রংপুরের ৬ আসন

বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি মাঠে, ‘পরিস্থিতি বুঝছে’ জাপা

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রংপুরের ছয়টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে আগেভাগে প্রচারণায় আছে জামায়াতে ইসলামী। ৩ নভেম্বর বিএনপি প্রার্থী ঘোষণার পর প্রচারে নেমেছেন দলীয় নেতা–কর্মীরা। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অবশ্য দলের সদস্যসচিবের আসনটি টার্গেট করে প্রচার চালাচ্ছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও।

তবে দলের ‘ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত রংপুরে এখনো প্রার্থী নিয়ে মাঠে নামেনি জাতীয় পার্টি (জাপা)। আগামী নির্বাচনে জাপার কী ভূমিকা হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের মধ্যে নানা আলোচনা চলছে। দলের নেতারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দাবি করছেন। একই সঙ্গে ভোটের অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জাপার কো–চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনমুখী দল। কিন্তু তাঁদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা সরকারের কাছ থেকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা চান। একই সঙ্গে বিভিন্ন আসনে প্রার্থীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। নির্বাচনের পরিস্থিতি বুঝে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন।

রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া ও সিটির একাংশ)

দলীয় সিদ্ধান্ত না মেনে গত বছরের ২৯ মে গঙ্গাচড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করে দল থেকে বহিষ্কৃত হন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোকাররম হোসেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে তিনি জয়ী হলেও শেষ পর্যন্ত আর চেয়ারে বসা হয়নি। এবার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে মোকাররমকে রংপুর-১ আসনের প্রার্থী করেছে বিএনপি। মোকাররম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এই আসনে বারবার জোটের প্রার্থীরা মনোনয়ন পেলেও এবার ধানের শীষের প্রার্থী দেওয়ায় নেতা–কর্মীরা উচ্ছ্বসিত। তিনি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।

এই আসনে রংপুর মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি রায়হান সিরাজী দলের প্রার্থী। তিনি নেতা–কর্মীদের নিয়ে গণসংযোগ ও সভা-সমাবেশ করছেন।

জাপার একটি সূত্র জানায়, লন্ডনপ্রবাসী মঞ্জুম আলীকে এই আসনে প্রার্থী করার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। ইতিমধ্যে তাঁর বাড়িতে মতবিনিময় সভা করেছেন উপজেলা জাতীয় পার্টি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মীরা। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, মঞ্জুম আলী নির্বাচন করলে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।

উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মঞ্জুম আলীর ভাই আবদুল্লাহ আল হাদী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই মনোনয়ন পেলে জাপা থেকে ভোট করবেন। না হলে স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন।

এ ছাড়া গণ অধিকার পরিষদের হানিফুর রহমান (সজীব), ইসলামী আন্দোলনের গোলাম মোস্তফা, খেলাফত মজলিসের মমিনুর রহমান ও গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের ফরিদুল ইসলাম নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছেন।

রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ)

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দীর্ঘদিন কারাবন্দী থাকার পর কারামুক্ত জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামকে রংপুর-২ আসনে প্রার্থী করেছে দলটি। তিনিও প্রচারে অংশ নিচ্ছেন। আজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তি পাওয়ার পর এত সাড়া পাবেন, কল্পনার মধ্যে ছিল না।

এ টি এম আজহারুল ইসলামের সঙ্গে এই আসনে বিএনপির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) মোহাম্মদ আলী সরকার। দলীয় সূত্র জানায়, একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিরোধকে কেন্দ্র করে গত ৪ এপ্রিল মোহাম্মদ আলী সরকারের লোকজনের ওপর অতর্কিত হামলার ঘটনা ঘটে। ওই সময় মোহাম্মদ আলী সরকারকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। মোহাম্মদ আলী সরকার বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিচক্ষণতায় সত্যের জয় হয়েছে।

জাতীয় পার্টি থেকে এই আসনে সাবেক সংসদ সদস্য আনিসুল ইসলাম মণ্ডলের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা আশরাফ আলীও প্রচার চালাচ্ছেন।

রংপুর-৩ (রংপুর সদর ও সিটি)

আশির দশক থেকে রংপুর-৩ আসনটি জাপার দখলে। দলের কো–চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান বলেন, জাপা নির্বাচন করলে এই আসনে দলের চেয়ারম্যান গোলাম মুহাম্মদ (জিএম) কাদের প্রার্থী হবেন। ২০১৪ সালের উপনির্বাচন ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মশিউর রহমান যাদু মিয়ার মেয়ে রিটা রহমানকে প্রার্থী করলেও এবার মনোনয়ন পেয়েছেন মহানগরের আহ্বায়ক সামসুজ্জমান (সামু)। বিষয়টি মানতে পারছেন না তবে রিটা রহমান ও তাঁর সমর্থকেরা। রিটা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা জোর দিয়ে বলেছেন, এটা প্রাথমিক। সুতরাং মনোনয়নের জন্য তিনি ও তাঁর নেতা–কর্মীরা মাঠে আছেন।

দলের আরেক অংশ মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব মাহফুজ উন নবীকে প্রার্থী হিসেবে চায়। ১১ নভেম্বর তাঁর সমর্থকেরা নগরে গণমিছিল করে প্রার্থিতা পুনর্বিবেচনার দাবি জানান। মাহফুজ উন নবী বলেন, নেতা–কর্মীরা তাঁকে প্রার্থী করার দাবি করেছেন। তবে দল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিলে সে অনুযায়ী কাজ করবেন তিনি।

সামসুজ্জামান বলেন, বিএনপি বড় দল। চার-পাঁচজন মনোনয়ন চাইতেই পারেন। তবে তাঁর বিশ্বাস, দলের অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা তাঁর পক্ষে কাজ করবেন। 

জামায়াতের প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় কাযনির্বাহী সদস্য মাহবুবুর রহমান (বেলাল) ও ইসলামী আন্দোলনের আমিরুজ্জামান (পিয়াল) নিয়মিত প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। গণসংহতি আন্দোলনের জেলা আহ্বায়ক তৌহিদুর রহমান এ আসনে প্রার্থী হবেন। বাম জোট থেকে বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা রাজেকুজ্জামান রতন অথবা জেলা আহ্বায়ক আবদুল কুদ্দুস প্রার্থী হতে পারেন বলে আলোচনা আছে।

রংপুর-৪ (কাউনিয়া-পীরগাছা)

জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও কাউনিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি এমদাদুল হক ভরসা দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে সবার চোখ এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেনের দিকে। ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে এলাকায় গণসংযোগ করছেন আখতার। এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী রংপুর মহানগরের আমির এ টি এম আজম খান।

স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এনসিপির সঙ্গে বিএনপি অথবা জামায়াত যেকোনো দলের জোট হলে ওই দলের প্রার্থী প্রত্যাহার করে আখতারকে সমর্থন দিতে পারে।

আজম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনগণের পক্ষে চেতনা সৃষ্টি হয়েছে দাঁড়িপাল্লার পক্ষে। তবে জামায়াত আনুগত্যের সংগঠন। কেন্দ্র থেকে যখন যা নির্দেশ আসবে, তা মেনে নেওয়া হবে।’

পীরগাছা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু নাসের শাহ মো. মাহবুবার রহমানকে ইতিমধ্যে দলের প্রার্থী ঘোষণা করেছে স্থানীয় জাতীয় পার্টি। মাহবুবার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি স্বাভাবিকভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কোথাও কোনো বাধা পাননি।

রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর)

জামায়াতের প্রার্থী হয়েছেন জেলা জামায়াতের আমির গোলাম রব্বানী। সেই তুলনায় নতুন প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি। মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম রব্বানী। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পর ধানের শীষ থেকে এখানে প্রার্থী হয়েছে। দলের সাংগঠনিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো। তাঁরা জয়লাভ করবেন বলে আশা করছেন। এবি পার্টি থেকে এ আসনে জেলা আহ্বায়ক আবুল বাছেত মার্জান ও বাম জোট থেকে বাসদের জেলা কমিটির সদস্যসচিব মমিনুল ইসলাম প্রার্থী হবেন।

রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ)

২০০৮ সালে শেখ হাসিনার পর গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে এমপি হন জাতীয় সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তৎপরতা চালাচ্ছেন বিএনপি ও জামায়াতের দুই প্রার্থী। বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম। জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা নুরুল আমীন দলের জেলা কমিটির মজলিসে শুরা ও কর্মপরিষদ সদস্য। সাবেক এমপি নূর মোহাম্মদ মণ্ডলের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কথাও আলোচনায় আছে। ২০০১ সালে নূর মোহাম্মদ জাপা থেকে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) পীরগঞ্জ উপজেলা সভাপতি কামরুজ্জামান এই আসনে দলের প্রার্থী হবেন।