মানিকগঞ্জে শিল্পী আবুল সরকারের মুক্তি দাবিতে মানবন্ধনে হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে
মানিকগঞ্জে শিল্পী আবুল সরকারের মুক্তি দাবিতে মানবন্ধনে হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে

বাউলশিল্পী আবুল সরকারের ভক্তদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা, আসামি অজ্ঞাতনামা

মানিকগঞ্জে গ্রেপ্তার বাউলশিল্পী আবুল সরকারের ভক্তদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে। হামলায় আহত এক ভক্ত বাদী হয়ে আজ সোমবার সন্ধ্যায় সদর থানায় মামলাটি করেন। এ ছাড়া বাউল ও ভক্তদের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন।

মামলার তথ্য নিশ্চিত করে সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, এ হামলার ঘটনায় আজ সন্ধ্যায় থানায় মামলা হয়েছে। হামলায় আহত বাউলভক্ত আবদুল আলীম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেছেন। হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ৪ নভেম্বর মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জাবরা এলাকায় খালা পাগলীর মেলায় পালাগানের আসরে বাউলশিল্পী আবুল সরকার ধর্ম অবমাননা করে মন্তব্য করেন বলে অভিযোগ ওঠে। তাঁর মন্তব্যের ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনা শুরু হয়।

এর জের ধরে গত বুধবার রাতে মাদারীপুরে একটি গানের আসর থেকে আবুল সরকারকে আটক করে মানিকগঞ্জ ডিবি পুলিশের একটি দল। গত বৃহস্পতিবার সকালে তাঁকে মানিকগঞ্জ জেলা ডিবির কার্যালয়ে আনা হয়। পরে ওই দিন দুপুরে ঘিওর উপজেলার মুফতি মো. আবদুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে আবুল সরকারকে আসামি করে ঘিওর থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে মানিকগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

গতকাল রোববার সকাল ৯টার দিকে বাউলশিল্পী আবুল সরকারের মুক্তির দাবিতে মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করেন তাঁর ভক্ত-অনুরাগীরা। একই সময়ে ‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তৌহিদি জনতা’ ব্যানারে জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে ঘিরে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ বাউলশিল্পী ও ভক্তদের বেলা ১১টার দিকে কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা দেয়। পরে সকাল ১০টার দিকে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে আবুল সরকারের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ‘আলেম-ওলামা ও তৌহিদি জনতার’ বিক্ষোভ মিছিল হয়। মিছিলটি জেলা শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠের দক্ষিণে প্রধান ডাকঘর কার্যালয়ের সামনে গিয়ে শেষ হয়। এরপর সেখানে আয়োজিত সমাবেশে আলেম-ওলামাদের কয়েকজন বক্তব্য দেন।

এ সময় শহরের দক্ষিণ সেওতা এলাকায় সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠের দক্ষিণ পাশে প্রায় অর্ধশত ভক্ত-অনুরাগীদের কেউ চা পান করছিলেন, কেউ দাঁড়িয়ে ছিলেন। একপর্যায়ে বেলা পৌনে ১১টার দিকে ‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তৌহিদি জনতা’–এর ব্যানারে থাকা এক দল ব্যক্তি লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল নিয়ে বাউলশিল্পী ও ভক্তদের ওপর হামলা করেন। এতে বাউলভক্তদের মধ্যে কমপক্ষে তিনজন গুরুতর আহত হন। এ ছাড়া তৌহিদি জনতাপক্ষের একজন আহত হন। তাঁদের জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে এদিন সন্ধ্যার দিকে আরও হামলার ভয়ে আবুল সরকারের আহত অনুসারীরা হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান।

এ বিষয়ে বাউলশিল্পী আবুল সরকারের ভাতিজা পাপেল সরকার বলেন, হামলায় সদর হাসপাতালে ভর্তি তিনজনেরই মাথায় বেশ কয়েকটি সেলাই দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারাত্মক আঘাত করা হয়েছে। তবে পুনরায় হামলার ভয়ে গতকাল সন্ধ্যায় তাঁরা হাসপাতাল ছেড়ে বাড়িতে চলে যান। বাড়িতে থেকেই তাঁরা চিকিৎসা করাচ্ছেন।

এদিকে এ হামলার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন নিন্দা জানিয়েছে। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক আরাফাত হোসেন বলেন, ‘বাউলগান, লোকসংগীত, পালাগান, যাত্রাপালা সারি, জারি আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতিকে আমাদের ধারণ ও লালন করতে হবে। বাউলশিল্পী আবুল সরকার ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করলে তার জন্য দেশে প্রচলিত আইন আছে। সেই আইনে তাঁর বিচার হবে। কিন্তু তৌহিদি জনতার নামে মব সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অপরাধ। এই হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি না হলে ভবিষ্যতে এই অপরাধ চলতেই থাকবে।’

ঘটনার পর জেলার সাটুরিয়া উপজেলার পার তিল্লী গ্রামে বাউলশিল্পী আবুল সরকারের বাড়িতে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।