রায়হান রাজনীতি করত না, আহাজারি করে এই কথাই বলছেন মা

নিহত কিশোর রায়হান হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গতকাল শুক্রবার নিহত কিশোর রায়হান হোসেন (১৫) রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না বলে দাবি করেছেন তার মা খালেদা আক্তারসহ স্বজনেরা। ছেলের মৃত্যুর পর এখনো আহাজারি থামছে না তাঁর। পরিবারকে সাহায্য করতে লেখাপড়ায় ইতি টেনে এলাকায় একটি পানি সরবরাহের দোকানে চার হাজার টাকা বেতনে চাকরি নিয়েছিল সে। টানাটানির সংসারে মায়ের নির্ভরতা ছিল রায়হান। তাকে হারিয়ে এখন দিশাহারা খালেদা আক্তার।

শুক্রবার বিকেলে আজমপুর বাজারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মাথায় আঘাত পাওয়ার পর পানিতে পড়ে মারা যায় রায়হান। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রেজিস্টারে ভুল করে তার নাম জাহেদ হাসান লেখা হয়। এ কারণে ওই ঘটনার পর আজ প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদেও তার নাম ছাপা হয় জাহেদ হাসান। প্রকৃতপক্ষে নিহত কিশোরের নাম রায়হান হোসেন। জাহেদ হাসান তার বড় ভাইয়ের নাম।

সংঘর্ষের ঘটনার পর মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী নিহত কিশোরকে ছাত্রলীগের কর্মী দাবি করেছেন। তবে তাঁর এই দাবিকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলছে বিএনপি। বিএনপিসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মামলা দিয়ে হয়রানি এবং রোডমার্চ কর্মসূচিকে ব্যাহত করতে এই পরিচয় সামনে আনা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপির নেতারা।  আজ শনিবার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করেন দলের কেন্দ্রীয় ও জেলার নেতারা।

এদিকে এ ঘটনায় থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে রায়হানের পরিবার। আজ বিকেল চারটায় রায়হান হোসেনের মা খালেদা আক্তার বাদী হয়ে জোরারগঞ্জ থানায় মামলাটি করেন। মামলায় চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল আমিনসহ ১৫ জনকে আসামি করা হয়। মামলার পর ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে উপজেলার মোবারকঘোনা এলাকার জয়নাল আবেদিনের ছেলে রিফাত, বাঁশখালী এলাকার মজিবুল হকের ছেলে ফরিদ, চুনুমিজির টেক এলাকার ফরিদুল হকের ছেলে রাকিব ও মোবারকঘোনা এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে মেহেরাব হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জোরারগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কিশোর রায়হান হত্যার ঘটনায় আজ বিকেলে তার মা বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলা দায়েরের পর ঘটনার সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

‘আমার বুকের মানিকরে কেন মারল’

নিহত কিশোর রায়হান হোসেনের বাড়ি মিরসরাই উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাপাহাড়ের গুচ্ছগ্রামে। ১০ বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের সঙ্গে গুচ্ছগ্রাম এলাকা থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে ওচমানপুর ইউনিয়নের আজমপুর এলাকায় নানার বাড়িতে চলে যায় তারা। এক বছর আগে সেখানেই একটি পানি বিক্রির দোকানে চার হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরি নেয় সে।

গতকাল বিকেলে রায়হানের মৃত্যুর পর তার মা খালেদা আক্তারকে আজমপুরের বাবার বাড়ি থেকে গুচ্ছগ্রামে নিয়ে আসা হয়। দক্ষিণ সোনাপাহাড় এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে এক কিলোমিটার পূর্বে পাহাড়ি এলাকায় গুচ্ছগ্রামটির অবস্থান। সেখানে তাদের ছোট টিনশেড ঘরটিতে উঠেছেন খালেদা আক্তার। আজ সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায় স্বজন ও প্রতিবেশীরা ভিড় করছেন। ঘরের ভেতর ছেলের শোকে আহাজারি করছিলেন রায়হান হোসেনের মা।

প্রথম আলোকে খালেদা আক্তার বলেন, ‘আমার তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলেটা সহজ-সরল। মেজ ছেলে রায়হান হোসেন ছিল বুদ্ধিমান। সে ছিল আমার বড় ভরসা। ছেলেটার আয়ে সংসার চলত আমার। আমার ওই মানিকটারেই ওরা মেরে ফেলেছে। আমার ছেলে কোনো দিন কারও ক্ষতি করেনি। ছেলে কোনো রাজনীতি করত না।’

ছেলেকে হারিয়ে আহাজারি করছেন রায়হান হোসেনের মা খালেদা আক্তার (বাম পাশে)। আজ সকালে মিরসরাইয়ের দক্ষিণ সোনাপাহাড় গুচ্ছগ্রামে

রায়হান হোসেনের নানা আবুল কালাম (৭০) প্রথম আলোকে বলেন, মেয়ে খালেদা আক্তারের স্বামী নূর জামান এলাকায় ছোট একটি দোকান করত। ১০ বছর আগে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে স্বামী মারা যায়। তখন তিনি তিন নাতিসহ মেয়েকে উপজেলার ওচমানপুর ইউনিয়নের আজমপুর এলাকায় নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। দারিদ্র্যের কারণে তিন নাতির মধ্যে মেজ নাতি রায়হান হোসেন ওচমানপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে লেখাপড়া ছেড়ে দেয়। পরে সে মাকে সাহায্য করতে একটি পানি বিক্রির দোকানে চাকরি নেয়। শুক্রবার বিকেলে আজমপুর বাজারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মাথায় আঘাত পাওয়ার পর পানিতে পড়ে মারা যায় সে।

স্বামীর মৃত্যুর পর রায়হানের মা খালেদা আক্তার গৃহকর্মীর কাজ নেন বলে জানান স্বজনেরা। তিন ছেলের মধ্যে রায়হান মেজ। মাকে সে–ই সাহায্য করত। খালেদার বড় ছেলে জাহিদ হাসান ছোটখাটো কাজ করলেও পরিবারে তেমন সহায়তা করতে পারতেন না। আর রায়হান দোকানে কাজ নিয়েছিল বলে ছোট ছেলে আমজাদের (১০) লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।

মামলা দিতে রায়হানকে ছাত্রলীগ বানানো হচ্ছে, বিএনপির দাবি

বিএনপিসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মামলা দিয়ে হয়রানি করতে এবং রোডমার্চ কর্মসূচি ব্যাহত করতে কিশোর রায়হানকে ছাত্রলীগ কর্মী বানানো হচ্ছে বলে দাবি করেছেন নেতারা।

আজ বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি করেন দলের কেন্দ্রীয় ও জেলার নেতারা। প্রস্তুতি সভায় হামলা এবং কিশোর নিহতের ঘটনায় বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

নিহত রায়হান উদ্দিনকে বিএনপি পরিবারের সন্তান দাবি করে নেতারা বলেন, দোকান কর্মচারী রায়হান উদ্দিন সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। বাবা মারা যাওয়ার পর জীবিকার তাগিদে চাকরি শুরু করেছিল। তবে তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, নিহত রায়হান উদ্দিন ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল কোনো সংগঠনই করে না। রায়হান সপ্তম শ্রেণিও পাস করেনি। বাবা মারা যাওয়ায় চাকরি নিয়েছিল। কিন্তু তার পরিবারের সদস্যরা এবং আত্মীয়স্বজন সবাই বিএনপি করেন। এখন নিহত কিশোরকে দলীয় পরিচয়ে চিহ্নিত করার বিষয়ে সরকারদলীয় নেতাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিএনপিসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের চাপে রাখা। নেতা-কর্মীদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা।