মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গিয়াসনগরের প্রায় ১৫০ বিঘা জমিতে চাষ হচ্ছে লতি–কচুর
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গিয়াসনগরের প্রায় ১৫০ বিঘা জমিতে চাষ হচ্ছে লতি–কচুর

মৌলভীবাজারের গ্রামটি ক্রমে হয়ে উঠছে ‘লতির গ্রাম’

সব সময়ই গ্রামে বিচ্ছিন্নভাবে কমবেশি ফসলটির চাষ হয়েছে। অন্য ফসলের পাশাপাশি দুই-তিন বিঘা জমিতে চাষ করেছেন কৃষক। এতে চাষিদের নিজেদের চাহিদা মিটেছে, উদ্বৃত্ত ফসল স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেছেন। তবে দুই-তিন বছর ধরে তা আর অল্প কিছু মানুষের চাষাবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ক্রমে ফসলটি বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকে মোড় নিয়েছে। ভরা মৌসুমে গ্রামটিতে এখন প্রায় ১৫০ বিঘা জমিতে চাষ হচ্ছে লতি–কচুর।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গিয়াসনগর গ্রামের লতি–কচু এখন একটি সমৃদ্ধ ফসল। অনেকেরই বাড়তি আয়ের পথ তৈরি করে দিয়েছে ফসলটি। এই গ্রামের ‘লতি’ এখন শুধু স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করছে না, দেশের বিভিন্ন শহরেও সরবরাহ করা হচ্ছে।

গিয়াসনগর গ্রামের হাবিবুর রহমান নতুন জাতের কিছু পেলেই চাষ করেন। এ বছর তিনি নতুন করে যুক্ত হয়েছেন লতি–কচু চাষে। তিনি এ বছর ২১ শতাংশ জমিতে লতিরাজ বারি কচু-১ রোপণ করেছেন। অর্গানিক চাষাবাদের দিকেই তাঁর ঝোঁক। তিনি তাঁর কচুখেতে জৈব সার ব্যবহার করেছেন। রাসায়নিক সার ব্যবহার এড়িয়ে গেছেন। এতে তাঁর লতির উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে। এ নিয়ে অবশ্য তাঁর কোনো আফসোস নেই।

হাবিবুর জানান, ভাদ্র মাসে চারা রোপণ করেছেন। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে লতি তোলা শুরু করেছেন। ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি ধরে লতি বিক্রি করছেন। এখন লতির মৌসুম শেষের পথে। কিছুদিন পর লতির দাম আরও বাড়বে। এখন সপ্তাহে ৭০ থেকে ৭৫ কেজি লতি তুলতে পারছেন। কোনো রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ভবিষ্যতে সপ্তাহে ৩০০ থেকে ৪০০ কেজি লতি তুলতে পারবেন বলে আশা করছেন। তা ছাড়া লতি–কচুর চারা বিক্রি থেকেও তাঁর আয় হবে। এ পর্যন্ত তাঁর বিনিয়োগ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। তাঁর আশা, বালাইনাশক, শ্রমিক খরচসহ সব খরচ বাদ দিয়ে এই কচুর লতি বিক্রি করে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাভ হবে।

গ্রামের আবদুল আজিজ জানিয়েছেন, তিনি এ বছর ১ কিয়ার (৩০ শতাংশ=১ কিয়ার) জমিতে লতি–কচুর চাষ করেছেন। এবার আমন ধান কাটার পর আরও ১৫ শতাংশ জমিতে নতুন করে চারা লাগাবেন।

গ্রামের মিলন মিয়া ৪ কিয়ার, কাজিম মিয়া আড়াই কিয়ার, আফাই মিয়া ৪ কিয়ার জমিতে লতির চাষ করেছেন। তাঁদের মতো আরও অনেকে আছেন, যাঁরা লতি কচু চাষ করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

লতি–কচুর চাষি আমির হোসেন বলেন, ‘সিজনে (ভরা মৌসুমে) নিচে ১৫০ কিয়ার জমিতে লতার (লতি) চাষ অয় (হয়)। প্রতিদিন এক-দুই ট্রাক করে লতা (লতি) সিলেটে যায়। গ্রামে এখন লতা চাষে নতুন নতুন কৃষক বাড়ছে। এবার আরও নতুন খেত বাড়ব (চাষ হবে)।’

গিয়াসনগর গ্রামের ‘লতি’ এখন শুধু স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করছে না, দেশের বিভিন্ন শহরেও সরবরাহ করা হচ্ছে

আমির হোসেন জানিয়েছেন, তিনি ভরা মৌসুমে আট কিয়ার জমিতে লতার চাষ করেছিলেন। এখন তাঁর সাড়ে তিন কিয়ার জমিতে লতি–কচু আছে। লতি–কচুর চারা রোপণের পর এক থেকে দেড় মাস বাদে ফসল তোলা যায়। এক কিয়ার জমিতে চাষের শুরু থেকে একেবারে শেষ পর্যন্ত ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে থাকে। গোড়া পচা রোগসহ কোনো ধরনের বিপর্যয় না হলে এক কিয়ার জমি থেকে দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকার বেশি ফসল বিক্রি করা যায়। তিনি আট থেকে ১০ বছর ধরে লতার চাষ করে আসছেন।

কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অগ্রহায়ণ মাসের ধান কাটা শেষ হলে পৌষ মাসে জমিতে চারা রোপণ করা হয়। এই গাছ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত ফসল তোলা যায়। এটাই হচ্ছে লতার ভরা মৌসুম। তারপর ওই জ্যৈষ্ঠ মাসেই আবার নতুন করে চারা রোপণ করা হয়। পরে প্রায় পাঁচ-ছয় মাস পর্যন্ত এই খেত থেকে ফসল পাওয়া যায়। ভরা মৌসুমে ফসল বেশি থাকে, তখন দাম কিছুটা কম মেলে। অন্য সময়ে ফসল কম হলেও দাম ভালো পাওয়া যায়। পাইকারেরা এখানকার লতা ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যান।

স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিরোজ কান্তি রায় বলেন, ‘গ্রামটিতে লতি এখন একটি সমৃদ্ধ ফসল। চার-পাঁচ বছর আগে কম ছিল। দুই-তিন বিঘা জমিতে লোকজন লতি–কচুর চাষ করতেন। এখন এখানে মৌসুমে ১৫০ বিঘা জমিতে লতির চাষ হচ্ছে। সারা বছর ৫০ থেকে ৭০ বিঘা জমিতে লতি চাষ হয়। লতি খুবই লাভজনক একটি ফসল। ফসলটিতে রোগবালাই তুলনামূলক কম। গ্রামে লতার চাষ বাড়ছে। এটা লতার গ্রাম হয়ে উঠছে।’