উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে ছাত্রীদের বিক্ষোভ। গত সোমবার
উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে ছাত্রীদের বিক্ষোভ। গত সোমবার

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সংঘর্ষ থেকে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি, সাত দিনে যা যা ঘটল

ছাত্রীকে মারধরের খবর জানাজানি হলে বিভিন্ন হল থেকে দলে দলে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের ২ নম্বর গেটসংলগ্ন জোবরা গ্রামে গিয়ে জড়ো হন। সংঘর্ষ বড় আকার ধারণ করে। শিক্ষার্থীদের কুপিয়ে ও ইটের আঘাতে গুরুতর জখম করা হয়।

দীর্ঘ তিন যুগ পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন আয়োজন হচ্ছে। সব ঠিকঠাক থাকলে ১২ অক্টোবর ভোট গ্রহণ হওয়ার কথা। এ নিয়েই শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু গত ৩০ আগস্ট মধ্যরাত থেকে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি পাল্টে গেল। ক্যাম্পাস-সংলগ্ন জোবরা গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বেধে গেল। এর পর থেকে ঘটল নানা ঘটনা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ক্যাম্পাসের ২ নম্বর গেটের কাছে জোবরা গ্রামের একটি ভবনে ভাড়া থাকতেন। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ৩০ আগস্ট দিবাগত রাত সোয়া ১২টার দিকে তিনি ওই ভবনে প্রবেশের চেষ্টা করলে ভবনের দারোয়ান তাঁকে মারধর করেন। এ সময় ২ নম্বর গেটে থাকা শিক্ষার্থীরা গেলে দারোয়ান পালিয়ে যান। শিক্ষার্থীরা তাঁকে ধাওয়া করলে স্থানীয় লোকজন ইটপাটকেল মারা শুরু করেন। তখন সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেই থেকে পরিস্থিতি নাজুক হতে থাকে।

সেই রাতে মুহূর্তেই ছাত্রীকে মারধরের খবর জানাজানি হয়ে যায়। বিভিন্ন হল থেকে দলে দলে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের ২ নম্বর গেটসংলগ্ন জোবরা গ্রামে গিয়ে জড়ো হন। সংঘর্ষ বড় আকার ধারণ করে। শিক্ষার্থীদের কুপিয়ে ও ইটের আঘাতে গুরুতর জখম করা হয়। দিবাগত রাত প্রায় সাড়ে তিনটার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গেলে দুই পক্ষ সরে যায়। তবে সংঘর্ষের ঘটনার কোনো সমাধান বের করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। রাতেই অন্তত ৭০ শিক্ষার্থী আহত হন। বন্ধ হয়ে যায় ২ নম্বর গেট থেকে জোবরা হয়ে চট্টগ্রাম-হাটহাজারী মহাসড়কে যান চলাচল।

‘রক্তাক্ত’ রোববার

রোববার, অর্থাৎ ৩১ আগস্ট সকাল থেকেই ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি থমথমে ছিল। সকাল ৯টার দিকে ক্যাম্পাসের মূল ফটক আটকে দেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা-কর্মীরা। তাঁরা বিক্ষোভ শুরু করেন। হামলার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত আটকের দাবি জানান। তাঁরা ‘স্থানীয়রা হামলা করে, প্রশাসন কী করে’, ‘বিচার চাই, হামলাকারীর বিচার চাই’—এমন আরও নানা ধরনের স্লোগান দেন।

কর্মসূচির শুরুতেই নেতা-কর্মীরা তিনটি দাবি তুলে ধরেন। এসব দাবি হলো শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, ঘটনার সূত্রপাতের সিসিটিভি ফুটেজ দেওয়া ও নিরাপত্তাচৌকি বসানো। এ সময় শাখা ছাত্রশিবিরের প্রচার সম্পাদক ইসহাক ভূঞা বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সময় প্রশাসন কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মীকে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে ঘুরে চলে যায়। এতে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি হামলার শিকার হয়।

হামলার সময় প্রশাসন কোথায় ছিল? প্রশাসন শিক্ষার্থীদের জন্য কী নিরাপত্তা দিয়েছে?’
একপর্যায়ে কর্মসূচিতে মূল ফটকের সামনে গিয়ে উপস্থিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার, সহ-উপাচার্য মো. কামাল উদ্দিন, প্রক্টর তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফসহ কয়েকজন শিক্ষক।

গ্রাফিকস: নূর–ই–এলাহী
বিকেলে গুরুতর আহত অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদকে নগরের পার্ক ভিউ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ছয় দিন ধরে তিনি লাইফ সাপোর্টে আছেন। তাঁর কনশাস লেভেল এখন ৭-এর আশপাশে।

এ সময় সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের নিরীহ শিক্ষার্থীরা এলাকার সন্ত্রাসীদের দ্বারা আহত হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের পাশে রয়েছে।’

সেদিন সহ-উপাচার্য বলেন, ‘আমরা পুলিশ প্রশাসন থেকে যে পরিমাণ সহায়তা পাওয়ার কথা, সেটি পাইনি। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত পুলিশ থাকত, সব জায়গায় পুলিশের পাহারা থাকত, জলকামান থাকত, বিশ্ববিদ্যালয় বলার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আসত। কিন্তু পুলিশ আমাদের বলেছে তারা সরি, তারা আসতে পারবে না। আজ সকাল (রোববার) পুলিশ ডেকেছি। পুলিশ সুপারকে ফোন করেছি। কালকে ৩০ বারের ওপরে আমার সঙ্গে পুলিশ সুপারের কথা হয়েছে। তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু আমরা পাইনি।’
ছাত্রশিবিরের বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, প্রক্টর চলে যান। তার পরও কিছুক্ষণ চলেছে কর্মসূচি। এর মধ্যে ক্যাম্পাসের ২ নম্বর গেট এলাকায় আবার উত্তেজনা দেখা দেয়। সহ-উপাচার্য মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান ও মো. কামাল উদ্দিন জোবরা গ্রামে চলে যান।

তখন বেলা সাড়ে ১১টা। জোবরা গ্রামের ভেতর সেনোয়ারা ভবনের সামনে কয়েক শ শিক্ষার্থী জড়ো হন। বিপরীত প্রান্তে অবস্থান করছিলেন শত শত স্থানীয় বাসিন্দা। মাঝখানে দুই পক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন শিক্ষকেরা। এভাবে শেষ হয় প্রায় আধা ঘণ্টা। কিন্তু লাভ হয়নি।

সংঘর্ষের সময় আহত শিক্ষার্থী মামুন মিয়া
আমি চাই আমার ছেলেটা সুস্থ হয়ে যাক। দোষীদের বিচার চাই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলেছি, তাদের গাফিলতির কারণে এতগুলো শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। কোটি টাকা দিলেও তো আমার ছেলে আগের মতো হবে না।
শাহানাজ আমিন, আহত শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদের মা।

দুপুর ১২টা। শুরু হয় দ্বিতীয় দফার সংঘর্ষ। ইটের আঘাতে সহ-উপাচার্য কামাল উদ্দিন, প্রক্টর তানভীর মোহাম্মদ হায়দারসহ কয়েকজন শিক্ষক আহত হয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে যান।

এরপর থেমে থেমে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীরা আটকে যান অলিগলিতে। তাঁদের কুপিয়ে জখম করা হয়। ইট দিয়ে মাথা ফাটানো হয়। একের পর এক শিক্ষার্থীকে রক্তাক্ত অবস্থায় প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়, তারপর সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের বাসে-অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালগুলো জানায়, অন্তত ২০০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।

সেদিন সরেজমিন দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল লোহার রড, পাইপ, কাঠের গুঁড়ি, পাথর। গ্রামবাসীর হাতে ছিল রামদা, লোহার রড, পাইপ। সংঘর্ষে জোবরা গ্রাম রণক্ষেত্র হয়ে পড়ে।

বিকেলে গুরুতর আহত অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদকে নগরের পার্ক ভিউ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ছয় দিন ধরে তিনি লাইফ সাপোর্টে আছেন। তাঁর কনশাস লেভেল এখন ৭-এর আশপাশে। একজন স্বাভাবিক মানুষের কনশাস লেভেল ১৫। এটি ১০-এর ওপরে ওঠার আগপর্যন্ত তাঁকে আশঙ্কামুক্ত বলা যাবে না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

গত রোববার নগরের পার্ক ভিউ হাসপাতালে আইসিইউর সামনে বসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ইমতিয়াজের মা শাহানাজ আমিন ছেলের জন্য দোয়া চেয়ে বলেন, ‘আমি চাই আমার ছেলেটা সুস্থ হয়ে যাক। দোষীদের বিচার চাই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলেছি, তাদের গাফিলতির কারণে এতগুলো শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। কোটি টাকা দিলেও তো আমার ছেলে আগের মতো হবে না।’

১৪৪ ধারা জারি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আগমন

রোববার সংঘর্ষ শুরুর প্রায় তিন ঘণ্টা পর ক্যাম্পাস-সংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন। বেলা সাড়ে তিনটায় সেনাবাহিনী, র‍্যাব ও পুলিশের সদস্যরা জোবরা গ্রামে প্রবেশ করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা গাড়ি ঘিরে ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে দুই পক্ষকেই সরিয়ে দেন।

এ ঘটনার পর ক্যাম্পাসের আশপাশে থাকা কটেজ-মেস থেকে শিক্ষার্থীরা সরে যেতে থাকেন। নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা থাকায় মূলত শিক্ষার্থীরা এলাকা ছাড়েন। তাঁদের একজন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ইশতিয়াক আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জোবরা গ্রামে ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। নিরাপত্তাহীনতায় এলাকা ছাড়তে হলো তাঁর। হঠাৎ তাঁদের বাসা ছাড়তে হয়েছে। এতে বিপদে পড়েছেন তিনি।

সংঘর্ষের ঘটনায় ১ হাজার ৯৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে কর্তৃপক্ষ। এতে ৯৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১ হাজার জনকে আসামি করা হয়। তবে মামলার এজাহারে ছাত্রীকে মারধরের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। মামলার পর ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে হাটহাজারী থানা-পুলিশ।

রাতে জরুরি বৈঠক, অস্ত্র লুট নিয়ে আলোচনা

সংঘর্ষ থামার পর রোববার রাতে বৈঠকে বসে কর্তৃপক্ষ। এতে উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহ্‌ইয়া আখতার, সহ-উপাচার্য অধ্যাপক শামীম উদ্দিন খান, জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবিদ, চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম, র‍্যাব-৭-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাফিজুর রহমান, সাবেক চাকসু ভিপি এস এম ফজলুল হক, জোবরা গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা, শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা অংশ নেন।

বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয় ও পাশের জোবরা-ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দাদের নিয়ে সমন্বিত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর নাজমুল হোসাইন বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্টের পরে কর্তৃপক্ষ প্রায় ১৬০টি রামদা সংগ্রহ করেছিল। লুট করার জন্য ছয়টি তালা ভাঙা হয়েছে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মারাত্মকভাবে আহত করা হয়েছে।’

সহকারী প্রক্টর আরও বলেন, ‘তাঁরা (নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য) ছাত্রদের পায়ে পড়েছেন। সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) স্যার শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করেছেন, তোমরা প্লিজ এটা করবা না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটা ভালো দেখাবে না। অনেক কথা বলেছেন, কিন্তু আমরা কিছু করতে পারিনি। প্রায় ১৩০টি রামদা আমাদের অস্ত্রাগার থেকে লুট হয়েছে। সেটার জন্য আমাদের সব ছাত্রসংগঠনের সহযোগিতা চাই। এবং এটা কখনো হয়তো আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য বুমেরাং হয়ে যেতে পারে বলে আমি আশঙ্কা করছি।’

সোমবার: পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ শুরু

নিরাপত্তা চেয়ে এদিন বেলা দুইটার দিকে উপাচার্যের বাসভবনের ফটকের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন বিভিন্ন বিভাগের ৭০ থেকে ৮০ ছাত্রী। তাঁরা ‘শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নাই, প্রশাসন কী করে’, ‘শিক্ষার্থীর রক্ত ঝরে, ভিসি স্যার নিয়োগ বোর্ডে’—এমন আরও নানা স্লোগান দেন। ফটকের সামনে প্রায় ৩০ মিনিট বিক্ষোভের পর ছাত্রীরা শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন। সেখানেও তাঁরা প্রশাসনের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন।

ছাত্রীরা কর্মসূচিতে বলেন, শিক্ষার্থী আহত হওয়ার দায় প্রশাসন এড়াতে পারে না। কেননা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সংঘর্ষ চললেও প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ঘটনাস্থলে নিতে পারেনি। এ ছাড়া হাজারখানেক শিক্ষার্থী আহত হলেও উপাচার্য বলছেন ২০০ শিক্ষার্থীর কথা।

প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগ দাবিতে মশালমিছিল

এরপর সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে উপাচার্যের পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবিতে ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, ইসলামী ছাত্র মজলিশ বিক্ষোভ শুরু করে। তারপর সংহতি জানিয়ে যোগ দেয় ছাত্রদল। শহীদ মিনার থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে সব সংগঠনের নেতা-কর্মীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন।

সোমবার বিকেলে চাকসুর খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। তবে এতে দুজন শিক্ষককেও ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। পাশাপাশি ছাত্র হলের ভোটার হিসেবে পাঁচ ছাত্রীর নামও ভোটার তালিকায় ছিল। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা শুরু হয়।

মঙ্গলবার: বিক্ষোভ, মামলা, জরুরি সিন্ডিকেট সভা

উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার ও প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগের দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করে ছাত্রদল ও গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট। এদিন দুপুর ১২টায় ক্যাম্পাসের বুদ্ধিজীবী চত্বরে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করেন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা ‘আমার ভাইয়ের রক্ত ঝরে, প্রশাসন কী করে’, ‘দফা এক, দাবি এক, প্রশাসনের পদত্যাগ’—এমন নানা স্লোগান দেন।

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের নেতা-কর্মীরা।
এদিন সংঘর্ষের ঘটনায় ১ হাজার ৯৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে কর্তৃপক্ষ। এতে ৯৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১ হাজার জনকে আসামি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (নিরাপত্তা) আবদুর রহিম বাদী হয়ে হাটহাজারী থানায় এ মামলা করেন। তবে মামলার এজাহারে ছাত্রীকে মারধরের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। মামলার পর ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে হাটহাজারী থানা-পুলিশ।

অন্যদিকে লুট হওয়া অস্ত্র ফিরিয়ে দিতে শিক্ষার্থীদের নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এসব অস্ত্র ফিরিয়ে দেওয়া না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। এরপর ১৬ ছাত্র ধারালো অস্ত্র জমা দিয়ে যান।

তবে উদ্ধার করা ধারালো অস্ত্র এত দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অস্ত্রাগারে’ রেখে দেওয়া নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে কর্তৃপক্ষ। আইনজীবীরা বলেছেন, অস্ত্রগুলো পুলিশের কাছে জমা দেওয়া উচিত ছিল।

সংঘর্ষের ঘটনার পর মঙ্গলবার বিকেলে জরুরি সিন্ডিকেট সভায় বসে কর্তৃপক্ষ। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সভা শেষে কর্তৃপক্ষ জানায়, আবাসন-সংকট দূর করতে তারা ১০টি আবাসিক হল নির্মাণ করার প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠাবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ডিপিপি প্রস্তুত করা হবে। এ ছাড়া ক্যাম্পাস-সংলগ্ন এলাকায় একটি মডেল থানা করার প্রস্তাব পাঠানো হবে। এ ছাড়া আরও নানা সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেটে হয়।

বুধবার: নারী অঙ্গনের খোলাচিঠি

এদিন বিকেল চারটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতিতে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ‘মোরাল পুলিশিং, ধর্ষণের হুমকি, সাইবার বুলিং ও প্রশাসনের অবহেলা’র প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও দেশবাসীর উদ্দেশে খোলাচিঠি পাঠ করে ‘নারী অঙ্গন’ নামের একটি সংগঠন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও নারী অঙ্গনের সংগঠক সুমাইয়া শিকদার খোলাচিঠি পাঠ করেন। খোলাচিঠিতে বলা হয়, ‘হাসিনার পতনের পর নতুন স্বপ্ন নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এক বছরের মধ্যেই নারীবিদ্বেষী কার্যক্রমের মাধ্যমে নারীদের জন্য ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি করেছে। স্বয়ং প্রক্টর নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, সান্ধ্য আইন জারি করেছেন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নারী শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করেছেন। ফলে নারী শিক্ষার্থীরা বারবার অনলাইন ও অফলাইনে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।’

খোলাচিঠি পাঠের পাশাপাশি নারী অঙ্গনের পক্ষ থেকে সদস্য জান্নাতুল ফেরদৌস সাত দফা দাবি তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসা ও চিকিৎসা ব্যয় প্রশাসনের বহন; স্থানীয় সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচার; ক্যাম্পাসের ভেতরে-বাইরে শতভাগ নিরাপত্তা ও আবাসন ভাতা চালু; পরিবহনে ই-কার ও চক্রাকার বাস চালু; যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল কার্যকর করা; ১ ও ২ নম্বর গেট ও রেলক্রসিং এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় ব্যর্থ হওয়ায় উপাচার্য ও প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগ।

বৃহস্পতিবার: বিক্ষোভ অব্যাহত, সীমিত পরিসরে ক্লাস শুরু

সংঘর্ষের চার দিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম সীমিত পরিসরে শুরু হয়। এদিন একটি বিভাগের পরীক্ষা চলেছে।

প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগের দাবিতে এদিনও বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট। বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে বিক্ষোভ মিছিল শেষে ছাত্র জোটের নেতা-কর্মীরা প্রক্টর অফিসের সামনে অবস্থান নেন।

বিক্ষোভ কর্মসূচির শুরুতে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগের সময়সীমা বেঁধে দেন নেতা-কর্মীরা। পরে সন্ধ্যা ছয়টায় মশালমিছিল করে প্রতিবাদ জানান। একই দাবিতে ক্যাম্পাসে মশালমিছিল করে ছাত্রদলও।

বেলা ১১টায় ‘অধিকার সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দের’ ব্যানারে এ কর্মসূচিতে যোগ দেন গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ এবং নারী অঙ্গনের নেতা-কর্মীরা। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সাত দফা দাবি লিখে প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। এ সময় প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিতে তাঁরা স্লোগান দেন। এদিন প্রক্টর ভবনে লাল রং ছিটিয়ে প্রতিবাদ জানানোর ঘোষণা দেন তাঁরা।

এদিন দুপুর ১২টার দিকে শিক্ষার্থীদের মারধরের বিচার, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত, আবাসন সমস্যা সমাধান ও প্রশাসনের জবাবদিহিসহ পাঁচ দাবিতেও মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা। ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দের’ ব্যানারে শহীদ মিনারের সামনে এ কর্মসূচি পালিত হয়।

শুক্রবার: আহতদের দেখতে হাসপাতালে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা

আহত তিন শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিচ্ছেন চট্টগ্রাম নগরের পার্ক ভিউ হাসপাতালে। তাঁরা হলেন ইমতিয়াজ আহমেদ, মামুন মিয়া ও সাদিদ মাহবুবু। এই তিন শিক্ষার্থীকে দেখতে গতকাল সকালে হাসপাতালে যান অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। তিনি স্বজনদের সঙ্গেও কথা বলেন।

এদিকে গতকাল প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগসহ সাত দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে ‘অধিকার সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দ’। ক্যাম্পাসের কলাভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে এসব দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবিগুলো হলো আহত শিক্ষার্থীদের মানসম্মত চিকিৎসার নিশ্চয়তা, ক্যাম্পাসে নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা, হামলার ভিডিও প্রকাশকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রকৃত অপরাধীদের বিচার, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমন্বয় কমিটি গঠন।