
শীতের গভীর রাত। কুয়াশায় ডুবে থাকা রেলস্টেশনের নিস্তব্ধতা ভাঙে এক নবজাতকের কান্নায়। প্ল্যাটফর্মের এক পাশে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীর কোলে জন্ম নেয় ফুটফুটে কন্যাশিশুটি। কান্নার আওয়াজ পেয়ে সেখানে ছুটে যান স্থানীয় কয়েকজন নারী। তাঁরাই মা ও নবজাতককে নিয়ে যান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু ওই রাতে নবজাতকটিকে ফেলে নিখোঁজ হন মা।
অসহায় সেই নবজাতকের খবর পৌঁছে যায় দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলা প্রশাসনের কাছে। চিকিৎসক-নার্সদের যত্নের পর আইনি প্রক্রিয়া মেনে অবশেষে নতুন আশ্রয় পেয়েছে নবজাতকটি। গতকাল বিকেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে ওই নবজাতককে তুলে দেওয়া হয় ইকবাল হোসেন-সাবিনা আক্তার দম্পতির কোলে। তাঁরা আগে থেকেই নবজাতকের নাম ফাতেমা জান্নাত তুবা ভেবে রেখেছিলেন। তাকে কোলে নিয়ে আনন্দে সেই নামে ডেকে ওঠেন তাঁরা।
ওই নবজাতকের অভিভাবকত্ব পেয়েছেন ইকবাল হোসেন। তিনি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট অফিসার। তাঁর স্ত্রী সাবিনা আক্তার গৃহিণী। তাঁরা বিরামপুর পৌর শহরের কলেজ বাজার এলাকার বাসিন্দা। এই দম্পতির দুই ছেলে। তাঁরা নাম-পরিচয়হীন ওই মেয়ে নবজাতককে নেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন।
বিরামপুর রেলস্টেশনের দোকানি ও স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, দুই-তিন মাস ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন ও অজ্ঞাতপরিচয় এক নারী স্টেশন ও এর আশপাশে ঘুরে বেড়াতেন। কেউ খাবার দিলে খেতেন। রাতে প্ল্যাটফর্মেই ঘুমাতেন। ৯ নভেম্বর রাতে স্টেশনটির প্ল্যাটফর্মে একটি মেয়েসন্তানের জন্ম দেন।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, নবজাতকটির জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার মা উধাও হন। খবর পেয়ে অনেকেই অসহায় নবজাতকের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ দেখান। পরে উপজেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেন পাঁচ দম্পতি। একপর্যায়ে বিকল্প পরিচর্যার দায়িত্ব নিতে নবজাতকটির নামে জমি লিখে দেওয়ার শর্ত দেয় উপজেলা প্রশাসন। শর্ত মেনে ইকবাল-সাবিনা দম্পতি ২২ শতাংশ জমি লিখে দিতে রাজি হন। অবশেষে দালিলিকভাবে শর্ত পূরণ করায় নবজাতকটিকে ওই দম্পতির কাছে তুলে দেওয়া হয়।
নবজাতককে কোলে নিয়ে উচ্ছ্বাস করেন ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের মেয়েসন্তান নেই। মেয়েটির জন্মের খবর পাওয়ার পর আমার দুই ছেলে এই নবজাতককে নেওয়ার অনুরোধ করে। উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় মেয়েটি নিলাম। আমি যেন মেয়েটিকে মানুষ করতে পারি এবং উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারি।’
নবজাতকের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, লালন-পালনের সক্ষমতা ও ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে বিকল্প পরিচর্যক হিসেবে ওই দম্পতির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানান ইউএনও নুজহাত তাসনীম। তিনি বলেন, ‘নবজাতককে কোথায় বা কার কাছে দেব, এটি আমাদের একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সে যেন ভালো একটি পরিবারে যায়, এ জন্য আমরা সবার সঙ্গে পরামর্শ করেছি। ভবিষ্যতেও তার খোঁজখবর নেবে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা সমাজসেবা দপ্তর।’