নাজিফা যখন পরীক্ষার হলে, মর্গে চলছিল তার মায়ের লাশের ময়নাতদন্ত

হত্যা
প্রতীকী ছবি

নরসিংদীতে হত্যার শিকার মায়ের লাশ মর্গে রেখে নাজিফা আক্তার নামের এক এসএসসি পরীক্ষার্থী উচ্চতর গণিত (তত্ত্বীয়) বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। আজ শনিবার সকালে নরসিংদী শহরের সাটিরপাড়া কে কে ইনস্টিটিউশন অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে সে যখন পরীক্ষা দিচ্ছিল, তখন নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গে তার মায়ের লাশের ময়নাতদন্ত চলছিল।

নাজিফা নরসিংদী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী হিসেবে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। সে সদর উপজেলার নজরপুর ইউনিয়নের কালাইগোবিন্দপুর গ্রামের আরিফা বেগম ও আরমান মিয়া দম্পতির বড় মেয়ে। গতকাল শুক্রবার দুপুরে সদর উপজেলার নজরপুর ইউনিয়নের কালাইগোবিন্দপুর গ্রামের একটি পুকুর থেকে নাজিফার মা আরিফা বেগম ওরফে দীপার (৪২) লেপে মোড়ানো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নাজিফার বাবা আরমান মিয়া পলাতক রয়েছেন।

বেলা একটায় পরীক্ষা শেষে নাজিফা আক্তার প্রথম আলোকে বলে, ‘সকাল সাড়ে ১০টা থেকে টানা দুই ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়েছি। মা খুন হওয়ার পর থেকে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। মায়ের লাশ মর্গে রেখে পরীক্ষার হলে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারছিলাম না। তবে সহপাঠী, শিক্ষক ও পরিবারের সদস্যদের মানসিক সাপোর্ট পেয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছি। এই পরীক্ষায় পাস করতে পারব হয়তো, কিন্তু মা হারানোর কষ্ট কীভাবে ভুলব?’

গতকাল শুক্রবার দুপুরে গ্রামের একটি পুকুর থেকে নাজিফার মা আরিফা বেগমের (৪২) লেপে মোড়ানো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নাজিফার বাবা আরমান মিয়া পলাতক রয়েছেন।

নাজিফার নানা কাজী ওমর ফারুক বলেন, ‘আমাদের অনুরোধে চোখে পানি আর বুকভরা কষ্ট নিয়ে আজ সকালে উচ্চতর গণিত বিষয়ের পরীক্ষা দিতে কেন্দ্রে যায় নাজিফা। সে অত্যন্ত মেধাবী মেয়ে, আগের সব কটি পরীক্ষাও সে ভালো দিয়েছে। কিন্তু একটা পরীক্ষার জন্য তার শিক্ষাজীবনে বড় ক্ষতি হয়ে যাক, তা আমরা চাইনি। তার পরীক্ষা চলার সময়টুকুতে আমি কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।’

নাজিফার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নরসিংদী সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিউলি আক্তার বলেন, ‘আমি খবরটি শুনে পরীক্ষার কেন্দ্রে ছুটে গিয়েছি। তাকে মানসিকভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি কেন্দ্রপ্রধানকেও বিষয়টি জানিয়েছি। তাঁরাও তাকে মানসিক সাপোর্ট দিয়েছেন। মায়ের লাশ মর্গে রেখে পরীক্ষার খাতায় মনোনিবেশ করা যে কতটা কঠিন, এই পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যে যায়, সে বোঝে।’

পুলিশ, নিহতের পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকাল ১০টার দিকে স্থানীয় লোকজন গাজীবাড়ির পুকুরে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটি লেপ ভেসে থাকতে দেখেন। সন্দেহ হলে তাঁরা লেপটি টেনে পাড়ে নিয়ে আসেন। এ সময় ওই লেপের ভেতর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। খবর পেয়ে আশপাশের লোকজন জড়ো হন। পরে নরসিংদী মডেল থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে লাশটি উদ্ধার করে।

পাড়ে তোলার পর গৃহবধূর মরদেহে বেশ কিছু আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায় পুলিশ। পরে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির পর লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।

পরিবার বলছে, ১৫ বছর আগে আরমান গাজীর সঙ্গে আরিফা বেগমের বিয়ে হয়। সম্প্রতি আরমান ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ নিয়ে তিনি মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। এরই একপর্যায়ে আরিফা বেগমকে হত্যা করে লাশ লেপে মোড়ানো অবস্থায় বেঁধে পুকুরে ফেলে পালিয়ে যান আরমান। এর পর থেকে আরমান পলাতক। আরিফা-আরমান দম্পতির বড় মেয়ে নাজিফা আক্তার। নাজিফারা দুই বোন, এক ভাই।

জানতে চাইলে নরসিংদী সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) লোপা চৌধুরী বলেন, সাধারণত শুক্রবারে চিকিৎসকেরা ছুটিতে থাকেন। এ ছাড়া জনবলসংকট তো রয়েছেই। এ কারণে গতকাল মর্গে আসা ওই নারীর লাশের ময়নাতদন্ত আজ দুপুরে করা হয়েছে। প্রক্রিয়া মেনে পরিবারের সদস্যদের কাছে তাঁর লাশ হস্তান্তর করা হবে।

নরসিংদী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কাশেম ভূঁইয়া বলেন, আরিফা বেগমের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের কাছে লাশ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। অভিযুক্ত স্বামী এখনো পলাতক। প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।