জন্মান্ধ চাঁন মিয়া হবিগঞ্জ শহরে পত্রিকা বিলি করেন। মঙ্গলবার দুপু‌রে হ‌বিগঞ্জ শহ‌রে
জন্মান্ধ চাঁন মিয়া হবিগঞ্জ শহরে পত্রিকা বিলি করেন। মঙ্গলবার দুপু‌রে হ‌বিগঞ্জ শহ‌রে

হবিগঞ্জের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী চাঁন মিয়া প্রতিদিন গ্রাহকের কা‌ছে প‌ত্রিকা পৌঁছে দেন

হবিগঞ্জের চাঁন মিয়া (৫৮) চোখে দেখতে পান না। এ প্রতিবন্ধিতা নিয়েই তিনি প্রতিদিন প্রায় ২০০ গ্রাহকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেন। পত্রিকা বিলির কাজটি ২৪ বছর ধরে করছেন তিনি।

হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বারাপইল গ্রামের বাসিন্দা চাঁন মিয়া। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় ছোটবেলা থেকে সমাজে অবহেলিত ছিলেন। গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করা চাঁন মিয়ে তরুণ বয়স থেকেই কাজের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু চোখে দেখেন না বলে কেউ কাজ দিতেন না। আবার কাজ দিলেও পারিশ্রমিক কম দিতেন।

চাঁন মিয়া নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে বলেন, একদিন স্থানীয় এক ব্যক্তির পরামর্শে তিনি পত্রিকা বিক্রিতে সম্মত হন। ১৯৯৮ সালে দৈনিক এক্সপ্রেস নামের স্থানীয় একটি পত্রিকা বিক্রির সুযোগ পান। প্রথম দিন ৪০টি পত্রিকা বিক্রি করে ৪০ টাকা পেয়েই মহাখুশি তিনি। সেই থেকে এ পেশায় আছেন। বর্তমানে তাঁর কাছ থেকে পত্রিকা নেন প্রায় ২০০ গ্রাহক।

চোখে না দেখলেও কীভাবে গ্রাহকের কাছে পত্রিকা বিলি করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে চাঁন মিয়া বলেন, ‘আমি চোখে না দেখলে কী হবে, মনের আলোয় সব দেখতে পাই।’ সময় বোঝেন সূর্যের তাপের ওঠা-নামা অনুভব করে। পেশাগত কারণে হবিগঞ্জ শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত চষে বেড়ানোর ফলে শহরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতের অবস্থান তাঁর আয়ত্তে।

চাঁন মিয়া বলেন, প্রতিদিন সকাল সাতটায় পত্রিকা নিয়ে বের হয়ে সহকর্মীদের কাছে জেনে নেন সেদিনের পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের শিরোনাম। জোরে জোরে বলতে থাকেন সেসব শিরোনাম আর বিক্রি করেন পত্রিকা। বড় কাপড়ের ব্যাগে পত্রিকাগুলো ভাগ ভাগ করে সাজিয়ে রাখেন, যাতে গ্রাহক চাইলে সহজে বের করে দিতে পারেন।

তবে টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় বলে দাবি করলেন চাঁন মিয়া। তিনি বলেন, কেউ কেউ পাঁচ টাকার নোট দিয়ে বলেন ১০ টাকা। আবার অনেকে জাল ও ছেঁড়াফাটা নোট দিয়ে ঠকান। তবে এ থেকে বাঁচতে তিনি তাঁর পাঞ্জাবিতে চারটি পকেট রেখেছেন। একটি পকেটে ২ টাকা, একটিতে ১০ টাকা, অপরটিতে ২০ টাকা এবং সর্বশেষ পকেটে রাখেন বড় অঙ্কের নোটগুলো। এতে সহজ হয় তাঁর লেনদেন। এভাবে রোদ-বৃষ্টি-ঝড় বা কনকনে শীত উপেক্ষা করে পাঠকের দ্বারে পত্রিকা পৌঁছে দেন তিনি।

চাঁন মিয়া বলেন, ‘আমার যাঁরা গ্রাহক, তাঁরা আমাকে ভালোবেসে পত্রিকা কেনেন। অনেক সময় পত্রিকা পৌঁছাতে দেরি হলেও কেউ বিরক্ত হন না।’ তবে চোখে দেখেন না বলে নানা দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়েছে বহুবার। একবার একটি নর্দমায় পড়ে গিয়ে পা ভেঙে যায়। তিন-চারবার রিকশার নিচে পড়ে আহত হয়েছেন।

চাঁন মিয়ার দুই সন্তান। মেয়ে ফারহানা আক্তার এইচএস‌সি পর্যন্ত পড়া‌শোনা ক‌রে‌ছেন। ছেলে বায়েজিদ রাহিন হ‌বিগঞ্জ আলীয়া মাদ্রাসা থে‌কে আলিম পাস ক‌রে‌ছেন। ক‌য়েক বছর আগেও পত্রিকা বিক্রি করে সংসার ভালোই চলত তাঁর। কিন্তু এখন মানুষ অনলাইনমুখী হওয়ায় পত্রিকা বিক্রি কমে গেছে। এর প্রভাব তাঁর জীবনেও পড়েছে।

হ‌বিগঞ্জ শহ‌রের সংবাদপত্র এজেন্ট লায়েছ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, চাঁন মিয়া প্রতিদিন হেঁটে শহরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে পত্রিকা বিলি করেন। কখনো ভুলে এক গ্রাহকের পছন্দের পত্রিকা অন্য গ্রাহককে দেননি।

হবিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রভাকর প‌ত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক স‌হিবুর রহমান বলেন, চোখে দেখেন না বলে দমে যাননি তিনি। প্রতিদিন গ্রাহকের কাছে পত্রিকা পৌঁছাতে তাঁর কোনো অলসতা নেই।