চার বন্ধু মাঠে বসে গল্প করছেন। সম্প্রতি তোলা
চার বন্ধু মাঠে বসে গল্প করছেন। সম্প্রতি তোলা

বন্ধুত্ব যেখানে শব্দের দরকার নেই

চার বন্ধু চুপচাপ বসে আছেন চায়ের দোকানে। মন খারাপ করে নয়, আড্ডায় মেতে আছেন নিজেদের ভঙ্গিতে। কিছুক্ষণ পর হাতের কোমলপানীয় আর বিস্কুট নিয়ে চলে যান পাশের খোলা মাঠে। বসেন সবুজ ঘাসে, খান, হাসেন, আবার ফিরে আসেন সেই চায়ের দোকানে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলছে তাঁদের নীরব আড্ডা—একটাও কথা না বলে। ভাষাহীন এই গল্প বন্ধুত্বের অনন্য উদাহরণ।

ওই চার যুবক হলেন ঝিনাইদহ সদর ও কোটচাঁদপুর উপজেলার বাসিন্দা রিপন মিয়া, হাশেম আলী, তরিকুল ইসলাম ও রাজু আহম্মেদ। তাঁরা বাক্‌প্রতিবন্ধী। কথা বলতে না পারলেও তাঁদের বন্ধুত্ব প্রাণবন্ত। প্রতিদিনের কাজ শেষে একত্রিত হন সদর উপজেলার গোপালপুর বাজারে। আড্ডা দেন, চা পান করেন, গল্প করেন ইশারায়, মুখভঙ্গিতে।

প্রায় ১০ বছরের বন্ধুত্ব তাঁদের। সপ্তাহে অন্তত এক দিন একত্রে গল্প করেন, খাওয়া-দাওয়া করেন। প্রতিবছর একবার দূরে কোথাও ঘুরতে যান। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, তাঁদের মধ্যে কখনো ঝগড়া দেখা যায়নি। তাঁরা ভদ্র ও বন্ধুবৎসল। কখনো কাউকে বিরক্ত করেন না। নিজেদের মতো করে থাকেন।

তাঁদের বন্ধুত্বের শুরু হয়েছিল রিপনের চায়ের দোকান ঘিরে। স্থানীয় বাসিন্দা পলাশ মিয়া বলেন, তাঁদের এলাকায় পাশাপাশি বাড়িতে তিনজন বাক্‌প্রতিবন্ধী আছেন। তাঁরা হলেন রিপন মিয়া, তাঁর ভাই তুষার মিয়া ও তরিকুল ইসলাম। তাঁরা সবাই ছোট থেকে কথা বলতে পারেন না। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে কেউ কিছু বুঝতে পারত না। তাঁরাও নানা সময় অন্যদের সঙ্গে ইশারায় কথা বলতে গিয়ে হাসির পাত্র হতেন।

পলাশ মিয়া বলেন, রিপন মিয়া আনুমানিক ১০-১১ বছর আগে বাজার–গোপালপুর বাজারে একটি চায়ের দোকান করেন। এই চায়ের দোকানে বসতেন তাঁর ছোট ভাই তুষার। এরপর আসতে শুরু করেন তরিকুল। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলা, প্রয়োজনীয় বিষয় আলাপ করা শুরু করেন। হাশেম আলীর বাবা একদিন এসব দেখে ছেলেকে রিপনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। পরে হাশেম আলী তাঁর পরিচিত রাজুকে আনেন। এভাবেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে চারজনের। রিপনের ছোট ভাই তুষারও মাঝেমধ্যে তাঁদের সঙ্গে থাকেন।

রিপন মিয়া সদর উপজেলার বাজার–গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা। জন্ম থেকেই বাক্‌প্রতিবন্ধী। ছোট ভাই তুষার মিয়ারও একই অবস্থা। কথা বলতে না পারায় পড়াশোনা হয়নি। এখন বাজারে একটি চায়ের দোকান চালান। স্ত্রী তাসলিমা খাতুন এবং দুই সন্তান তওজি (৬) ও তৌফিককে (১০) নিয়ে তাঁর সংসার।

একসঙ্গে চলাফেরা করেন বাক্‌প্রতিবন্ধী চার যুবক। সম্প্রতি তোলা

রিপনের স্ত্রী তাসলিমা বলেন, তাঁর স্বামী বাড়িতে থাকার সময় প্রায়ই মুঠোফোনে ভিডিও কল করে বন্ধুদের সঙ্গে ইশারা ভাষায় কথা বলেন। তাঁরা বন্ধুরা ফোনে অনেক মজা করে যোগাযোগ করেন। অনেক সময় তাঁদের সঙ্গেও কথা বলিয়ে দেন। তিনি স্বামীর পাশে থেকে অনেক ইশারা ভাষা শিখেছেন।

হাশেম আলী কোটচাঁদপুর উপজেলার সারুটিয়া গ্রামের কৃষক। দুই ছেলে মাহিম (১২) ও সাহিম (৮) স্কুলে পড়ে। স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে তাঁর সংসার ভালোই চলছে। ছেলে মাহিম বলে, তারাও বাবার ইশারা ভাষা অনেকটা বুঝে নিয়েছে। হাশেমের বাবা বলেন, ছেলে কৃষিকাজ করে সংসার চালায়। গ্রামে-বাজারে একাই সময় কাটাত। কেউ তার কথা বুঝত না, অন্যরাও তাকে কিছু বোঝাতে পারত না। এ জন্য কেউ তার সঙ্গে মিশত না। এমন সময় রিপন আর তরিকুলকে তাদের মধ্যে ইশারায় কথা বলতে দেখে ভালো লাগে তাঁর।

তরিকুল ইসলাম বাজার-গোপালপুর গ্রামের ইউনুচ আলীর ছেলে। ছোটবেলা থেকেই কথা বলতে পারেন না। কৃষিকাজ করেন। স্ত্রী সোনিয়া খাতুন ও চার বছরের ছেলে রায়হানকে নিয়ে তাঁর সংসার। তরিকুলের বাবা বলেন, তাঁর ছেলে কারও সঙ্গে মিশতে না পেরে একা থাকত। এখন তার মতো আরও তিনজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। তারা নিজেদের মতো করে আনন্দ করছে। বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে যাচ্ছে। এটা দেখে তাঁর অনেক ভালো লাগে।

আর রাজু আহম্মেদ কোটচাঁদপুর উপজেলার সলেমানপুর গ্রামের বাসিন্দা। কাপড় সেলাইয়ের কাজ করেন। স্ত্রী বিনা খাতুনও বাক্‌প্রতিবন্ধী। দুই ছেলে আরাফ (এইচএসসি পরীক্ষার্থী) ও নিভিক (এসএসসি পরীক্ষার্থী)। রাজু আহম্মেদের মা মাহফুজা খাতুন বলেন, ছেলের বিয়ে দিয়েছেন বিনা খাতুন নামের আরেক বাক্‌প্রতিবন্ধীর সঙ্গে। তারা ঠিকমতো সংসার করছে। সুখেই আছে তারা। বন্ধুরা এখন তাঁর দ্বিতীয় পরিবার।

তরিকুলের বাবা ইউনুচ আলী জানালেন, ‘এখন আর তাঁরা চারজন নেই। আরও দুজন বাক্‌প্রতিবন্ধী তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতে শুরু করেছেন। শিগগিরই তাঁরা ছয় বন্ধু হয়ে যাবেন।’