গাছপালা আর নীরবতার আবরণে ঘেরা বাড়িটি প্রকৃতির সঙ্গে লুকোচুরি খেলে দাঁড়িয়ে আছে। বরগুনার আমতলী উপজেলার ঘোপখালী গ্রামে
গাছপালা আর নীরবতার আবরণে ঘেরা বাড়িটি প্রকৃতির সঙ্গে লুকোচুরি খেলে দাঁড়িয়ে আছে। বরগুনার আমতলী উপজেলার ঘোপখালী গ্রামে

সবুজে ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রামে বিশাল পুরোনো বাড়ি, মালিক কে

বরগুনার আমতলীর সবুজে ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রাম ঘোপখালী। সেই গ্রামে ঢুকলে হঠাৎ চোখে পড়ে বিশাল এক পুরোনো বাড়ি। গাছপালা আর নীরবতার আবরণে ঘেরা, যেন প্রকৃতির সঙ্গে লুকোচুরি খেলে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি।

একসময় এটি ছিল তিনতলা বাড়ি। তৃতীয় তলার বড় অংশ ধসে পড়ায় এখন কেবল দুইতলা দৃশ্যমান। ধ্বংসপ্রাপ্ত কাঠামোর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা লাল-ধূসর ইটের এই ভবন যেন নিঃশব্দে উচ্চারণ করে চলেছে হারিয়ে যাওয়া কোনো ইতিহাসের ভাষ্য।

ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির আশপাশে সাত-আটটি পৃথক বাড়ি। সেখানে বসবাস করছেন এই বাড়ি নির্মাতার বংশধরেরা। বাড়িটির স্থাপত্যে ব্রিটিশ আমলের প্রভাব সুস্পষ্ট। খিলানযুক্ত বারান্দা, কারুকার্যপূর্ণ থাম ও অলংকৃত জানালাগুলো যেন সময়কে আটকে রেখেছে। বাড়িটির নিচতলার খিলান, মাঝের গম্বুজধর্মী কাঠামো এবং ওপরের জানালায় ব্যবহৃত কলামগুলো থেকে অনুমান করা যায়, এটি ব্রিটিশ আমলের।

বাড়ির ভেতরে ঢুকলে দেখা যায়, কাঠের দরজা-জানালাগুলো ভেঙে গেছে। ছাদ থেকে ঝরে পড়ছে মাটি ও ধুলা। ভবনটির ভেতরে প্রবেশ প্রায় অসম্ভব। একসময় যে কাঠের ছাদ শোভাবর্ধন করত, তা আজ ধসে পড়ার মতো অবস্থায়। জানালার রঙিন কাচ ভেঙে গেছে, খোদাই করা দরজাগুলো চূর্ণ–বিচূর্ণ।

ইট-চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত ভবনটির দেয়ালগুলো ২৪ ফুট চওড়া। ভবনটির প্রতিটি তলায় সুষমভাবে গঠিত খিলান ও জানালা আছে। নিচতলায় আছে ৭টি খিলান (অর্ধবৃত্তাকার), যা একটি দীর্ঘ বারান্দা তৈরি করেছে। এই খিলানগুলো রোমান-গথিক ধাঁচের, যা ব্রিটিশ আমলে প্রচলিত ছিল। প্রতিটি খিলানের ওপর রুফ-কার্নিশে ছোট ছোট অলংকরণ আছে।

ধ্বংসপ্রাপ্ত কাঠামোর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এই ভবন যেন নিঃশব্দে উচ্চারণ করে চলেছে হারিয়ে যাওয়া কোনো ইতিহাসের ভাষ্য

বাড়িটি নিয়ে কথা হয় বর্তমান বাসিন্দা বাছের উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি কলেজশিক্ষক। বাড়িটি যিনি তৈরি করেছিলেন, তিনি তাঁর ষষ্ঠ প্রজন্মের উত্তরসূরি। তিনি বলেন, বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন ফটিক হাওলাদার নামের একজন। ফটিকের বাবা ঝরু হাওলাদার আঠারো শতকে পটুয়াখালীর বাউফল থেকে এই এলাকায় আসেন। সঙ্গে ছিলেন ফটিক। তখন এই এলাকা ছিল বনজঙ্গলে ভরা। ঝরু তা সাফ করে বসতি গড়েন

এরপর তিনি প্রচুর জমি ‘হাওলা’ (ঊনবিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় কৃষিজমির মালিকানা সম্পর্কের ক্ষেত্রে সৃষ্ট মধ্যস্বত্ব) করেন। বাবার মৃত্যুর পর জমির মালিকানা পান তাঁর ছেলে ফটিক হাওলাদার। তাঁর আমলে পরিবারটি আরও বিত্তশালী হয়। ‘ফটিক হাওলাদার তালুক’ (জমিদারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত করে নেওয়া ভূসম্পত্তি) অর্জন করেন। এরপর পরিবারটির পদবি হয়ে যায় তালুকদার।  

বাছের উদ্দিন বলেন, তাঁদের ধারণা এই বাড়ি ফটিক হাওলাদার তালুক অর্জনের পর উনিশ শতকের গোড়ার দিকে নির্মাণ করেন। ভবনটি ছিল তিনতলা। তবে ওপরের তলা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় কয়েক বছর আগে সেটি তাঁরা ভেঙে ফেলেছেন। ফটিক হাওলাদারের কমপক্ষে এক হাজার একর ফসলি জমি ছিল। সেসব জমি তিনি ওয়াক্‌ফ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন কারণে বর্তমানে তাঁদের এস্টেটের ৯১ একরের মতো সম্পত্তি আছে। বর্তমানে এই এস্টেটের মোতোওয়ালি তিনি।

খিলানগুলো রোমান-গথিক ধাঁচের, যা ব্রিটিশ আমলে প্রচলিত ছিল

নিজেদের বংশ সম্পর্কে বাছের উদ্দিন বলেন, ফটিক হাওলাদারের তিন ছেলে ছিলেন। এই তিন ছেলের ১২ ছেলে ছিলেন।

বাড়ির উত্তরে পুরোনো মসজিদ, দক্ষিণ পাশে বিশাল কাছারিবাড়ি। মসজিদের পাশেই ফটিক হাওলাদার, তাঁর বাবা ঝরু হাওলাদারের কবর। বাড়ির উত্তর পাশে এক একর আয়তনের বিশাল পুকুর। তাতে শানবাঁধানো পুরোনো ঘাট। বাড়িটির সব জায়গাই যেন স্থাপত্যের অনন্য ছোঁয়া লেগে আছে। মসজিদ ও পুকুরের ঘাটকে সংস্কার করে এখনো ব্যবহার উপযোগী রাখা হয়েছে।

বাড়িতেই থাকেন ফটিক হাওলাদারের নাতি মুশফিকুর রহমান (৭৩)। তিনি বলেন, ‘দাদাকে আমি দেখিনি। তিনি সম্ভবত ১৯২০ সালের দিকে মারা গেছেন। আমার দাদা কলকাতা থেকে মিস্ত্রি এনে এই ভবন নির্মাণ করেছিলেন। এর আসবাবসহ সবই কলকাতা থেকে আনা হয়েছিল। ভবনটি পরিত্যক্ত হয়ে গেছে বহু আগে। এটিকে স্থাপনা হিসেবে সংরক্ষণ করা হলে পরের প্রজন্ম জানতে পারত।’

ভবনটি পরিত্যক্ত হয়ে গেছে বহু আগে

বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘শতবর্ষের পুরোনো এই বাড়ির কথা এই প্রথম জানলাম। আমি স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে এটি পরিদর্শন করে সার্বিক বিষয়ে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য বলব। বিষয়টি যদি সত্যি হয় এবং এর সঙ্গে ইতিহাসের যদি বিশেষ সাদৃশ্য থাকে, আমরা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে জানাব সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য।’