার দিকে একটি সড়ক চলে গেছে। ওই সড়কের পাশেই পড়েছে বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক। ওটা সংরক্ষিত বন। বর্ষিজোড়া বিট অফিসের কাছে গিয়েই দেখা মিলেছে নতুন সময়ের, বসন্তকালের। বিট অফিসের কাছেই অনেকগুলো শালগাছে ফুল ফুটে আছে। ইকোপার্কের শালবন এখন ফুলে ফুলে সেজে উঠেছে, নতুন চেহারা পেয়েছে। প্রতিটি শালগাছে ঢেউয়ের মতো লাফিয়ে ফুটেছে ফুল। গাছগুলোর চূড়ায় সোনালি-হলুদ আভার ঝুমকা ফুল বাতাসে দুলছে। এখন বনের ভেতরে সরু পথের দুই পাশে এমন ফুলের বন্যা চলছে।
মাটিতে ঝরে পড়ছে ফুলের পাপড়ি। শাখা-প্রশাখায় এসেছে নতুন পাতা। সেই হালকা, ঘন সবুজ পাতারা চকচক করছে রোদে ও ছায়ায়। কোথাও ঘন নিবিড় গাছের বন, কোথাও অন্য গাছের সঙ্গে মিলেমিশে দাঁড়িয়ে আছে শালগাছ। তবে ফুল দিয়েই সে তার আলাদা জাত এখন চিনিয়ে দিচ্ছে। বনের যেদিকেই তাকানো যায়, শালগাছের দেখা মিলছে, গাছে গাছে ফুলের দেখা মিলছে। বাতাসে শালফুলের মৃদু ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজার সূত্রে জানা গেছে, বর্ষিজোড়া ইকোপার্কের পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে শালবনের বিস্তৃতি আছে। তার অর্থ এসব দিকে এখন শালফুলের মাস চলছে, গাছগুলো শালফুলের উচ্ছ্বাসে ভাসছে।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় মিশ্র-চিরহরিৎ প্রাকৃতিক বনে এই বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। মৌলভীবাজার শহর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে এই বর্ষিজোড়া ইকোপার্কের অবস্থান। ২০০৬ সালে সংরক্ষিত এই বনভূমিকে ইকোপার্ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বর্ষিজোড়া ইকোপার্কের আয়তন ৮৮৭ একর।
বন্য প্রাণী বিভাগ মৌলভীবাজারের রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম ছারওয়ার আলাপকালে জানিয়েছেন, বর্ষিজোড়া ইকোপার্কে ঘন শাল বন আছে। এসব বনে এক লাখের বেশি শালগাছ আছে। এখন শাল গাছে নতুন পাতা আসছে, ফুল আসছে।
বেলা তখন আরও পশ্চিমে ঢলে গেছে, ছায়া ঘন হয়ে এসেছে বনের ভেতর। বনের ভেতর শীতল ভাবটা একটু একটু করে বাড়ছে। দু–একজন পথচারী, দু–একজন পর্যটক ওই সরু পথ ধরে হাঁটছেন। পাখিদের ডাক ছাড়া আর কোনো কোলাহল নেই। এ রকম শান্ত, নিবিড় সবুজের স্থান ছেড়ে আসার পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই পঙ্ক্তিগুলোই সবার আগে মনে বাজে ‘তবে তুমি এসো হেথা নিভৃত ছায়ায়/যেথা এই চৈত্রের শালবন।’