দীর্ঘ ৩৩ বছর পর ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন ও হল সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের মাত্র সাত দিন বাকি থাকলেও ক্যাম্পাসে ভোটের কাঙ্ক্ষিত আমেজ তৈরি হয়নি।
জাকসু নির্বাচনে যে আচরণবিধি কমিশন দিয়েছে, সেটা দিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব না বলে মনে করছেন প্রার্থীরা। আচরণবিধিতেই নির্বাচনের আমেজ ‘কোণঠাসা’ হয়ে গেছে।
আচরণবিধিতে সভা-সমাবেশ ও মিছিলসংক্রান্ত বিধিনিষেধের একটি অংশে বলা হয়েছে, ক্যাম্পাসে যেকোনো ধরনের সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ থাকবে। অন্য একটি অংশে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়া সর্বোচ্চ ২৫ জনের বেশি একসঙ্গে জমায়েত হওয়া যাবে না।
পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল ব্যবহার সংক্রান্ত বিধিনিষেধে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন হল ও অনুষদের সামনে স্থাপিত ও নির্ধারিত বোর্ডে পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল প্রচার বা স্থাপন করতে বলা হয়েছে। প্রচারণায় ব্যবহৃত পোস্টারের ছবিসহ আয়তন সর্বোচ্চ ৪০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য ও ৩০ সেন্টিমিটারের বেশি প্রস্থ হওয়া যাবে না। ক্যাম্পাসের কোথাও পোস্টার বা লিফলেট দেওয়া যাবে না বলে বিধিনিষেধে উল্লেখ করা হয়।
জাকসু নির্বাচনের প্রার্থী ও সাবেক নেতারা বলছেন, ২৫ জনের বেশি জড়ো হতে না পারলে ভোটের আমেজ অনেকটা সাদামাটা হয়ে যায়। প্রার্থীরা একসঙ্গে কার কত কর্মী-সমর্থক আছেন, সেটা না দেখাতে পারলে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা অনেকাংশেই কমে যায়।
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস)–সমর্থিত শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী তৌহিদ সিয়াম প্রথম আলোকে বলেন, আচরণবিধিটা নির্বাচন কমিশনের অদূরদর্শিতার ফল। এটি এমনভাবে করা হয়েছে যে প্রার্থী ও ভোটার—উভয়ের মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক পারস্পরিক যোগাযোগের সুযোগ নেই। এসব কারণে ভোটের আমেজ তৈরি হচ্ছে না।
জাকসুর সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) আশরাফ উদ্দিন খান বলেন, দলীয় সংগঠন আর জাকসু এক নয়। এটা সবাইকে বুঝতে হবে। আগে জাকসু নির্বাচনে কার প্যানেলে কে কত বেশি শিক্ষার্থীদের নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করতে পারে, এ ধরনের অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল। এটা নির্বাচনের সৌন্দর্য, প্রচার-প্রচারণার কৌশল। এতে কখনো শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। মিছিল থাকলে প্যানেলগুলো সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি হয়। ক্যাম্পাসে জাকসু নিয়ে আলাপ-আলোচনা বাড়ে।
গত মঙ্গল ও বুধবার ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন আবাসিক হল ও অনুষদের করিডরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রচারণার জন্য পোস্টার সাঁটানোর বোর্ড দেওয়া হয়েছে। নতুন কলা ভবনের করিডরে থাকা বোর্ডটির দৈর্ঘ্য ৪৮ সেন্টিমিটার ও প্রস্থ ৯৬ সেন্টিমিটার। জাকসু নির্বাচনে ২৫টি পদের বিপরীতে ১৭৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। জায়গা না থাকায় অনেকে লিফলেট ও পোস্টার ওই বোর্ডে স্থাপন করতে পারেননি।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আড্ডাস্থল হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া, টারজান পয়েন্ট, পরিবহন চত্বর, মুরাদ চত্বর, বটতলায় কোনো বোর্ড দেখা যায়নি। এতে প্রার্থীদের সবাই একটি করেও লিফলেট সাঁটানোর জায়গা পাচ্ছেন না।
জাকসুর সহক্রীড়া সম্পাদক (নারী) পদপ্রার্থী ছাবিকুন্নাহার (পলি) প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি গতকাল (সোমবার) মেয়েদের পাঁচ থেকে ছয়টি হলে পোস্টার লাগাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু হলে কেন্দ্রীয় সংসদের প্রচারণার জন্য যে বোর্ড দেওয়া হয়েছে, সেখানে জায়গা পাইনি। যেহেতু আমাদের অন্য কোথাও পোস্টার লাগানোর নিয়ম নেই, সে ক্ষেত্রে প্রশাসন বোর্ডের সংখ্যা বাড়ালে কিংবা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আরও কিছু বোর্ড দিলে আমাদের প্রচারণায় সুবিধা হতো।’
জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, একজন প্রার্থী জাকসু নির্বাচনে সাত হাজার ও হল সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ চার হাজার টাকা খরচ করতে পারবেন। অতিরিক্ত টাকা লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া সাপেক্ষে প্রার্থিতা বাতিল বলে গণ্য করা হবে।
তবে প্রার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই শিক্ষার্থী। তাঁরা কেউ প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা খরচ করবেন না। কিন্তু একটি পোস্টার ছাপাতে এক টাকা করে খরচ হচ্ছে। ১২ হাজার ভোটারের কাছে একটি করে পোস্টার পৌঁছাতে হলেও ১২ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ভিপি প্রার্থী বলেন, একেকজন ১৫ হাজারের বেশি পোস্টার ছাপিয়েছেন। এখানেই তো ১৫ হাজারের বেশি খরচ হয়েছে। এভাবে অবাস্তব আচরণবিধি দিয়ে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
আচরণবিধির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, জাকসুকে ফলপ্রসূ করতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে গণতান্ত্রিক চর্চা, অধিকার ও রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করার কথা, এই আচরণবিধি সেটিকে সংকুচিত করবে। এখানে রক্ষণশীলতা রয়েছে। বিশেষ করে প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে।
ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ও পোস্টার, লিফলেট ব্যবহারে বিধিনিষেধের বিষয়ে জাকসুর সাবেক সাহিত্য সম্পাদক ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরী বলেন, এগুলো শিশুতোষ সব আচরণ। নির্বাচনে পোস্টার ব্যবহার না করতে দেওয়া বা ২৫ জনের বেশি জমায়েত করতে না দেওয়া। এগুলো প্রকাশ্য সংগঠনগুলোর জন্য খুবই সাধারণ ক্যাম্পাস চর্চার বিষয়, এমনকি নির্বাচন না থাকার সময়েও।
সার্বিক বিষয়ে জাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব ও প্রক্টর এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, ইতিমধ্যে ক্যাম্পাসে হল ও বিভিন্ন ভবনের সামনে ৬০টি বোর্ড দেওয়া হয়েছে। আরও ২১টি বোর্ড দেওয়া হবে। সেখানে প্রার্থীরা পোস্টার সাঁটাতে পারবেন। একজন প্রার্থী সাত হাজার টাকার বেশি খরচ করতে পারবেন না। কারণ, প্রার্থীরা সবাই টিউশন করে চলেন। তাঁরা অঢেল টাকা কীভাবে খরচ করবেন? তাঁরা নিজেদের গুণাবলি, হলের ইন্টারেকশন, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অঙ্গনের পরিচিতি দিয়েই প্রচারণা চালাতে পারবেন। তাঁদের তো এত বেশি পোস্টার ছাপানোর দরকার নেই।