
দোতারা শুধু বাজাইলেই হবে না, বানাইতেও হবে—এই ভাবনা থেকেই যশোরের মকবুল বাউল ১২ বছর ধরে কাঠ খোদাই করে তৈরি করছেন দোতারা। দোতারা বানানোই এখন তাঁর পেশা ও নেশা। তাঁর তৈরি আধুনিক দোতারা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও পৌঁছে গেছে।
মকবুল বাউলের বাবা সদর আলীও দোতারা তৈরি করতেন ও বাজাতেন। মকবুলের মেয়ে মোহনা আক্তার নিশিও বাবার দোতারার সুরে মঞ্চে মঞ্চে বাউলগান গেয়ে নিজের সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে সবাইকে মাতিয়ে রাখে। মকবুল বাউলের পরিবারের তিন প্রজন্ম যেন দোতারার সুরে বাঁধা পড়েছে।
যশোর সরকারি সিটি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় ১২ বছরের বেশি সময় চাকরি করেন মকবুল। ২০১৩ সাল থেকে দোতারা তৈরির কাজকে পেশা হিসেবে নেন তিনি। এই দোতারা তৈরিতে তাঁকে সহায়তা করেন স্ত্রী স্বপ্না পারভীন।
স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে মকবুল বাউল যশোর সদর উপজেলার ভেকুটিয়া গ্রামে বসবাস করেন। ১৫ লাখ টাকা দিয়ে সেখানে পাঁচ শতক জমি কিনে একতলা পাকা বাড়ি করেছেন। তবে তাঁর গ্রামের বাড়ি যশোরের চৌগাছা উপজেলার দেবীপুর গ্রামে।
সম্প্রতি ভেকুটিয়া গ্রামে মকবুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির বারান্দায় দোতারা তৈরিতে ব্যস্ত মকবুল ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না। যন্ত্রপাতি দিয়ে দোতারার কাঠামো তৈরির কাজ করছেন মকবুল। এই কাঠামোটি ধরে রেখেছেন স্বপ্না। এভাবে দুজনে মিলে গভীর মনোযোগ দিয়ে দোতারা তৈরি করছেন। একটা দোতারা বানাতে তাঁদের ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। প্রতিটি দোতারা বিক্রি করে তাঁরা পান ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
দোতারা বিক্রির কোনো দোকান নেই মকবুলের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পেজ ও ইউটিউবে ভিডিও দেখে ক্রেতারা দোতারা তৈরির জন্য তাঁকে ফরমাশ দেন। সেই ফরমাশ অনুযায়ী তিনি তৈরি করেন দোতারা। দোতারা তৈরির পর ভিডিও কলের মাধ্যমে বাজিয়ে দেখানো ও শোনানো হয় ক্রেতাকে। পরে তা কুরিয়ারের মাধ্যমে ক্রেতার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন।
মকবুল বাউল ও স্বপ্না বলেন, দোতারা তৈরির জন্য প্রথমে করাতকল থেকে কাঁঠাল বা নিমের কাঠ কেটে আনা হয়। পরে বাড়িতে বসে সেই কাঠ খোদাই করে আধুনিক দোতারার কাঠামো তৈরি করা হয়। সিরিশ কাগজ দিয়ে ঘষে ঘষে ফিনিশিং করে ওই কাঠামোতে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে টান টান করে পশুর চামড়া, লোহার তার ও নাইলনের সুতা স্থাপন করেন। এরপর তাতে গানের সুর ওঠান।
মকবুল বাউলের মেয়ে মোহনাও বাউলগানের শিল্পী। বাবা ও মেয়ে একই মঞ্চে গানের অনুষ্ঠান করেন। মেয়ের গানে যন্ত্র সংগীত করেন মকবুল বাউল। তবে মেয়েকে বাউলগানের তালিম দিয়েছেন মকবুল নিজেই। আর তাঁকে মৌলিক গানের তালিম দিচ্ছেন যশোরের সংগীতগুরু অর্ধেন্দু প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়।
মকবুলের বাবা সদর আলীও দোতারা তৈরি করতেন। মকবুল যখন প্রাথমিকে পড়েন, তখন তাঁর বাবা কাঁঠাল কাঠ দিয়ে একটি দোতারা বানিয়ে ছেলের হাতে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই দোতারা বাজানো শুরু মকবুলের। আর এখন তো বাবার দেখানো পথেই হাঁটছেন তিনি—বানাচ্ছেন দোতারা, সঙ্গে গানও গেয়ে চলছেন। এ ছাড়া এখন তিনি মেয়েকেও বাউলগানের সুরের সঙ্গে বেঁধেছেন।
মকবুল বাউল বলেন, ‘ছোটবেলায় দেখেছি, আমার বাবা বাউলগানের ভক্ত ছিলেন। তিনি ভালো গান গাইতে না পারলেও বাউলদের ডেকে আমাদের বৈঠকখানায় ঘরোয়া গানের আসর জমাতেন। আমার বাবা দোতারা বানাতে পারতেন। ছোটবেলায় বাবা আমাকে একটি দোতারা বানিয়ে দিয়েছিলেন। সুরে–বেসুরে সেই দোতারা বাজিয়ে বেড়াতাম। সেখান থেকেই আমার দোতারার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। সেই ভালোবাসা থেকেই বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে আমি দোতারা বাজাতাম। নিজে গান গাইতাম। আমার উপলব্ধি হলো, শুধু দোতারা বাজাইলে হবে না, বানাইতেও হবে। এরপর ২০১৩ সালে আমি কাঠ খোদাই করে দোতারা তৈরির কাজ শুরু করি। আমার তৈরি দোতারা অনলাইনের মাধ্যমে দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, রংপুর, গাজীপুর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি হয়। এ ছাড়া আমার কাছ থেকে অনেকে দোতারা বানিয়ে মালয়েশিয়া, দুবাই, ইংল্যান্ড, আমেরিকায় নিয়ে গেছেন। এসব দেশে বাঙালি কমিউনিটিতে দোতারার অনেক কদর রয়েছে।
দোতারা তৈরি ও গানের অনুষ্ঠান করে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে জমি কিনে পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে মোহনা আক্তার দশম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। বাবার সঙ্গে মঞ্চে মঞ্চে বাউলগান গেয়ে বেড়ালেও শ্রেণিকক্ষে লেখাপড়ায় মোহনা বেশ ভালো। তার ক্লাসে সে ফার্স্ট গার্ল।
স্বপ্না পারভিন বলেন, ‘যশোর সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক তৃতীয় বর্ষে থাকার সময় আমার বড় মেয়ের জন্ম হয়। তখন লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। পরে দোতারা তৈরির কাজে স্বামীকে সাহায্য করতে শুরু করি। এখন দোতারা তৈরি করে ও বাবা-মেয়ের মঞ্চে গানের অনুষ্ঠানের সম্মানীর টাকা দিয়েই চলে আমাদের পুরো পরিবার। গ্রামের বাড়ি থেকে কিছু ফসলও আসে। সব মিলিয়ে আমরা খুব ভালো আছি।’
মকবুল বাউলের কাছ থেকে চলতি মাসে একটি দোতারা বানিয়ে নিয়েছেন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বাসিন্দা এস কে শংকর হালদার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শংকর হালদার বলেন, ‘দোতারা বাজানো শিখতে মকবুল বাউলের কাছ থেকে একটি দোতারা কিনেছি। তিনি দোতারার দাম ১৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। দোতারাটি বাজাচ্ছি। ভালোই মনে হচ্ছে।’